প্রবন্ধ — মুক্তধারা, বর্ষ ৩
সফলতার সংজ্ঞা কি বদলেছে?
অরিজিৎ মিত্র সফলতার সংজ্ঞা কি বদলেছে?
ভূমিকা:
মানব সভ্যতার ধারাবাহিক অভিযাত্রায় ‘সফলতা’ শব্দটি যুগে যুগে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও অভিপ্রায় ধারণ করে এসেছে। প্রাচীন যুগে সফলতা মানে ছিল জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ, নিরাপত্তা ও বংশপরম্পরার নিশ্চিতকরণ; আধুনিককালে এই ধারণা এক বহুবর্ণ, বহুস্তরীয় এবং অনিশ্চিত প্রতিস্বরে রূপান্তরিত হয়েছে। একুশ শতকের প্রযুক্তিনির্ভর, প্রতিযোগিতামূলক ও বহুমাত্রিক সমাজে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে—সফলতার সংজ্ঞা কি আগের মতই রয়ে গেছে, নাকি এটি এক গভীর রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে চলেছে?
পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট:
সফলতা এক সময়ে ছিল প্রথাগত সামাজিক পরিমাপে নির্ধারিত—উচ্চ শিক্ষালাভ, প্রতিষ্ঠিত চাকরি, আর্থিক স্বচ্ছলতা, ও সামাজিক মর্যাদা। এটি ছিল এক ধ্রুবক অভীপ্সা, যেখানে ব্যর্থতা মানেই ছিল জীবনের অপূর্ণতা। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেই একরৈখিক মাপকাঠি চূর্ণ হয়েছে। আত্মসচেতনতা, মানসিক স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতা, সৃজনশীল স্বাধীনতা ইত্যাদি ধীরে ধীরে সফলতার পরিমাপক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।
আধুনিক বাস্তবতায় সফলতার রূপান্তর:
আজকের সমাজে সফলতার সংজ্ঞা এক একজন মানুষের কাছে এক একটি স্বতন্ত্র দার্শনিক সত্তা। কেউ মনে করেন, পছন্দের পেশায় কাজ করাটাই সফলতা; কেউ আবার মনে করেন, অন্তরাত্মার শান্তি বা মানসিক প্রশান্তি অর্জন করাই প্রকৃত সার্থকতা। প্রযুক্তির প্রসার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থান, এবং বিশ্বায়নের ফলে ‘সফল’ হওয়ার যে নতুন এক ভ্রান্ত ছায়া তৈরি হয়েছে, তা কখনো কখনো অধিক হতাশারও জন্ম দিচ্ছে।
ফলে, আজ সফলতা শুধু বাহ্যিক অর্জনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে এক অন্তর্গত মানদণ্ড—‘নিজেকে খুঁজে পাওয়া’, ‘নিজের সঙ্গে আপোস না করা’, কিংবা ‘সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা’ও সফলতার সংজ্ঞায় পরিগণিত হচ্ছে।
সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা:
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা, যদিও অনেকাংশে এখনও সংখ্যার ভিত্তিতে মূল্যায়নে বিশ্বাসী, ধীরে ধীরে এই পরিবর্তিত বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে। এখন শিক্ষার্থীদের শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় নয়, বরং জীবনের বহুমাত্রিকতা উপলব্ধির দক্ষতাও শেখানো হচ্ছে। স্কুল-কলেজগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য, সৃজনশীলতা, সমন্বয়মূলক দক্ষতা ও নেতৃত্ব গুণাবলীকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই পরিবর্তনই প্রমাণ করে, সফলতার সংজ্ঞা শুধুই উচ্চ নম্বর বা চাকরির গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়।
সফলতার সংজ্ঞা অবশ্যই বদলেছে। আজ সফলতা একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আত্মমর্যাদাশীল ও অর্থবহ। এটি এখন আর শুধু বাহ্যিক অর্জনের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এক অন্তরঙ্গ আত্মজিজ্ঞাসার ফল। সফলতা এখন নিজেকে জানার, নিজের পথকে শ্রদ্ধা করার, এবং সমাজে এক ইতিবাচক প্রভাব রাখার রূপান্তরিত ব্যাখ্যা। তাই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে সফলতার নির্যাস আর একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে আটকানো সম্ভব নয়—এটি এক বহতা স্রোতের মতো, যা প্রতিনিয়ত রূপ নিচ্ছে, বদলাচ্ছে, এবং প্রসারিত হচ্ছে।
"সফলতা মানে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া নয়, বরং নিজেকে খুঁজে পাওয়া—এবং তাতেই নিহিত থাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ পরিপূর্ণতা।"
নতুনবন্ধু
নবম শ্রেণী, কল্যাননগর বিদ্যাপীঠ খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা, কল্যাননগর, খড়দহ ।
Comments :0