পঞ্চাশ বছর আগে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপরে প্রথম বড় আকারের আক্রমণ। যা গভীরভাবে নাগরিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংকুচিত করেছিল। বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকেই ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার তুলনা করে থাকেন। গত এক দশকের মোদী সরকারের শাসনকালকে হামেশাই ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থাও বলে থাকেন। কিন্তু তা বিভিন্ন দিক থেকে বিভ্রান্তকারী। পিছনে ফিরে দেখলে বলা যায়, এখন আমরা যে পুরোদস্তুর স্বৈরাচার সহ্য করছি, তার সঙ্গে ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার তুলনা আদতে অপেশাদার। জরুরি অবস্থার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ‘পিপলস ডেমোক্র্যাসি’র সম্পাদকীয়তে এই কথা বলা হয়েছে। ‘‘পঞ্চাশ বছর পর: গণতন্ত্রের উপরে এক নতুন এবং গভীর হুমকি’’ শিরোনামে ওই সম্পাদকীয়তে একই সঙ্গে এই প্রত্যয় জানানো হয়েছে যে, ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি এখন আরএসএসের ঘাতক মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য মানুষ দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হন, তাহলে বর্তমান চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা সম্ভব।
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থার ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ‘পিপলস ডেমোক্র্যাসি’র সম্পাদকীয়তে জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে ক্ষমতায় কংগ্রেসের একচ্ছত্রে ধাক্কা লাগে। বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী দলগুলি সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গরিবী হঠাও, ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের মতো প্রগতিশীল স্লোগানের সঙ্গে নিজেকে নতুন রূপে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। পরম্পরাগত রাজনৈতিক রীতি বদলে তিনি রাজ্যের শক্তিশালী নেতাদের পাশ কাটিয়ে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন এবং সরাসরি নিচুতলার মানুষের কাছে আবেদন করতে থাকেন। এর ফলে তাঁর ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় লাভ হয় কিন্তু প্রকৃত অর্থে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করার তাঁর ইচ্ছাপূরণ হয় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার পরেই। এর পরিণামস্বরূপ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানকে চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখে পড়তে হয়। পাকিস্তানের সৈন্য শাসকদের বাঁচানোর জন্য আমেরিকার সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ রুখতে সোভিয়েত রাশিয়ার উপস্থিতিও সহায়তা করেছিল। যা শেষ পর্যন্ত তাঁকে ১৯৭১ সালের নির্বাচনে বিপুল জয় এনে দেয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও সিপিআই(এম)’র অগ্রগতিকে রোধ করা যায়নি। ওই বছরের ভোটেই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সিপিআই(এম) একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে উঠে আসে। কিন্তু এই পরিস্থিতিকে আর স্বাভাবিকভাবে এগোতে দেওয়া হয়নি। ১৯৭২ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোট সম্পূর্ণ রিগিং করা হয়। যা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় আধ দশক কায়েম ছিল। যা ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সহজভাবে জুড়ে যায়।
জরুরি অবস্থায় সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক এবং সমাজকর্মীদের জেলে পোরা হয়। সংবাদ মাধ্যমে সেন্সরশিপ জারি করা হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, খরা এবং ১৯৭৩ সালের তেল সঙ্কটের মতো বিষয়ের জেরে অর্থনৈতিক সঙ্কটের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীকে। ক্রমবর্ধমান বেকারি এবং মূল্যবৃদ্ধির জেরে মানুষের এবং বিরোধীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে। এই বেড়ে চলা চাপ, শ্রীমতি গান্ধীর নিজের নিরাপত্তাহীনতার মনোভাব এবং আইনি ধাক্কা- বিশেষ করে তাঁর লোকসভা সদস্যপদ বাতিলের আশঙ্কা- সব মিলিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে মিলেমিশেই ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই সময়ে লোকসভায় সিপিআই(এম)’র দলনেতা এ কে গোপালনের বক্তব্যও তুলে ধরা হয়েছে ‘পিপলস ডেমোক্র্যাসি’র সম্পাদকীয়তে। ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই লোকসভার ওই ভাষণে গোপালন বলেছিলেন, শাসক দল নিজের এবং নিজের নেতাকে সঙ্কট থেকে বের করার জন্য এই যে পদক্ষেপ করেছে, তা তাদের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে, সামর্থ্যের প্রদর্শন করে না। এই পদক্ষেপ বিরোধীদের এবং জনতার আন্দোলনকে দমন করার জন্য নেওয়া হয়েছে। এরপরে অপরিহার্যভাবে রাজনৈতিক পরাজয়ের মুখে পড়তে হয় কংগ্রেস দল এবং ইন্দিরা গান্ধীকে। ১৮ মাসের জরুরি অবস্থাকে সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতন্ত্রের গভীর বিকৃতি এবং খারাপ ব্যাঘাত হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৭৭ সালের লোকসভা ভোটে অনেক শক্তির বৃহৎ জোট গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছিল।
এখন নরেন্দ্র মোদী ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার কথা তুলে একে সংবিধানের উপরে কালো ছাপ বলে চিহ্নিত করে বলছেন, দেশবাসীকে শপথ নিতে হবে যে, এইরকম প্রতারণা আর করতে দেওয়া হবে না। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর সরকার একটি জীবন্ত গণতন্ত্র সুনিশ্চিত করতে এবং ভারতের সংবিধানে নির্ধারিত সাধারণ মানুষের স্বপ্নপূরণ সুনিশ্চিত করছে। ‘পিপলস ডেমোক্র্যাসি’র সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, গণতন্ত্রের উপরে আরএসএস-বিজেপি’র সব থেকে বড় হামলা যা গত ১১ বছর ধরে করে চলেছে, তার থেকে নজর ঘোরাতেই পঞ্চাশ বছর আগের জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ তুলছেন। এরপরে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকেই ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার তুলনা করে থাকেন। গত এক দশকের মোদী সরকারের শাসনকালকে হামেশাই ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থাও বলে থাকেন। কিন্তু তা বিভিন্ন দিক থেকে বিভ্রান্তকারী। বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক নীতির উপরে বর্তমান হামলা অনেক বেশি কপটপূর্ণ এবং সংস্থানগত কর্তৃত্ববাদ। যাকে অনেকেই মনে করেন নির্বাচনী স্বৈরাচার।
এই অবস্থায় সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, এখন আমরা যে পুরোদস্তুর স্বৈরাচার সহ্য করছি, তার সঙ্গে ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার তুলনা প্রায় অপেশাদার। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়া খুবই কঠিন মনে হয়। কিন্তু সত্তরের দশকে যে সাফল্যের সঙ্গে জরুরি অবস্থার মোকাবিলা করা হয়েছে, তার অভিজ্ঞতা থেকে এই বিশ্বাস তৈরি হয় যে, আরএসএসের ঘাতক মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হলে বর্তমান চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা সম্ভব।
Emergency
জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতা, আরএসএসের ঘাতক মতাদর্শের মোকাবিলা করা সম্ভব

×
Comments :0