শুরুতে যেটা ছিল চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ। কালক্রমে সেটা যে ভারত করে ফেলবে নরেন্দ্র মোদীরা সেটা ভাবতেই পারেননি। হিন্দুত্ববাদী অতি দক্ষিণপন্থী শাসকদের বিবেচনায় ছিল চীন আমেরিকা ও ভারতের সাধারণ শত্রু। তাই চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধ তথা শুল্ক আগ্রাসন যত তীব্র হচ্ছিল ততই ভারত মনে মনে খুশি হয়েছিল। আমেরিকার মতোই ভারতের বর্তমান শাসকদের বাসনা চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামরিক স্ট্র্যাটেজিক প্রভাব কোনও অবস্থাতেই বাড়তে না দেওয়া। আমেরিকার দুঃস্বপ্ন চীন যেভাবে দ্রুত এগচ্ছে তাতে অচিরেই আমেরিকাকে কোণঠাসা করে ফেলবে। তাই এখনই চীনের গতিরোধ দরকার। আর ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকরা ভাবছে আমেরিকার নেতৃত্বে চীনকে যদি কাবু করা যায় তাহলে আমেরিকার পর সবদিক থেকে দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠবে ভারত। তাই ভারত আমেরিকার সঙ্গী হয়ে বিশ্বশক্তির ভারসাম্যের মধ্যে অবস্থান করতে চায়। মোদী-শাহরা মনে এমনটাই ভেবে রেখেছেন চিন্তা ভাবনায় ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। দু’জনেই একই নৌকার যাত্রী। তাই দু’জনেই দু’জনকে প্রাণের বন্ধু বলে জাহির করেন। দু’জনেই দু’জনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মোদী আমেরিকা সফরে গিয়ে ট্রাম্পের নির্বাচনের প্রচারে অংশ নিতেও দ্বিধা করেননি। স্লোগান দিয়েছেন ‘অব কি বার ট্রাম্প সরকার।’
এমন বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়ার ফলে ট্রাম্পের উপর মোদীদের অগাধ বিশ্বাস গড়ে ওঠে। এশিয়া প্রশান্ত সাগরীয় অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, সামরিক ও স্ট্রাটেজিক জোট গড়ার লক্ষ্যে বেশ কয়েক বছর আগে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে কোয়াড গঠন করেছিল আমেরিকা এবং সেই জোটে ভারতকে সামনে রাখার চেষ্টা করেছিল। তাতে চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস অনেকটা বেড়ে যায় মোদীদের। এই বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা থেকেই গলাগলি ও কোলাকুলির বহর বাড়ে। ফ্যাসিস্ত চরিত্রের হিন্দুত্ববাদীরা বোঝেনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কোনও স্থায়ী শত্রু থাকে না। তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে যখন থাকে যতটা প্রয়োজন ততোটা ব্যবহার করবে। তারপর ছুঁড়ে ফেলতে দু’বার ভাববে না।
শুল্ক যুদ্ধের আবহে মোদীরা প্রথম দিকে এমনটাই ভেবেছিলেন ট্রাম্প যেভাবে ময়দানে নেমেছেন তাতে অচিরেই চীনের হাল খারাপ হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের অপসারণ মানে সেখানে ভারতের জায়গা পাকা। এমন ভাবনা থেকে শুল্ক যুদ্ধের গোড়ার দিকে ট্রাম্প যখন লাগাতার চীনের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছেন এবং অন্যান্য সব দেশের পণ্যেও শুল্ক চাপানোর কথা বলছিলেন, এমন কি ভারতের বিরুদ্ধে বার বার শুল্ক বাড়ানোর হুমকি দিচ্ছিলেন তখনও মোদীরা ভেবেছিলেন হম্বিতম্বি করলেও শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প বন্ধু মোদীর দেশকে ছাড় দেবেন। গত মার্চ মাসে বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর ট্রাম্পের শুল্কনীতির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন এটা বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত। এরফলে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক আরও দৃঢ় ও ঘনিষ্ট হবে। প্রসঙ্গত, তখনও চীন ছাড়া অন্য কোনও দেশের বিরুদ্ধে উচ্চ শুল্ক ট্রাম্প ঘোষণা করেননি। মোদী-জয়শঙ্করদের বিশ্বাস ছিল ট্রাম্পের শুল্ক হামলা চীন ছাড়া কানাডা, মেক্সিকো ও ইউরোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ভারত ছাড় পাবে। ট্রাম্পের সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য এটাও ভেবেছেন রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কিনেও ট্রাম্পকে ম্যানেজ করবেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব হিসাব তালগোল পাকিয়ে গেছে। চীনের বিরুদ্ধে প্রথমে ১৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানো হলেও দু’দেশের মধ্যে আলোচনার পর তা এক ধাক্কায় ৩০ শতাংশে নেমে গেছে। অথচ ভারতের উপর প্রথমে ২৬ শতাংশ শুল্ক থাকলেও পরে সেটা ৫০ শতাংশে ঠেকেছে। বর্তমানে ব্রাজিল ছাড়া যে কোনও দেশের থেকে বেশি শুল্ক ভারতের উপর। মোদীর বন্ধুরা সম্ভবত এমনই হয়ে থাকে।
Editorial
মোদীর বন্ধু ট্রাম্প

×
Comments :0