Bangladesh

গণঅভ্যুত্থান, মব, ধর্মীয় উগ্রবাদ, ও জামায়াতের রাজনীতি

আন্তর্জাতিক উত্তর সম্পাদকীয়​

শেখ রফিক

ঠিক এক বছর চার মাস আগে গার্মেন্টস শ্রমিক কবীর ন্যায্য মজুরির দাবিতে মিছিল করতেন, গণঅভ্যুত্থানেও ছিলেন সক্রিয়। চা বাগানের শ্রমিক তাপস মাত্র ৩০০ টাকার মজুরির জন্য আন্দোলন করেছেন, তিনিও ছিলেন গণঅভ্যুত্থানে, আহত হয়েছিল পুলিশের গুলিতে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাবা শিক্ষার অধিকার নিয়ে মিছিল করেছিল, সেও গুলি খেয়েছিল। টেকনিক্যাল কলেজের ছাত্র সুমন নিরাপদ ক্যাম্পাস ও চাকরির দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল, তার শরীরেও লাঠির দাগ লেগেছে। সাংবাদিক তপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পক্ষে কলম ধরেছিলেন, গণঅভ্যুত্থানেও ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসাবে। প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ভোট অধিকার, গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচারের দাবিতে গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিলেন, তাদের মধ্যে প্রায় হাজারো জন জীবন দিয়েছেন, আহত হয়েছেন দশ হাজারেরও বেশি।
এক কথায় সবার দাবি ছিল— রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রাপ্তি। কিন্তু এতদিন পার হয়ে গেলেও সেই দাবি আজও রয়ে গেছে সম্পূর্ণ অপূর্ণ। আজও তাদেরকে ঠিক একই দাবিতে মিছিল করতে হয়! মার খেতে হয়, জেলে ঢুকতে হয়— অনেক ক্ষেত্রে জীবনও দিতে হয়।
আজও বামপন্থী দলগুলিকে বলতে হয়— শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি দাও, কৃষকের ফসলের দাম দাও, বিরোধী দলের ওপর মিথ্যা মামলা-হয়রানি বন্ধ করো, মতপ্রকাশে বাধা দিও না, হত্যা-গুম-ধর্ষণ বন্ধ করো, গরিব মানুষের জন্য রেশন চালু করো, বেকারদেরকাজ দাও, ধর্ষণ-নারী নির্যাতন রোধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ করো, দুর্নীতি ও লুটপাট থামাও, টাকার পাচার বন্ধ করো, খেলাপি ঋণ আদায় করো, সন্ত্রাস-টেন্ডারবাজি-দখলদারি রুখে দাও— যা ঠিক এক বছর চার মাস আগেও বলেছিল। অথচ চাওয়া-পাওয়ার আকাশ-পাতাল ব্যবধান তো থেকেই গেল।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর ড. মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও, পাঁচ আগস্ট চব্বিশের পরে আবার হামলা-মামলা, আগুন, সন্ত্রাস, মব, গুম, হত্যা, খুন, নির্যাতন ও শত শত অমানবিকতা! যা অবর্ণনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং জন আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত— যা এখনো চলমান।
লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারি ও মুনাফাখোর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বিশেষত নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি অর্থনৈতিক সঙ্কটে দিশাহারা। একই সাথে নানা অপরাধের বৃদ্ধি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি জনগণের নিরাপত্তা ও আস্থাকে নড়বড়ে করে তুলেছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন, মাজারে হামলা, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ীদের উপর হামলা এবং প্রতিরোধহীনতা সরকারের ব্যর্থতা দিনের আলো মতো স্পষ্ট।
গণঅভ্যুত্থানের চেতনা কেউ ধারণ করেনি— কারণ এই চেতনার অর্থ ছিল ত্যাগ, আত্মনিবেদন ও জনমানুষের পক্ষ নেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ রাজনৈতিক শক্তি সেই চেতনার সারবত্তা না বুঝে বা সচেতনভাবেই তাকে নিজের মতো ব্যবহার করেছে। ফলে আন্দোলন-পরবর্তী সময়েই দেখা গেছে, যার যার স্বার্থে ব্যস্ত রয়েছে, যেটাও চলমান।
