Modi UGC

উচ্চ শিক্ষায় অশনি সংকেত

উত্তর সম্পাদকীয়​

সেখ সাইদুল হক
মোদী সরকার সংসদের আগামী শীতকালীন অধিবেশনে ইউজিসি তুলে দিয়ে উচ্চ শিক্ষায় একক নিয়ামক সংস্থা গঠনের বিল আনতে চলেছে। এই সংস্থার নাম হবে ভারতের উচ্চ শিক্ষা কমিশন (হায়ার এডুকেশন কমিশন অব ইন্ডিয়া বা ‘হেকি’)। এই নিয়ামক সংস্থা যে তিনটি সংস্থাকে প্রতিস্থাপন করবে তারা হলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি), অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন (এআইসিটিই), ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন (এনসিটিই)। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ তে এ সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছিল। নতুন বিলের প্রস্তাবনা অনুযায়ী সর্বভারতীয় স্তরে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘হেকি’ একমাত্র নিয়ামক সংস্থা হিসাবে কাজ করবে। তবে মেডিক্যাচল এবং আইন কলেজগুলি এর আওতায় বাইরে থাকবে।
লোকসভার বুলেটিন অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষার এই সংস্থা তিনটি প্রধান ভূমিকা পালন করবে— নিয়ন্ত্রণ, স্বীকৃতি প্রদান এবং পেশাগত মান নির্ধারণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তহবিল বা অর্থায়ন তা থাকবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রকের হাতে।
২০১৮ সালের বিল
‘হেকি’ গঠনের ধারণা এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৮ সালের জুন মাসে এ সম্পর্কে একটি খসড়া বিল আনা হয়। তারও নাম ছিল হায়ার এডুকেশন কমিশন অব ইন্ডিয়া (রিপিল অব ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশন আ্যক্ট)। সংশ্লিষ্ট মহলের মতামত ও পরামর্শের জন্য আনা এই খসড়া বিলে ইউজিসি তুলে দিয়ে এই নতুন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখনই সিপিআই(এম) সহ অন্যান্য বামপন্থী এবং কিছু গণতান্ত্রিক দল তার বিরোধিতা করে। সিপিআই(এম) নেতা সীতারাম ইয়েচুরি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বলেন, এই বিলটিকে যদি আইনে পরিণত করা হয় তবে তা দেশের সামগ্রিক উচ্চ শিক্ষা এবং সরকারি অনুদানপুষ্ট শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর এক গভীর ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কি ছিল ২০১৮ বিলে
তাই বর্তমান বিজেপি সরকারের পুনরায় এই ‘হেকি’ গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার উদ্দেশ্যকে এবং কারণ বুঝতে হলে ২০১৮ সালের খসড়া বিলে কি বলা হয়েছিল এবং ঐ বিলের মাধ্যমে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও কেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল এবং কেন তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী— এগুলো জেনে নেওয়া দরকার।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কর্পোরেটরা শিক্ষার, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাকে লুটের মৃগয়া ক্ষেত্র হিসাবে ধরতে চাইছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার  কর্পোরেটদের স্বার্থে এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে যাতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক ধাঁচে নিয়ে এসে পাঠক্রম, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রীয়করণ করা যায়। সেই লক্ষ্যেই রচিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০। 
উচ্চ শিক্ষার চিত্র 
কেন্দ্রীয় সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ২০১৯- ২০ এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে সারা দেশে কমবেশি ৫০০টি কলেজ এবং ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বর্তমানে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে হয়েছে ৪৫ হাজারের বেশি কলেজ এবং ৮০০ এর উপর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৭ সালের ছিল ২ লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রী, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪ কোটির কাছাকাছি। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ হলো স্নাতক স্তরের, ১৫ শতাংশ স্নাতকোত্তর স্তরের, প্রায় ২ শতাংশ গবেষণা স্তরের। বর্তমানে ম্যানেজমেন্ট ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায় শিক্ষার্থী বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ম্যানেজমেন্টে ১৭.৫৭ শতাংশ, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ১৬.৫ শতাংশ। সাধারণ  বিজ্ঞান শিক্ষায় ১৮.৬৫ শতাংশ। ফলে দেশে উচ্চ শিক্ষার বাজার ক্রমবর্ধমান। সর্বভারতীয় উচ্চ শিক্ষার সমীক্ষা রিপোর্ট-এ দেখা যাচ্ছে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি কলেজ ব্যক্তিমালিকানাধীন। 
