Post Editorial

যদি সবার জন্য সমান খাবার হতো!

সম্পাদকীয় বিভাগ

এই শব্দটা মাথায় এলেই ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে সর্বপ্রথম যে জিনিসটা চোখের সামনে ভাসে সেটা হলো খাবার। এই একমাস কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট, সওকাত আলি স্ট্রিট থেকে শুরু করে নিউ মার্কেট কিংবা জলপাইগুড়ির নবাব পাড়া থেকে শিলিগুড়ির হাশমি চক বা বর্ধমানের বড় বাজার। আরও বড় করে দেখলে পুরানো দিল্লির জামা মসজিদ সংলগ্ন অঞ্চল থেকে নিজামউদ্দিন মাজার চত্বর কিংবা লক্ষ্ণৌয়ের বিখ্যাত ফুড স্ট্রিট এই সব রাস্তার বাহারি খাওয়ারের স্টল। আর তার বাইরে আছে না খেতে পাওয়া, শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া, বেকারত্বে জর্জরিত একটা দেশ। আছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তার সাথেই আছে আমাদের এই বাংলা।
কলকাতা সংলগ্ন অঞ্চলে বন্ধুবান্ধব বা পরিবার নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন খাবারের স্বাদগ্রহণের খুবই ভালো ঠিকানা মধ্যে কলকাতার নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন জাকারিয়া স্ট্রিট। অবর্ণনীয় সৌন্দর্য, আলোর রোশনাই, জনকোলাহল, খাবারের গন্ধ– সবমিলিয়ে মায়াবী এক পরিবেশ। জাকারিয়া স্ট্রিট, সওকাত আলি স্ট্রিট নিয়ে লিখতে বসলে একটা মহাকাব্য লেখা যায়৷
কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি এগুলো রমজান উপলক্ষে খাদ্য অভিযানের শহুরে অঙ্গ মাত্র। বাস্তবে তা আসলে রঙচঙে মোড়কে শহরকেন্দ্রিক ‘ভিন্ন রমজান’। কাবাব-পরোটা-চাপ-ভুনার বাইরে আছে এক আস্ত গ্রামবাংলা। সেই গ্রাম বাংলার সাধারণ চিত্রটাও তুলে ধরা দরকার। 
ফেসবুকে বিভিন্ন ছবি, খাদ্যপ্রেমিকদের ভিডিও কিংবা খবরের কাগজে শহরকেন্দ্রিক নামমাত্র লেখালিখিতে বড় অংশের মানুষেরই ধারণা রমজান বোধহয় জাকারিয়া স্ট্রিট, হালিম-কুলফি সর্বস্ব। সাথে সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে দুবাই, কাতার, আরব আমিরশাহির রঙচঙে উদ্‌যাপনের যে চিত্র আমাদের অবচেতন মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তা একেবারেই সত্যি নয়। 
ভারতবর্ষের মতো দেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে রমজানের খাদ্য উপকরণ ভিন্ন। সেখানে বহুদূর পর্যন্ত হালিম-কাবাবের গল্প নেই। প্লেটের এককোণে নুন ছড়ানো কাঁচা ছোলা। সাথে সেঁটে আছে আদাকুচি, এদের পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে একজোড়া শশার ফালি। খেজুর একমাত্র ফল যে গরিবের অবস্থা অল্প হলেও বোঝে। রোলকল করতে গিয়ে দেখা গেল, তরমুজ অনুপস্থিত। কারণ আজ মালিকের বাজেটে কুলায়নি। চারদানা আঙুর। কলার টুকরো। পাশে একটা বাটিতে চিঁড়ে-মুড়কি। আপেল আর মুসাম্বি লেবুর স্থান প্লেটে হয়ে উঠতে পারেনি। 