৫ আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে জনগণের একাংশ (ছাত্র ও ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী) নিজেদের বিজয়ী মনে করে মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে প্রতিহিংসার নানা ঘটনা সংগঠিত করেছে, যা এখনো অব্যাহত। শুরু থেকেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, হাসপাতালের ডাক্তার, সাংবাদিক, সরকারি চাকরিজীবী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। এছাড়াও আওয়ামি লিগের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা, হত্যা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া এবং আওয়ামি লিগের দোসর ট্যাগ দিয়ে অনেকের উপর তারা নৃশংস হামলা চালায়। অন্যদিকে,  মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর করে জুতোর মালা পরিয়ে হেনস্তা করে। আর হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসায়।
সিলেটের শাহ সুফি আবদুল কাইউমচিশতিয়ার মাজারে হামলা, ময়মনসিংহ দেওয়ানবাগ পীরের দরবারে হামলা, শেরপুর, শরীয়তপুর সহ সারাদেশে শত শত মাজারে হামলার ঘটনা ঘটে। ভারত সমর্থনের অভিযোগে ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেইলি স্টার’-র কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে। মহতী সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা বন্ধ, নারায়ণগঞ্জে সুফি সাধক শাহ্সোলায়মানলেংটার উরস ও মেলা বাধাগ্রস্ত করে ‘তৌহিদী জনতা’ নামে একটা ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী চলতি বছরে সিলেটে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করে। জয়পুরহাট ও দিনাজপুরে নারী ফুটবল ও ক্রীড়া কার্যক্রমে বাধা দেয়, সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়। ধানমণ্ডি-৩২ নম্বরে বাড়ি ভেঙে ফেলায় তারা সক্রিয় নেতৃত্ব দেয়। ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালি, কুষ্টিয়া, নাটোর ও পিরোজপুর সহ বিভিন্ন শহরে আওয়ামি লিগ নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা, আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে— এক্ষেত্রেও তাদেরকে দেখা যায়। নোয়াখালির শাহ সুফি আইয়ুব আলী দরবেশের মাজারে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। নাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলায় ওরস আয়োজন ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। টাঙ্গাইলের ভালোবাসা দিবস উদ্‌যাপনে ভাঙচুর করে, যে কারণে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বসন্তবরণ স্থগিত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযুক্তের মুক্তির দাবিতে তৌহিদী জনতার চাপ প্রয়োগ এবং মুক্তির পরে মালা দিয়ে বরণ। মাজার ভাঙার ধারাবাহিকতায় নারায়ণগঞ্জের দেওয়ানবাগ মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, সোনারগাঁর আয়নাল শাহ দরগা ভাঙা, সিলেটের শাহপরাণ মাজারে গান-বাজনা বাতিল ঘোষণা করে। ঝালকাঠির রাজাপুরে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙে কোরানের ভাস্কর্য স্থাপন; এলাকায় ‘কোরান চত্বর’ ঘোষণা করে। ঢাকায় ‘মঞ্চ ৭১’ আয়োজিত ‘মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বাংলাদেশের সংবিধান’ আলোচনায় হামলার শিকারদের আটক পুলিশ; আর হামলাকারীরা বীরদর্পে মুক্ত থাকে।
‘তৌহিদীজনতা’ রসহিংসতা নারীর শিক্ষা, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উৎসব ও ইতিহাস-বিষয়ক আলোচনা— সব ক্ষেত্রেই ভয় ও চাপ বাড়াচ্ছে। শিশু, কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের সামাজিক বিকাশ ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এটি ক্ষতিকর। এইসব কারণে বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস, ঘুড়ি উৎসব, মেলা— সব অনুষ্ঠান বাতিল বা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে উদ্যোক্তারা। হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং সাংস্কৃতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক অনুষ্ঠান বন্ধ করা নাগরিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য সরাসরি হুমকি। যার প্রভাব বাংলাদেশ বহুদিন বয়ে বেড়াতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ইসলাম একটি