কেন ইউজিসি 
১৯৪৪ সালের সার্জেন্ট কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৪৫ সালে আলিগড়, বেনারস ও দিল্লি এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় দেখার জন্য ‘ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিটি’ গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে এই কমিটির অধীনে আনা হয় দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে। ১৯৪৮-৪৯ সালে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গঠিত রাধাকৃষ্ণান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির আর্থিক সাহায্য ও পরিচালনগত বিষয়ে সমন্বয়ের জন্য ১৯৫৩ সালে ‘ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন’ গঠন করে যা ১৯৫৬ সালে আইনে বিধিবদ্ধ করা হয়। বলা হলো, উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির আর্থিক বিষয়ে অনুদান ও তাদের অনুমোদন, নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনগত সমন্বয়, প্রতিষ্ঠানগুলির মূল্যায়ন সংক্রান্ত যাবতীয় দিক দেখভাল করবে ইউজিসি। এবিষয়ে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে না এবং পদাধিকারী হবেন মূলত শিক্ষাবিদগণ, আমলারা নয়। 
অতীতে ইউজিসি-কে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়নি এমন নয়। তা সত্ত্বেও এটি স্বশাসিত সংস্থা হিসাবে কাজ করেছে। এখন উচ্চ শিক্ষার বাজারটি প্রসারিত হওয়ায় কর্পোরেট লবি দাবি জানাচ্ছিল ইউজিসি-কে তুলে দিতে বা তার বাঁধন আলগা করতে। সেই উদ্দেশ্যে ২০১১ সালে তৎকালীন সরকার বিলও আনে। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যের আপত্তিতে তা কার্যকর হয়নি। বর্তমানে ২০১৪ সালে মোদীর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবার পর বেসরকারিকরণের মাত্রা বেড়েছে। সেই লক্ষ্যেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটিতে নানা সংস্কার শুরু হয়ে যায়। যেমন ন্যাক পরিদর্শন ব্যবস্থার সংস্কার, ৬০টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গ্রেডেড অটোনমি দিয়ে ইউজিসি নিয়ন্ত্রণের বাইরে আনা ইত্যাদি। সেই সূত্র ধরেই এলো বর্তমান ইউজিসি তুলে দিয়ে ‘‘হেকি’’।
২০১৮ ‘হেকি’
মূল ৩১টি ধারা নিয়ে খসড়া ‘হেকি’ আইন রচিত হয়েছিল। প্রথমত এর কাছে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে অর্থ প্রদান ব্যবস্থা না রেখে তা সরকারের নিজের হাতে রাখার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘হেকি’ ময়, সরকারী মন্ত্রকের অধীনস্ত করতে চাওয়া হয়েছে। অপরদিকে ‘হেকি’ গঠন ও পরিকল্পনাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে সরকারি মন্ত্রকের বিশেষ করে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ বাড়ে। 
ধারা ৩-এ এর গঠন বিষয়ে বলা হয়েছে। এখানে চেয়ারপার্সন, ভাইস চেয়ারপার্সন ও ১২ জন সদস্য থাকবেন, যাদের কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত করবে। এই ১২ জনের মধ্যে ৩ জন হবেন কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের এবং ব্যবসা সংক্রান্ত উদ্যোগ দপ্তরের সচিববৃন্দ, ২ জন হবেন এনসিটিই এবং এআইসিটিটি নামক নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান এবং অ্যা ক্রিডিটেশন সংস্থাগুলির থেকে ২ জন চেয়ারম্যান থাকবেন। এরা মূলত নিযুক্ত হবেন কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকেরই সুপারিশেই। এছাড়া থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ জন কর্মরত ভাইস চ্যান্সেলার এবং ২ জন কর্মরত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ইউজিসি আইনে মোট ১০ জনের মধ্যে ন্যূনতম ৪ জন কর্মরত অধ্যাপক ছিলেন। ‘হেকি’তে এদের গুরুত্ব লঘু করা হয়েছে। বলা হয়েছে এছাড়া থাকবেন একজন খ্যাতনামা শিল্পপতি। তার সংজ্ঞাই বা কি হবে? কোন যোগ্যতায় হবে? কেনই বা থাকবেন ? ইউজিসি আইনে ১০ এর মধ্যে কমপক্ষে ৬ জন ছিলেন শিক্ষাবিদ। আর এখানে ১২ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন হবেন শিক্ষাবিদ। চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবে একটি সার্চ কাম সিলেকশন কমিটি। কারা থাকবেন এই কমিটিতে ? বলা হয়েছে ক্যাবিনেট সচিব হবে চেয়ারম্যান। আর থাকবেন উচ্চশিক্ষা সচিব এবং তিনজন শিক্ষাবিদ যাদের সরকার মনোনীত করবে। অর্থাৎ সবটাই হবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। পূর্বে ইউজিসি’র চেয়ারম্যান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ছাড়া কোনও সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমলারা হতে পারতেন না। এখন ৩/৬ ধারাতে দুটি শর্ত পূরণ করলে যে কেউ হতে পারবেন। চেয়ারম্যান হতে গেলে স্থায়ী ভারতীয় নাগরিক না হয়ে প্রবাসী ভারতীয় নাগরিক হলেও চলবে।
