Post Editorial

ইরানে এই আক্রমণ কেন?

উত্তর সম্পাদকীয়​

দেবাশিস চক্রবর্তী 

 

ইজরায়েল যে ইরানে সামরিক আক্রমণ চালাবে, তা কি একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল? মোটেই না। অনেক দিনের প্রস্তুতি, অনেকগুলি ছোট আক্রমণের পরে পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধের এই নতুন মাত্রার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের গণহত্যার মধ্যে। 
২০২৩-র অক্টোবর থেকে গাজায় ইজরায়েলের একটানা আক্রমণ চলছে। হাজার হাজার বার বিমান হানা হয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ হয়েছে, পরে স্থলবাহিনী ঢুকেছে। অন্তত ৫৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, প্রায় ২ লক্ষ মানুষ আহত হয়েছেন। গাজায় অক্ষত কাঠামো বলে কিছু নেই। যখন এই আক্রমণ শুরু হয়, তখন যুক্তি ছিল ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের ভূখণ্ডে ঢুকে হামাসের আক্রমণ। তখন এই পৃথিবীকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছিল ২০০২, ২০০৪, ২০০৮, ২০১২-তে গাজায় ইজরায়েলের একতরফা সামরিক আক্রমণের ইতিহাস; যখন হামাসের ইজরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশের কোনও ঘটনাই ছিল না। হামাস যে নয়, ইজরায়েলের লক্ষ্যবস্তু যে সকল প্যালেস্তিনীয়, যে শিশু সবেমাত্র পৃথিবীর আলো দেখেছে, এমনকি যে শিশু এখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি, তারাও, তা যথেষ্ট স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন ইজরায়েলের একের পর এক শীর্ষ নেতা। গাজায় বোমারু বিমানের সঙ্গেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে অনাহারকে— কোনও সাহায্য কেউ পাঠাতে পারবে না। স্টারভেশন ওয়ার। চোখ যদি অন্যদিকে সরে না থাকে তাহলে লক্ষ্য করা যাবে গত একমাস ধরে ইজরায়েলের আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু সাহায্য নিতে দাঁড়ানো শিবিরের সামনে মানুষের সারি। প্রত্যেক দিন শুধু সাহায্য শিবিরেই নিহত হচ্ছেন ৬০ থেকে ১০০ জন করে মানুষ। গাজা ছাড়িয়ে এক সময়ে এই আক্রমণ পৌঁছেছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, জেনিনে। গাজায় কোনও প্যালেস্তিনীয় বসতি থাকবে না, এই লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলের বেআইনি বসতি শিবিরের বিস্তার। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্যালেস্তিনীয়দের ঘরবাড়ি। হামাসের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ইসমাইল হানিয়ে, ইয়াহিয়া শিনওয়ার নিহত হয়েছেন। হামাসের বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তবে এদিন পর্যন্ত হামাস বা সাধারণভাবে প্যালেস্তিনীয় প্রতিরোধ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। রাষ্ট্রসঙ্ঘের অজস্র বিবৃতি, সংঘর্ষবিরতির জন্য কৃত্রিম বৈঠকের পরেও এই গণহত্যা প্রায় অবাধে চলেছে। 
প্যালেস্তাইনে এই গণহত্যার সময়েই পালটা প্রতিরোধে নেমেছিল লেবানন, আরও স্পষ্ট করে বললে সেখানকার হেজবুল্লাহ। দক্ষিণ ইজরায়েলে তারা ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল ইজরায়েলী বাহিনীকে কিছু মাত্রায় ব্যস্ত রাখার জন্য। শেষ পর্যন্ত ইজরায়েল বিপুল মাত্রায় লেবানন আক্রমণ করে, হেজবুল্লাহের শীর্ষ নেতা হাসান নাসারাল্লাকে হত্যা করতেও সমর্থ হয়। 
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো সিরিয়া। সেখানে ‘শাসন পরিবর্তন’ বা ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর জন্য ২০১১ থেকে চেষ্টা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক এবং ইজরায়েল। বাসার আল আসাদের সরকারকে হটানোর জন্য তথাকথিত গৃহযুদ্ধ তৈরি করা হয়েছে। এমন ‘গৃহযুদ্ধ’ যেখানে অন্য দেশ থেকে পাঠানো হয়েছে শয়ে শয়ে সন্ত্রাসবাদী। উত্তর আফ্রিকা, আফগানিস্তান, চেচনিয়া থেকে নিয়ে আসা হয়েছে প্রাক্তন আল কায়েদা বা অন্য সন্ত্রাসবাদীদের। জাবাত আল নুসরা, আইসিসের পাশে মার্কিন সমর্থিত সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট, ফ্রি সিরিয়ান আর্মির বাহিনীকে ঢেলে অস্ত্র দিয়েছে আমেরিকা, তুরস্ক। তুরস্ক সীমান্ত দিয়ে তারা সিরিয়ায় ঢুকেছে। আল কায়েদা থেকে ইরাকে আইসিস হয়ে নুসরা ফ্রন্ট, তারপরে হায়াত তাহরির আল-শাম তৈরি করা নেতা আহমেদ হুসেইন আল-শারা শেষ পর্যন্ত ২০২৪-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে দ্রুত দামাস্কাস দখল করতে সমর্থ হন। তাঁর এই অভিযানে মার্কিন মদত তো ছিলোই, ইজরায়েলের সেনাবাহিনী বোমারু বিমান পাঠিয়ে সাহায্য করেছিল। আল-শারা এখন সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি। আসাদ দেশান্তরী, ইজরায়েলের বহুদিনের বৈরী সিরিয়া এখন ইজরায়েলে-মার্কিন অক্ষের বন্ধু। 
