Editorial

ভা‍‌লো লক্ষণ

সম্পাদকীয় বিভাগ

চীন সহ প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং বিরোধ থাকলে তার সমাধান কেমনভাবে হবে সে সম্পর্কে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বর্তমানে সিপিআই(এম)’র সুস্পষ্ট মতামত বা অবস্থান আছে। সেটা লুকোছাপা কোনও বিষয় নয়, একেবারে সকলের গোচরে। সিপিআই(এম) মনে করে যে কোনও দেশেরই উন্নতি ও অগ্রগতির অন্যতম সোপান প্রতিবেশী দে‍‌শের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিরোধ, সংঘাত ও শত্রুতার সম্পর্ক থাকলে তাতে অনেক সময়, শক্তি, অর্থ অপচয় হয়ে যায়। তাই সব সময় সর্বতোভাবে চেষ্টা চালাতে হয় বিরোধ-বিতর্ক যাই থাকুক তাকে কমিয়ে ফেলার। তেমনি এমন বিরোধ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধের মাধ্যমে সমান করা যায় না। যুদ্ধ সম্পর্ক আরও খারাপ করে, নতুন বিরোধের জন্ম দেয়।
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধ এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কথা বলেছিল। তাতেই প্রায় সমস্ত কমিউনিস্ট নেতাদের দেশদ্রোহী, চীনের দালাল বলে জেলে পুরে দেয় কংগ্রেস সরকার। হিন্দুত্ববাদী অতি দক্ষিণপন্থী আরএসএস-বিজেপি’র বিবেচনাতেই কমিউনিস্টরা দেশপ্রেমিক নয়, ‘বিদেশি’ তত্ত্ব নিয়ে কথা বলে। মোদী জমানাতে তো সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা করলেই দেশদ্রোহী বলে দেওয়া হয়। এমন কি জেলেও পুরে দেওয়া হয়। কিন্তু সত্য এটাই এবং ইতিহাস সেই শিক্ষাই দেয় বিশ্বের বেশিরভাগ বিরোধের মীমাংসা শেষ পর্যন্ত আলোচনার টেবিলেই হয়ে থাকে। তাই অযথা সম্পদ, অর্থ, জীবন ধ্বংস করা কেন। প্রতিটি যুদ্ধ মানবতার বিরুদ্ধে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে।
গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কার্যত শত্রুতার পর্যায়ে চলে গেছে। তার পেছনে সঙ্গত কারণ অবশ্যই আছে। তদসত্ত্বেও চেষ্টা করে যেতে হয় সম্পর্ক ভালো রাখার, সমস্যা মিটিয়ে ফেলার। বাস্তবে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে দু’দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। চীনের ভেতর দিয়ে ভারতীয় মানসসরোবর যাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। চীনের পণ্য ভারতে বিপণনে কড়াকড়ি হয়। চীনের পুঁজি ভারতে বিনিয়োগে কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ভারতে কোন সংস্থায় চীনে সংস্থার শেয়ার অর্ধেকের নিচে রাখতে হবে। ভারতে নথিভুক্ত সংস্থায় চীনের সংস্থার নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। অর্থাৎ চীনের পুঁজি, চীনের পণ্য যতটা সম্ভব ভারত দূরে রাখার আয়োজন করেছে মোদী সরকার। ভারতে চীনের সংস্থাগুলির দপ্তরে বারবার তল্লাশী অভিযান চালানো হয়। চীনের ইঞ্জিনিয়ারদের ভারতে ভিসা দেওয়া বন্ধ করা হয়।
এর ফলে চীনের কতটা সমস্যা বা ক্ষতি হয়েছে জানা না গেলেও ভারতের অর্থনীতির যে বিস্তর ক্ষতি হয়েছে সেটা ভারতের কর্পোরেট মহলের তরফে বারবার বলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নীতি আয়োগের সিইও’ও বলতে বাধ্য হয়েছেন অর্থনীতির স্বার্থে চীনের পণ্য ও পুঁজির উপর কড়াকড়ি শিথিল করা জরুরি। ভারতের অর্থনীতি সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছে কয়েক মাস আগে চীন বিরল খনিজ রপ্তানির উপর নিয়ন্ত্রণ চালু করার ফলে। ট্রাম্পের শুল্ক হামলার পালটা হিসেবে চীন এমন পদক্ষেপ নিলেও তার ধাক্কায় ভারতে গাড়ি, ইলেট্রনিক্স, সৌর বিদ্যুৎ সহ বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে উৎপাদন থমকে যাচ্ছে। কারণ প্রয়োজনীয় বিরল খনিজ চীন থে‍‌কে আমদানি করা যাচ্ছে না। এদিকে ট্রাম্পের আক্রমণের শিকার ভারত। ট্রাম্পের ছক অনুযায়ী রাশিয়াকে ধাক্কা দিতে ভারত ব্যবহৃত হচ্ছে দাবার বোড়ের মতো। এই অবস্থায় অর্থনীতিকে ধরে রাখতে ভারতের উচিত আরও বেশি বেশি চীন, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা। ভারতের ভেতর থেকেই এই মত দ্রুত জোরালো হচ্ছে। বস্তুত কমিউনিস্টরাও এমনটাই চায়। বস্তুত চীনের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক ও বোঝাপড়া শুধু সাম্রাজ্যবাদীদের দুর্বল করবে না, বিশ্বের সামনে নতুন এক সম্ভাবনাকে বাস্তব করে তুলতে পারে।

Comments :0

Login to leave a comment