৪ নং ধারায় বলা হয়েছে সরকার ৯টি কারণে চেয়ারম্যান বা সদস্যদের অপসারণ করতে পারবে। তিনটি কারণ খুবই অগণতান্ত্রিক - ১) কোনও অপরাধের কারণে সরকার যদি মনে করে তার নৈতিক অধঃপতন ঘটেছে, ২) সরকার মনে করছে তিনি তার পদকে কলুষিত করছেন এবং জনস্বার্থ ব্যাহত হচ্ছে, ৩) সরকার মনে করছে তিনি দুর্ব্যবহার করার দোষে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এই সব বিচারের মাপকাঠি কি হবে? আসলে চেয়ারম্যান ও সদস্যরা যাতে নিজেদের পদ ধরে রাখতে সরকারকে সন্তুষ্ট করে চলেন সেটাই উদ্দেশ্য। ১২ নং ধারায় বলা হয়েছে কমিশনের সচিব হবেন একজন কেন্দ্রীয় সকারের যুগ্ম সচিব বা তার উচ্চ পদমর্যাদার অফিসার অথবা একজন শিক্ষাবিদ যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। এখানে মূলত সরকারি আধিকারিকই সচিব করার সুযোগ রাখা হয়েছে। আর তাই ১৪ নং ধারায় বলা হয়েছে কমিশনের নির্দেশগুলি ব্যতিরেকে (যেগুলি চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে হবে) বাকী সমস্ত কাজকর্ম সচিব করবেন। অর্থাৎ সরকার তার মাধ্যমে নানা বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করবে। ইউজিসি আইনে এমন ব্যবস্থা ছিল না। 
১৫ নং ধারাতে কমিশনের কার্যপ্রণালী ও কার্যপদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। কমিশন সারা দেশের উচ্চ শিক্ষায় একটি গুণগত মানদণ্ড বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এর উপধারাতে ১০টি মাপকাঠি বেছে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে পঠন-পাঠন, মূল্যায়ন ও গবেষণায় সমমান বজায় রাখা হবে এবং সেই মতো সারা দেশে অভিন্ন পাঠক্রম রচনা হবে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ হবে এবং মূল্যায়ন হবে।  সেই মূল্যায়ন মানে কোনও প্রতিষ্ঠান পৌঁছাতে না পারলে প্রতিষ্ঠানগুলিকে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ এখানে দেশের ও রাজ্যের বৈচিত্র, শহর এবং আধাশহর ও গ্রামাঞ্চলের পৃথক বৈশিষ্ট্য, অভিজাত বা আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ পরিবার এবং পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থান— এগুলো বিবেচনায় না রেখে, সবাইকে এক বন্ধনীতে আনতে চাওয়া হয়েছে। কার্যত বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশঙ্কার মধ্য রেখে তার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে চাওয়া হয়েছে। পশ্চাৎপদ এলাকায় বা পশ্চাৎপদ শ্রেণি থেকে আসা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার উন্নয়নে আরও আর্থিক বরাদ্দের দায়িত্ব তারা নেবে না, কিন্তু যোগ্যতামান উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত দিয়ে তাদের চাপে রাখা হবে। পূরণ না হলে কোনও আর্থিক সাহায্য ঐ প্রতিষ্ঠানগুলি পাবে না। অর্থাৎ সবাইকে উচ্চশিক্ষায় আসতে হবে কে বলেছে— এটাই কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবনা। সেই লক্ষ্যেই ১৫/৪ উপধারাতে স্বশাসনের নামে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে গ্রেডেড অটোনামি প্রদান, ডিগ্রি প্রদান, ছাত্র ভর্তির শর্তাবলী নির্ধারণ, শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের যোগ্যতামান নির্ধারণ ইত্যাদি তৈরির নিয়মকানুনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কমিশনকে। বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ‘পারফরমেন্স বেসড ইনসেনিটিভাইজেন’-এর নিয়মকানুন কমিশন লাগু করবে। অর্থাৎ সরকারি দায় কমিয়ে বেসরকারি মালিকদের উৎসাহিত করো আর শিক্ষার্থীদের নিজেদের অর্থে পড়ার খরচ চালাও। এইভাবে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবধানগুলিকে ক্রমে ক্রমে কমিয়ে আনতে চাওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে স্নাতক শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের সুয়োগ করে দিতে হবে (১৫/৪/জি)। কি ভাবে সম্ভব? কর্মসংস্থানের সুযোগ নির্ভর করে সরকারের অর্থনীতি ও শিল্পনীতি রূপায়ণের মাধ্যমে। এর দায় তো সরকারেরই।