ইজরায়েল আরও এক ধাপ এগিয়েছে। এবার ইরান। ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমী দেশগুলির অভিযোগ ছিল, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে। তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, যার অন্যতম হলো তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করতে পারবে না। ইরান একটানা বলে এসেছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, কোনও অস্ত্র তৈরির অভিপ্রায় তাদের নেই। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা নজরদারি দল পাঠিয়েছে একাধিক বার। তারা বলেছে, অস্ত্র তৈরি করছে এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমী দেশগুলি, চীন, রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে একটি চুক্তি হয়। লক্ষণীয়, ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম বার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সময়ে এই আলোচনা থেকে তাঁর দেশকে সরিয়ে নেন। আবার এই ট্রাম্পই নতুন করে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। যেদিন ইরান-মার্কিন আলোচনা শুরুর কথা তার দু’দিন আগেই ইজরায়েল ইরান আক্রমণ করল। ইরানের পরমাণু পরীক্ষা কেন্দ্রগুলিতে আক্রমণ হলো, এমনকি শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করা হলো। কেউই এই অভিযোগ করেনি, এমনকি ইজরায়েলও না যে ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। এ বছরের মার্চ মাসে মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা অধিকর্তা তুলসী গাবার্ড নিজেই বলেন, ইরান কোনও পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না। ২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসনের আগে মার্কিন প্রশাসন এবং তার পশ্চিমী মিত্ররা এই মর্মে আওয়াজ তুলেছিল যে ইরাকের হাতে ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ রয়েছে। এই অজুহাত সামনে রেখেই ইরাকে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় ওই অভিযোগ ভুয়ো এবং পরিকল্পিতভাবে সেই অভিযোগ তৈরি করা হয়েছিল। এখন ইরানের বিরুদ্ধে সেই অভিযোগও তোলা হচ্ছে না, ‘পরমাণু কর্মসূচি’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইরানই কিন্তু কয়েক দশক ধরে পরমাণু অস্ত্র মুক্ত মধ্য প্রাচ্য এলাকা গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে চলেছে। ইজরায়েলকে বাঁচাতে এই প্রস্তাব নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও পশ্চিমী দেশগুলি কোনও তৎপরতা দেখায় না। কঠিন বাস্তব হলো মধ্য প্রাচ্যে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে একমাত্র ইজরায়েলের হাতে। অথচ ইজরায়েল স্বীকৃত পরমাণু শক্তিধর দেশ নয়, কোনও আন্তর্জাতিক বিধির আওতায় নেই।  
ইরানের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ কেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার পশ্চিমী মিত্র, ইজরায়েলের সামরিক তত্ত্ব হলো ইরান, সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্তাইন মিলে একটি ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ রয়েছে। প্রতিরোধ কাকে? পশ্চিম এশিয়ায় ইজরায়েলের একচেটিয়া দখলদারি, মার্কিন সামরিক ছক এবং তথাকথিত মার্কিন পছন্দের ‘বৃহত্তর মধ্য প্রাচ্য’ মানচিত্রের প্রতিরোধ। অনুগত আরব দেশগুলি এই প্রতিরোধে শামিল না। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানের অস্তিত্বই ইজরায়েলের অস্তিত্বের পক্ষে বিপদ। ঠিক যেভাবে প্যালেস্তাইন ধ্বংসের কারণ হিসাবে একই যুক্তি খাড়া করা হয়েছিল। 