নতুন ধারা তৈরি হয়েছে— যারা নিজেদের সব থেকে বড় যোগ্যতা বলে মনে করে প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি মত, প্রতিটি উৎসবকে সমস্যা বলে ঘোষণা করা। বাস্তবে যাদের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল চালিকাশক্তিই হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘সমস্যা’খোঁজা। সমাজে সামান্য ভিন্নতা দেখলেই তারা ভয় পায়, প্রশ্ন দেখলেই রেগে যায়, সংস্কৃতি দেখলেই সন্দেহে পড়ে, আর মানুষ দেখলেই বিভেদ সৃষ্টি করে। তবুও তারা দাবি করে— দেশ চালানোর দায়িত্ব তাদেরই দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ বহুমাত্রিক ধর্মীয় সংস্কৃতির দেশ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী জনগোষ্ঠী— সবাই একসঙ্গে একটি সমাজ গড়ে তুলেছে। কিন্তু এই সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীর কাছে এই বৈচিত্রই নাকি ‘সমস্যা’! হিন্দু সমস্যা, শিয়া সমস্যা, কাদিয়ানী সমস্যা— এদের তালিকা এত বড় যে, মনে হয় তারা মানুষের পরিচয়কে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করাকেই অভ্যাস করেনি। ধর্মীয় ভিন্নতা যে এক দেশের শক্তি হতে পারে— এ বিশ্বাস ও দর্শন তাদের রাজনীতিতে নাই।
ইসলামের ভেতর বহু ধারার সহাবস্থান রয়েছে— সুন্নি, শিয়া, সুফি, আহলে হাদিস, তাহলে কোরান, নানা মত। ইসলামিক সভ্যতার উত্থানের শক্তি ছিল মতের ভিন্নতা গ্রহণ করার সাহস। কিন্তু এই সঙ্কীর্ণ রাজনীতির লোকেরা এসবকেও সমস্যা মনে করে। তাদের তালিকায় আছে— সুফি সমস্যা,তাহলে কোরান সমস্যা, মাজার সমস্যা। তারা যেন মনে করে, একমাত্র তাদের ব্যাখ্যাই সত্য; বাকিরা সবাই ভ্রান্ত।
সংস্কৃতি যে কোনও জাতির প্রাণ। কিন্তু এই সঙ্কীর্ণ মতাদর্শের গোষ্ঠী সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, চারুকলা, ভাস্কর্য— এইসবকেও সন্দেহের চোখে দেখে। শিল্পকে যারা দেশের শত্রু মনে করে, তারা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বললে তা হাস্যকর শোনায়। কারণ শিল্প মানেই মুক্ত মনন— এই মুক্ত মনন তাদের রাজনীতির প্রথম শত্রু। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলার মূল ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে যারা— তাদেরও তারা সমস্যা মনে করে। রবীন্দ্রনাথ সমস্যা, লালন সমস্যা, রোকেয়া সমস্যা, জাহানারা ইমাম সহ মুক্ত চিন্তার লেখক-বুদ্ধিজীবী সবাই সমস্যা। 
গণতন্ত্রের মূল শক্তি হলো প্রশ্ন করার অধিকার। যুক্তি দেওয়া, বিতর্ক করা, মত প্রকাশ করা। কিন্তু এই সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠী এগুলোকে ভয় পায়— কারণ যুক্তি অন্ধবিশ্বাস ভেঙে দেয়। তাই তারা বলছে— যুক্তি সমস্যা, প্রশ্ন সমস্যা, মুক্তচিন্তা সমস্যা, নিরীশ্বরবাদী সমস্যা। একজন নাগরিক চিন্তা করলে যদি তাতেই সমস্যা হয়, তাহলে সেই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অস্তিত্বই গণতন্ত্রের জন্য বিপদ।
নারী বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু সঙ্কীর্ণ রাজনীতিতে নারীকে সমমর্যাদা ও মানুষের বদলে ‘সমস্যা’ হিসাবে তুলে ধরা হয়। নারী সমস্যা, নারীবাদ সমস্যা, নারীর পোশাক সমস্যা, নারীর চাকরি সমস্যা— এছাড়া নারীর স্বাধীনতাকেও ভয় দেখানো হয়। যাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকেই সমস্যা মনে করে, তারা রাষ্ট্রকে কখনোই সমানাধিকার দিতে পারে না।
মানুষের পরিচয় তার ব্যক্তিগত অধিকার। হিজড়া ও এলজিবিটিকিউ+ জনগোষ্ঠীও এ দেশের নাগরিক। কিন্তু এই সঙ্কীর্ণ মানসিকতার রাজনৈতিক শক্তির কাছে তারা অসমাপ্ত সমস্যা। এদের তালিকায়—এলজিবিটিকিউ+ সমস্যা, হিজড়া সমস্যা। যে রাজনীতি মানুষের ভিন্ন পরিচয়কে মানবাধিকার হিসাবে দেখতে পারে না, সেই রাজনীতি মানবিক রাষ্ট্র গড়তে পারে না— বরং দমননীতিই তৈরি করে।