এই আইন লাগু হবার পর ‘হেকি’ কর্তৃক অনুমোদিত না হলে আর কোন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডিগ্রি, ডিপ্লোমা দিতে পারবে না। এমন কি যা আগে হতে চালু আছে তাদেরকেও তিন বছরের মধ্যে কমিশন নির্ধারিত সমযোগ্যতামানের শর্ত পূরণ করতে হবে। (১৬ নং ধারা) কি ভাবে? সরকারের কি ভূমিকা হবে? শর্তাবলী পূরণ না হলে সেই প্রতিষ্ঠানগুলির জরিমানা করা হবে বা ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হবে অথবা কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়া হবে। এসব না মানলে কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিধিতে মামলা করবে। এবং প্রতিষ্ঠানের পরিচালকমণ্ডলীর সদস্যদের তিন বছর পর্যন্ত জেল হবে। (২৩ নং ধারা)
আরো বিপজ্জনক হলো সরকারি নিয়ন্ত্রণকে আরও মজবুত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল - ‘হেকি’র কাজকর্ম পরিচালনার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া ও কাজের সমন্বয় করার জন্য একটি উপদেষ্টা পর্ষদ থাকবে যার চেয়ারম্যান হবেন স্বয়ং মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী। (২৪ নং ধারা) কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে কমিশনের কোনও বিষয়ে মতপার্থক্য হলে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। (২৫নং ধারা) ‘হেকি’ আইনে থাকবে ওভার রাইডিং এফেক্ট অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে অন্যান্য যে সব আইন ও বিধি লাগু আছে তার সাথে এই আইনের কোনও অসঙ্গতি দেখা দিলে ‘হেকি’ আইনই বলবৎ হবে। (২৬নং ধারা) অতীতের আইনগুলির বেশিরভাগই রচিত হয়েছিল দেশের বৈচিত্র ও বহুত্ববাদী চাহিদা ও প্রয়োজনকে মাথায় রেখে। অনেকগুলি সংসদে বা বিধানসভায় অনুমোদিতও হয়েছে। তথাপি এ বিধান কেন ? 
এসবের পরেও সরকারি নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে মজবুত পেরেকটি হলো ২৯ নং ধারা - দেশের উচ্চ শিক্ষায় সমমান ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধি এবং গুণমানের শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য কমিশন যে সব নিয়ম বিধি রচনা করবে তা দেশের সমস্ত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মেনে চলতে হবে। কিন্তু একটি শর্ত থাকবে। তাহলো কমিশন এই সব নিয়মবিধি রচনা করে তা লাগু করার আগে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন নেবে। এতে কি স্বশাসন আর থাকবে?
২০১৮ সালের বিল নিয়ে এত আলোচনা কেন? কারণ, ২০১৮ সালে সরকার পিছিয়ে এলেও এখন কর্পোরেটদের চাপে আবার তা কার্যকরী করার জন্যই আগামী শীতকালীন অধিবেশনে এই বিল আনতে চলেছে এবং ২০১৮ সালের প্রস্তাবগুলিই ফিরিয়ে আনতে চাইছে। তাই বামপন্থী সহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিকে, শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনগুলিকে সংসদের ভিতরে ও বাইরে ইউজিসি তুলে দিয়ে ‘হেকি’ আইন-২০২৫ প্রণয়নের বিরোধিতা করতে হবে। ইউজিসি বা অন্যান্য নিয়ামক সংস্থার ফাঁকফোকর বন্ধ করে তাদেরকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে ও গণতান্ত্রিক পরিচালন পদ্ধতি ফিরিয়ে এনে শক্তিশালী করার দাবি তুলতে হবে। 
এই বিল এখনই উত্থাপিত না করে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন ও অন্যান্য বিশিষ্টজনদের সাথে আলাপ আলোচনা করা হোক। আমাদের রাজ্য সরকার মুখে বিরোধিতার কথা বললেও কেন্দ্রীয় নীতিকেই মেনে নেবে, যেমন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-এর ক্ষেত্রে করেছে। রাজ্য সরকার তো ঐ পথেরই পথিক। এখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে শর্তপূরণ না করলেও অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, ইচ্ছে মতো ফি নেওয়ার অধিকার দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে উচ্চ শিক্ষা পর্ষদ গঠন করে তার মাথায় বসছেন শিক্ষা মন্ত্রী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকারি হস্তক্ষেপ বাড়ছে। আর মন্ত্রী এর সমর্থনে বলছেন সরকার টাকা দিচ্ছে তাই নাক গলাতেই পারে। ‘হেকি’ আইনের মর্মবস্তুও এটাই। তাই এখন থেকেই প্রতিবাদ ধ্বনিত করতে হবে।
 

Comments :0

Login to leave a comment