Editorial

একচেটিয়া বিপর্যয়

সম্পাদকীয় বিভাগ

মোদী জমানায় ‘বিকশিত’ ভারতের উন্নয়ন যখন চিলেকোঠায় উঠে গেছে এবং ভারত যখন ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির তকমা জোটাতে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছে তখন আচমকা কার্যত তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে গোটা দেশের অসামরিক পরিবহণ ব্যবস্থা। গত দু’-তিন দিনে বাতিল হয়েছে কয়েক হাজার উড়ান। সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে যাত্রা করেছে আরও কয়েক হাজার উড়ান। প্রায় সব বিমান বন্দরে হাজার হাজার যাত্রী চূড়ান্ত হেনস্তার শিকার। না, কোনও প্রযুক্তিগত বা যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে এই নজিরবিহীন অচলাবস্থা তৈরি হয়নি। ধর্মঘট বা আন্দোলনের কারণেও যাত্রী বিমান পরিষেবায় এমন সঙ্কট তৈরি হয়নি। বরং এমনটা হতে পারে জানা সত্ত্বেও আগাম কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে কয়েক লক্ষ বিমান যাত্রীকে এমন ঘোরতর হেনস্তা ও সঙ্কটের মুখে ঠেলে দেওয়া হলো। তার চেয়েও আশ্চর্যের ব্যাপার এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বুঝেও সরকার সতর্ক হয়নি বা কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।
শেষ পর্যন্ত যখন গোটা ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে আসরে নামে সরকার। অসামরিক বিমান পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ জিডিসিএ’র চালু করা পাইলট ও বিমান কর্মীদের ডিউটি সংক্রান্ত নতুন বিধি স্থগিত করে দিয়েছে সরকার। বিমান মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন তিন দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য যাদের জন্য এই বিপর্যয় সেই ইন্ডিগো সংস্থার সিইও জানিয়েছেন ১৫ ডিসেম্বরের আগে স্বাভাবিক হবে না।
বিমানের পাইলট ও কর্মীদের ডিউটি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কিছু নিয়ম আছে। অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ভারতের বিমান সংস্থাগুলি সেই নিয়ম উপেক্ষা করে অবসরের সময় কমিয়ে জোর করে অতিরিক্ত সময় কাজ করাতে বাধ্য করে। সাধারণভাবে সপ্তাহে ৩৬ ঘণ্টা বিশ্রাম এবং বেশি নাইট ডিউটি ও রাতে বেশি বিমান অবতরণে বাধ্য করা হতো পাইলটদের। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়তে থাকে এবং যাত্রী নিরাপত্তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তাই ডিজিসিএ নতুন বিধি তৈরি করে গত বছর জানুয়ারি মাসে এবং তা চালু করার কথা ঘোষণা করে এ’বছর জুন থেকে। কিন্তু বিমান সংস্থাগুলির চাপে তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। পরে দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশে এই নভেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। নতুন বিধিতে অতিরিক্ত পাইলট ও কর্মী প্রয়োজন জেনেও দেশের বৃহত্তম বিমান সংস্থা নতুন পাইলট ও কর্মী নিয়োগ করেনি। কম পাইলট দিয়ে কাজ চালাতে গিয়ে পাইলটের অভাবে উড়ান বাতিল হতে হতে ভয়াবহ আকার নেয়। অতঃপর সরকারের হস্তক্ষেপে স্থগিত হয়ে যায় নতুন বিধি।
এখন প্রশ্ন হলো এক বছরেরও বেশি সময় পেয়েও কেন নতুন পাইলট ও কর্মী নিয়োগ করা হয়নি। সরকারই বা এই প্রশ্নে এতদিন নজর দেয়নি কেন? সন্দেহ বেসরকারি সংস্থার চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে সরকার। অথবা বেসরকারি সংস্থার বাড়তি মুনাফার স্বার্থে সরকার নিষ্ক্রিয় ছিল। ইন্ডিগো বিমান পরিষেবার ৬৫ শতাংশ দখল করে একচেটিয়া ব্যবস্থা কায়েম করে সরকারের মাথায় চেপে বসেছে। তারা জানে গোটা নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। সরকার তাদের হয়ে কাজ করতে বাধ্য। এই জন্য সম্ভবত সচেতনভাবে বিপর্যয়ের সুযোগ তৈরি করেছে নতুন কর্মী নিয়োগ না করে। একচেটিয়া ব্যবস্থা এভাবেই জনস্বার্থকে বুড়ো আঙুল দেখায়। মোদীরাও বৃহৎ বৃহৎ সংস্থা পছন্দ করেন। কয়েকটি অতিকায় কর্পোরেট দেশের গোটা অর্থনীতিকে কবজা করুক। প্রতিযোগিতামূলক বাজারের বদলে একচেটিয়া দখলদারিই মোদীনোমিক্সের বৈশিষ্ট্য।

Comments :0

Login to leave a comment