১৯৭১ সালে জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা ছিল শুধু রাজনৈতিক ভুল নয়— এটি ছিল নৈতিক লজ্জা। পাকিস্তানি বাহিনীর পাশে দাঁড়ানো, আলবদর-রাজাকার গঠন, গণহত্যার সহযোগিতা— এগুলো ইতিহাসের অমোচনীয় অধ্যায়। একটি জাতির জন্ম ইতিহাসকেও তারা সমস্যা করে দেখাতে চায়। মুক্তিযুদ্ধ সমস্যা, মুক্তিযোদ্ধা সমস্যা, একাত্তরের চেতনা সমস্যা, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ সমস্যা, শহীদ মিনার সমস্যা, স্মৃতিসৌধ সমস্যা, জাতীয় সঙ্গীত সমস্যা। যে রাজনীতি জন্মের ইতিহাসকে অস্বীকার করে, শিকড়কে দুর্বল করে, আত্মপরিচয়কে প্রশ্ন বিদ্ধ করে— সে রাজনীতি কখনোই স্বাধীন দেশের রাজনীতি হতে পারে না।
বাংলাদেশের যেসব সরকার অতীতে ক্ষমতায় ছিল তাদের অনেক ভুল ছিল। কিন্তু একটি বস্তুনিষ্ঠ সত্য হলো— কোনও সরকারই কখনো মানুষের পরিচয়কে ‘সমস্যা’ হিসাবে দেখেনি। কেউ রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করেনি, কেউ বৈশাখ বাতিল করতে বলেনি, কেউ নারীর স্বাধীনতাকে অপরাধ করেনি, কেউ শিল্প-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেনি। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার ন্যূনতম মানবিকতা ছিল।
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বলেছিলেন— ‘নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, জামায়াতের ইসলামও ইসলাম নয়— এটি আসলে মওদূদীবাদ।’ এই উক্তি কোনও কৌতুক ছিল না; ছিল সতর্কবার্তা। ভাসানী নিজে ছিলেন কৃষক-শ্রমিকের নেতা, শোষণের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামী। তার কাছে রাজনীতি ছিল মানুষকে মুক্ত করা, মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। তাই তিনি দেখেছিলেন— জামায়াত ধর্মের নাম ব্যবহার করে মূলত ক্ষমতার রাজনীতি করতে চায়। জনগণের সত্যিকারের প্রশ্ন— ক্ষুধা, দারিদ্র, জমি, ন্যায়, বঞ্চনা— এগুলোর সঙ্গে জামায়াতের রাজনীতির কোনও সম্পর্কই নেই।
জামায়াত-শিবির চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে প্রচার চালিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে বিভ্রান্ত করা। তারা বলেছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা প্রকৃত স্বাধীনতা নয়; সেটি ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশল ছিল। আর চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই আধিপত্য থেকে মুক্তি এসেছে। এই অপপ্রচার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত এবং শহীদদের আত্মত্যাগকেও অবমাননা করা।
জামায়াত ইসলাম মানুষের পরিচয়, নারী স্বাধীনতা, উৎসব, সাংস্কৃতিক চর্চা, যুক্তি, প্রশ্ন, শিল্প, ইতিহাস—সবকিছুকেই সমস্যা ভাবে, তারা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য উপযুক্ত নয়। তারা শুধু বিভেদে বাঁচে, ঘৃণায় টিকে থাকে, অন্ধকারে রাজনীতি করে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে সমস্যা-সন্ধানী রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে। প্রয়োজন মানবিক, যুক্তিবাদী, বৈচিত্র-স্বীকারকারী গণতন্ত্রের পথ তৈরি করা।
জনগণ ভেবেছিলেন শেখ হাসিনা চলে গেলে দেশে শান্তি ফিরে আসবে। কারণ, তার সরকারের অধীনে ভোটাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সম অধিকার হারিয়ে গিয়েছিল। বিরোধী দল দমন, গুম, খুন, ধর্ষণ ও দুর্নীতি রাজত্ব ছিল। কিন্তু গত এক বছর চার মাসে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরেছে কি? জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার পেয়েছে কি? বাস্তবে শুধু সরকার বদলেছে, ব্যবস্থা বদলায়নি। র্যা ব, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর পোশাক বদলেছে, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি। গুলি চালানো, নিরস্ত্র মানুষ হত্যা, দমন-পীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে। রাষ্ট্র যদি জনবান্ধব হতো, তাহলে এসব বন্ধ হতো। বরং বাস্তবতা হলো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা আজও অধরা।
লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক কলাম লেখক

Comments :0

Login to leave a comment