মুরালিধরন
ডিসেম্বর ৩ তারিখ, সারা বিশ্ব ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ পালন করবে। ১৯৯২ সালে এই দিবসের সূচনা হওয়ার পর থেকে প্রতি বছরের মতোই এই বছরের অনুষ্ঠানও বেশ কিছু স্থানে শুধু আনুষ্ঠানিকতা, যেমন কয়েকজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্মাননা, সাহায্য সামগ্রী বিতরণের শিবির, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে হয়তো সীমিত থাকবে। এই অনুষ্ঠানগুলি যদিও সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তবুও তারা প্রতিবন্ধকতা এবং তাকে দূর করার ক্ষেত্রে গভীরতর পদ্ধতিগত সমস্যাগুলির সমাধান করার পথ দেখাতে পারে না।
এই প্রেক্ষাপটে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই বছরের থিম – ‘সামাজিক অগ্রগতির জন্য প্রতিবন্ধী-অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা’। এই আহ্বানকে অবশ্যই নিপীড়নমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলার জন্য একটি আমূল পরিবর্তনের আহ্বান হিসাবে দেখা উচিত, যা প্রতিবন্ধীদের সমস্যাগুলো জিইয়ে রাখে এবং সামাজিক অগ্রগতিকে বাধা দেয়।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সংক্রান্ত কনভেনশনে (UNCRPD) গৃহীত ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আইন’ (RPD Act) প্রণয়ন গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও, এটা পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যদিও তারা নিপীড়ন ও বৈষম্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করে, কিন্তু তারা সেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে না, যা প্রতিবন্ধকতা এবং বৈষম্যকে চিরস্থায়ী করে রাখে।
প্রতিবন্ধী মানুষেরা বহুগুণ বঞ্চনার সম্মুখীন হন, যা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যেরই ফল। বৈষম্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সুযোগের অভাব এবং সামাজিক ও জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে এদের বাদ দেওয়ার কারণে তারা তাদের অ-প্রতিবন্ধী সহকর্মীদের তুলনায় বেশি দারিদ্রের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এমনকি পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রকও (MOSPI) স্বীকার করে যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা একাধিক বঞ্চনার শিকার হন। সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায়, তারা উচ্চ হারে দারিদ্র, কম সাক্ষরতা এবং তীব্র বেকারত্বের সম্মুখীন হন– যে বাধাগুলি তাদের সামাজিক বৈষম্যের মুখে বর্ধিত আকারে ফেলে দেয়। MOSPI বলছে, “উপলব্ধ তথ্য থেকে জানা যায় যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বহুগুণ বঞ্চনার শিকার হন। সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায়, তারা বেশি দারিদ্র, কম সাক্ষরতা, বেশি বেকারত্বের শিকার হন, যা তাদের আরও পিছিয়ে দেয়। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে মৌলিক পরিষেবা এবং সামাজিক বর্জনের মাত্রার পার্থক্যও লক্ষণীয়, এবং তা লিঙ্গ, জাতি, গ্রামীণ/শহুরে পটভূমির কারণে আরও বেড়ে যায়।”
যে সমাজে ইতিমধ্যেই শ্রেণি, জাতি এবং ধর্মের ভিত্তিতে জনসংখ্যাকে প্রান্তিক করা হয়, সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সামজিক বৈষম্যের একাধিক রূপের সম্মুখীন হন। উদাহরণস্বরূপ, একজন দলিত প্রতিবন্ধী মহিলা কেবল প্রতিবন্ধকতার শারীরিক ও সামাজিক বাধারই সম্মুখীন হন না, বরং জাতি ও লিঙ্গের পদ্ধতিগত নিপীড়নেরও শিকার হন। অতএব, প্রতিবন্ধকতাকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের বৃহত্তর সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে দেশে ২ কোটি ৬৮ লক্ষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ছিলেন (জনসংখ্যার ২.২১ শতাংশ)। এই সংখ্যা বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুমান করে যে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ বা প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন উল্লেখযোগ্য ভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। জনগণনার পরিসংখ্যান এবং জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার অনুমান– এই দু’টিতেই এটা স্পষ্ট যে, দরিদ্র অঞ্চল এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিবন্ধকতার প্রকোপ বেশি। MOSPI-এর মতে, ভারতের ১৯ কোটি ৩০ লক্ষ পরিবারের মধ্যে ১০ শতাংশ (কম-বেশি) পরিবারে একজন বা তার বেশি প্রতিবন্ধী সদস্য থাকার খবর পাওয়া যায়।
পেনশন, বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, শিক্ষা এবং চলাচলের সুবিধার মতো সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি কেবল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরই নয়, বরং ন্যায়বিচার ও সমতাকে মূল্য দেয় এমন যে কোনও সমাজের জন্য অপরিহার্য। প্রতিবন্ধী-অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিগুলি ব্যাপক সার্বজনীন কর্মসূচির একটি অংশ হওয়া উচিত, যা সর্বাধিক প্রান্তিকদের চাহিদা পূরণ করে, যার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত— ‘কেউ যেন বাদ না পড়ে’।
প্রতিবন্ধী আন্দোলনের উচিত নিজেদের অন্যান্য প্রান্তিক মানুষ, শ্রমিক, কৃষক এবং অন্যান্য সংগ্রামরত মানুষের আন্দোলনের সাথে একাত্ম করা। এটিকে অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম, সামাজিক ও লিঙ্গ ন্যায়বিচারের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। এই সংহতি গড়ে তোলার মাধ্যমেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এমন একটি সমাজের দাবি করতে পারে, যা সম্পদের পুনর্বণ্টন, সম্পদের অধিকার এবং জন পরিকাঠামোর নতুন পরিকল্পনা অগ্রাধিকার দেবে।
একটি শোষণমূলক ব্যবস্থার শিকার প্রতিবন্ধী মানুষেদের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের লড়াইয়ে পরিবর্তনের কারিগর হওয়া উচিত। তাদের নিজেদের সংগঠিত করে, সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং সামগ্রিক সংহতি গড়ে তুলে নিজেদের ক্ষমতায়ন করতে হবে। তাদের বর্জন করে রাখে, এমন কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য এগুলো পূর্বশর্ত।
ডিসেম্বর ৩ তারিখটি কেবল আনুষ্ঠানিক সম্মান বা প্রতীকী দিন হওয়া উচিত নয়। বরং, এই দিনটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার একটি আহ্বান হিসাবে কাজ করুক– যেখানে প্রতিবন্ধীদের ন্যায়বিচার নিয়ে কোনও আপস চলবে না। কেবলমাত্র প্রতীকী দিবস পালন প্রতিবন্ধী মানুষদের দুরবস্থার প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারে না। আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিবর্তনের দিকে এগতে হবে, যা প্রতিবন্ধী-অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করবে, যেখানে সামাজিক অগ্রগতিকে শুধু জিডিপি’র সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং ন্যায়বিচার, সমতা এবং মুক্তির দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হবে।
(মুরালিধরন, ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অব দ্য ডিসঅ্যাবলড-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক)
Comments :0