কিন্তু এত কথা বোঝার দরকার পড়ে না যদি কেউ ১২ জুন মার্কিন রাষ্ট্রপতির নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশাল-এ পোস্ট করা বিবৃতিটি পড়ে দেখেন। ট্রাম্প লিখছেন, আমি ইরানকে বারবার সমঝোতা করে নিতে বলেছি। কিন্তু তা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। ইজরায়েলের কাছে তার অনেক কিছুই রয়েছে এবং আরও আসছে। তারা জানে কীভাবে তা ব্যবহার করতে হয়। কিছু কট্টরপন্থী ইরানের লোক সাহস দেখিয়েছিলেন কিন্তু তাঁরা জানতেন না কী হতে চলেছে, তাঁরা সকলেই এখন মৃত। আরও বড় আক্রমণ হতে চলেছে, এককালের ইরানী সাম্রাজ্য মুছে যাবার আগে এখনই সমঝোতা করে নিন। 
ইজরায়েলকে যে মার্কিনীরা অস্ত্র সরবরাহ করে, তা দুনিয়ায় সকলেই জানে। মার্কিন অস্ত্রেই ইজরায়েলের দাপট। ট্রাম্প একবার বলছেন, ইরানে হানার আগে তিনি কিছু জানতেন না। আরেকবার কথা পালটে বলছেন, জানতাম কিন্তু আমেরিকা যুক্ত হয়নি। এমনকি ভয়ঙ্করতম অস্ত্র প্রয়োগের ইঙ্গিতও দিচ্ছেন। ট্রাম্পকে অনেকেই বলেন, তাঁর মতিস্থির নেই। লগ্নিপুঁজির জন্য তিনি অনেক কিছুই করতে পারেন। 
শুধু মধ্য প্রাচ্যেই আমেরিকার ঘোষিত ১৯টি স্থায়ী ঘাঁটি রয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। ভূমধ্যসাগরে মার্কিন রণতরীর বহর রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ইজরায়েল নিজেই। এই দুর্বৃত্ত দেশটি আসলে আমেরিকার কাঠপুতুল। গাজায় আক্রমণের সময়েও বারংবার দেখা গেছে তদানীন্তন মার্কিন বিদেশ সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব তেল আভিভে গিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে ওয়াশিংটন। কোলের ছেলে ইজরায়েলকে সুরক্ষা দেবার জন্য যাবতীয় সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করে আমেরিকা। ইরানে সামরিক আক্রমণ মার্কিন-ইজরায়েল যৌথ রণনীতিরই ফসল। 
ইরানে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মানবাধিকারের পরিধিতে প্রশ্ন তোলার ন্যায়সঙ্গত কারণ রয়েছে। কিন্তু ইরানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন তো নেই। ইরানের শাসকদের বিরুদ্ধে টানা লড়াইয়ে থাকা বামপন্থী তুদে পার্টি তাদের বিবৃতিতে ইজরায়েলের এই আক্রমণকে সাম্রাজ্যবাদের মদতে জায়নবাদী আক্রমণ বলে চিহ্নিত করেছে। দেশের ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বাত্মক প্রতিরোধের ডাকও দিয়েছে। 
ইজরায়েল যেভাবে গাজায় বর্বরতা চালাতে পেরেছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে শুরু করে প্রায় কারোরই প্রকৃত বাধার মুখে তাদের পড়তে হয়নি, তা তাদের সীমাহীন দুঃসাহস জুগিয়েছে। কিন্তু এখন তাল কেটেছে। ইরানের প্রত্যাঘাতের মুখে তাদের পড়তে হবে, তা ইজরায়েলের নীতি নির্ধারকরা ভেবে উঠতে পারেননি। ইজরায়েলে অনেক শহরেই ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়েছে। বাঙ্কারে জীবন কাটছে ইজরায়েলী নাগরিকদের। ইজরায়েলে সেন্সরশিপ চালু হয়ে গেছে, সংবাদমাধ্যমে ইজরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির কথা উচ্চারণ করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 
এই সঙ্কটকালে ভারত সরকার বিপজ্জনক অবস্থান নিয়েছে। গাজায় সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাবের পক্ষে ভোট না দিয়ে মোদী সরকার ইজরায়েলের দিকে ঝুঁকেছিল। এখন সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার বৈঠকে ইজরায়েলের আক্রমণকে নিন্দা করার প্রস্তাবে ভারত অংশই নেয়নি। বরং সাত বাক্যের একটি বিবৃতিতে নয়াদিল্লি বলেছে, ওই প্রস্তাব রচনার প্রক্রিয়া থেকে আমরা সরে এসেছি। ইজরায়েলের আক্রমণের নিন্দা করার কোমরের জোরও আর ভারতের অবশিষ্ট নেই। মার্কিন রণনীতির কাছে দেশকে বিক্রি করে দেওয়া মোদী সরকার এখন আর স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে না। 
তাছাড়া, ইজরায়েলের যে হাইফা বন্দরের পাশে ইরানের প্রত্যাঘাতী ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে, সেটির ৭০ শতাংশের মালিক গৌতম আদানি। বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে ভারতে বসে আদানি গ্রুপকে বিবৃতি দিতে হচ্ছে। অঙ্ক কি খুব কঠিন?

Comments :0

Login to leave a comment