গরিব মানুষের সংসারে এমন অনেক ছোট ছোট উপাদান থাকে, সেটা দিয়েই নির্ধারিত হয় সেদিন সংশ্লিষ্ট ফলটি ইফতারে থাকবে কি না। 
সারাদিন নির্জলা উপবাস। ইফতারে জলের অভাব মেটায় শরবত। উচ্চবিত্ত পরিবারে রুআফজা, বিভিন্ন সেক আর ফলের রসের ছোঁয়া লাগলেও, গরিব মানুষ লেবুর শরবতের উপরই আস্থা রাখেন। যদিও এখন লেবুর পিস দশটাকা তাই সেটাও প্রতিদিন কিনে ওঠা সম্ভব না। মজাটা এখানেই! ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে সারাদিন না খেয়ে থাকবেন যারা, সন্ধ্যায় তাদের সবার খাবার সুযোগ সমান না। কারোর প্রচুর আছে আর কারুর কিছু নেই। কিন্তু এই কিছু না থাকার জন্য লড়াই করার জেদ থাকার কথা ছিলো দিন শেষে, কিন্তু সেটা থাকে কি?
এ গেল রমজানের ইফতারের প্রাথমিক পর্ব। ইফতার শেষ করে ধর্মপ্রাণ মানুষ নামাজ পাঠ করেন। তারপর শুরু হয় ইফতারের দ্বিতীয় পর্ব। সাধারণত ঘুগনি-মুড়ির সাথে ঘরে বানানো তেলেভাজা, বেগুনি, পেঁয়াজি। 
এখন আপনি নিউ মার্কেট কিংবা খিদিরপুর ফ্যান্সি মার্কেটে গিয়ে দু’বাটি হালিম, সাথে পরোটা আর ভুনা, কিংবা মেটিয়াবুরুজ মোড়ে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস ম্যাঙ্গো লস্যি সাঁটিয়ে দিলেন সেটা ভিন্ন দিক। তবে এটা কিন্তু রমজানে খেটে খাওয়া মানুষদের ইফতারের উপকরণ নয়। 
রমজানের উপবাস ক্ষুধায় পীড়িত মানুষের অবস্থা বুঝতে শেখায়। যদিও খুব কমজনই হয়ত সেইভাবে রমজানের মাহাত্ম্য খোঁজার চেষ্টা করেন। আড়ম্বরপূর্ণ ইফতারের উলটোদিকে আছে সারাদিনের খাটাখাটুনির পর গরিব মানুষের শুধু ছোলা-খেজুর-শরবতের অতি সাদামাটা ইফতার। 
ঈদের অপেক্ষা করতে থাকেন এদেশে আজও কাশ্মীর উপত্যকার বহু মানুষ বুকে উৎকন্ঠা আর ভয় নিয়ে। প্যালেস্তাইনের ইফতার পার্টি চলে বাঙ্কারে। মাথার উপর বোমারু বিমানের হুঁশিয়ারি!
আসলে ঝা চকচকে শহরের বাইরে আছে একটা দেশ, একটা পৃথিবী। পুঁজি,সাম্রাজ্যবাদ সে পৃথিবীটাকে নিজের মতো করে চালাতে চায়। তাই কারো প্লেট উপচে পরে,কারো প্লেট থাকে ফাঁকা। আর এই বৈষম্যর বিরূদ্ধে আছি আমরাও। প্লেটে সবার সমান খাবার হোক। 
রমজানের ধর্মীয় আবহের মধ্যেই এই বৈষম্য প্রকট হয়ে থাকে। যেমন সব ধর্মের আবহেই থাকে। কিন্তু ধর্ম যদি হয় লড়াইতে থাকা, ধর্ম যদি হয় সবার ভরা পেট, ধর্ম যদি হয় সবার শিক্ষা সবার কাজ তবে সে ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার কারণ থাকে।  
তাই রমজানের এই মাসেও সকলের পেট ভরা খাবারের জন্য লড়াই কিন্তু চলবে।

Comments :0

Login to leave a comment