প্রয়াত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপির ফেসবুক পেজে জানানো হয়েছে সকাল ছয়টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
গতকাল গভীর রাতে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের জনিয়েছিলেন, অত্যন্ত সংকটময় সময় অতিক্রম করছেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সোমবার রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমানসহ খালেদা জিয়ার অন্যান্য আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে যান। তাদের অনেকে ভোর পযর্ন্ত সেখানে ছিলেন।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালের সামনে জড়ো হতে শুরু করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার, মা তৈয়বা মজুমদার। খালেদা জিয়ার বাবা ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে দেশ ভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তাঁর আদি বাড়ি ফেনীতে। তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যায়ন করেন। ১৯৬০ সালে তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা) জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।
১৯৮১ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালে সাধারণ সদস্য হিসাবে বিএনপিতে যোগদান করেন খালেদা জিয়া। তিনি ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে দলের ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর, খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি এরশাদের স্বৈরাচারের অবসান ঘটাতে ১৯৮৩ সালে গঠিত সাত দলীয় জোট গঠনের স্থপতি ছিলেন। তিনি ১৯৮৬ সালের কারচুপির নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। যদিও আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মতো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন শাসনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়। খালেদা জিয়াকে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার আটক করা হয়েছিল।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। ১৯৯৬ সালে বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর খালেদা জিয়া টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পুনরায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রতিশ্রুতির কারণে, তিনি এক মাসের মধ্যে পদত্যাগ করেন। যদিও বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুনের নতুন নির্বাচনে হেরে যায়, দলটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে ১১৬টি আসন পায় সেই নির্বাচনে।
১৯৯৯ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে চারদলীয় জোট গঠন করে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পথে নামে। খালেদা জিয়া দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন। ২০০৬ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্বাসনে পাঠানোর একাধিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুর্নীতির অভিযোগে তৎকালীন সেনা শাসিত সরকার গ্রেপ্তার করে। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে খালেদা জিয়া বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় তাকে আটক করা হয়। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় তাকে শর্ত সাপেক্ষে গৃহবন্দি থাকার অনুমতি দেয় সরকার। কারাগারে থাকার সময়ে তিনি নানা রোগে আক্রান্ত হয়। বাড়ি ফিরলেও তিনি আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়।
Comments :0