Microfinance Loan in west bengal

রাজ্যের ২৪লক্ষ পরিবার মাইক্রোফিনান্সের জালে, ধার ৩৩,১৮১কোটি

রাজ্য

‘বেসরকারি জায়গা থেকে ধার নিলে জুলুম তো একটু সহ্য করতেই হবে।’ মাইক্রোফিনান্স সম্পর্কে এমনই মত চিন্ময়ী মারান্ডির। 
চিন্ময়ী মারান্ডি একটি জেলার সভাধিপতি। যে জেলার সভাধিপতি তিনি, সেই জেলার মহিলাদের মাইক্রোফিনান্সের কবজায় আটকে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি। জেলাটির নাম ঝাড়গ্রাম। চিন্ময়ী মারান্ডি সেই জেলার সভাধিপতি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিশ্বস্ত তৃণমূলের নেত্রী। 
ঝাড়গ্রামে মাইক্রোফিনান্সের ঋণগ্রস্ততার হার ৮.৯২শতাংশ। যা রাজ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রধানত আদিবাসীদের বসবাস ঝাড়গ্রামের। আছেন কুর্মিরাও অনেকে। অনুর্বর জমি, কাজের অভাব। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা ব্যানার্জি অনেকবার দাবি করেছেন,‘জঙ্গলমহল হাসছে।’ মাওবাদীদের বড় অংশ তৃণমূলের নেতা হয়ে ওঠায় এই জেলায় নাশকতা কমেছে। কিন্তু অভাব বেড়েছে। সাঁকরাইল থেকে বাঁশপাহাড়ি, জঙ্গলখণ্ডের যুবকদের বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিক। মহিলারা পড়েছেন মাইক্রোফিনান্সের জালে।
শুধু ঝাড়গ্রাম নয়, মাইক্রোফিনান্সের ‘জুলুমে’ বিধ্বস্ত অনেক জেলাই। একটি সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশের ১৩শতাংশ মাইক্রোফিনান্সের ধার রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। দেশের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে এই চড়া সুদে ধার দেওয়া সংস্থাগুলি যত পরিমাণ টাকা ধার দিয়েছে তার ৫০ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে। এর পরিমাণ কত? প্রায় ৩৩,১৮১কোটি টাকা। ‘‘রাজ্যের ২৩টি জেলাতেই সক্রিয় এই সুদের নামে শোষণকারী সংস্থাগুলি’’, রাজ্যের অর্থ দপ্তরের এক আধিকারিক তা স্বীকার করেছেন।
রাজ্যের অন্তত ২৪লক্ষ পরিবারের মহিলা মাইক্রোফিনান্সের জালে জড়িয়ে আছেন। স্টেট লেবেল ব্যাঙ্কার্স কমিটির সদস্য একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখার উচ্চপদস্থ জানিয়েছেন,‘‘এই সংস্থাগুলির ঋণের পরিমাণ মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪ পরগনা, হুগলী, পূর্ব বর্ধমানের মতো জেলাগুলিতে বেশি। এই জেলাগুলি বড় জেলা। বেশিরভাগ কৃষিপ্রধান। কৃষির সঙ্কট, কাজের অভাব পরিবারের মহিলাদের বিপজ্জনক ঋণের দিকে ঠেলে দেয়।’’ সমীক্ষক দলগুলির হিসাব বলছে, মুর্শিদাবাদে মাইক্রোফিনান্স থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩৯৯১কোটি টাকা। উত্তর ২৪ পরগনায় এই পরিমাণ প্রায় ৩০৯০কোটি টাকা, দক্ষিণ ২৪পরগনায় ২০৯৬কোটি টাকা। হুগলীতে তা প্রায় ১৯৭০কোটি টাকা। 
আরবিআই, স্টেট লেবেল ব্যাঙ্কার্স কমিটি এবং বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সংস্থার পর্যবেক্ষণ জানাচ্ছে, চড়া সুদে মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলির থেকে ঋণ নেন মহিলারা। ধার শোধের জন্য সুদের জন্য গ্রামবাসীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের নানাভাবে হুমকি দেয় মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলির টাকা আদায় করার দায়িত্বে থাকা যুবকরা। এই সঙ্কটের কথা জানেন সভাধিপতি। ‘তবে এখনও এই বিষয়ে বিশেষ কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে বলেছেন,‘‘বেসরকারি মাইক্রোফিনান্স থেকে ধার নিলে চাপ থাকে। একটু জুলুম তো একটু সহ্য করতেই হবে।’’ 
সমীক্ষক দলগুলির রিপোর্ট জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলির সুদের হার সর্বনিম্ন ১২শতাংশ। সর্বোচ্চ ৪০শতাংশেরও সন্ধান মিলেছে। ৯৩.৪ শতাংশ সংস্থা ধার, সুদের টাকা আদায় করতে বাড়ি বাড়ি এজেন্ট পাঠায়। রাজ্য পুলিশের একটি আঞ্চলিক ডিভিসনের উচ্চপদস্থর কথায়,‘‘এই সংস্থাগুলি ধার, সুদ আদায় করার সময় মহিলাদের শ্লীলতাহানি করেছে, এমন অভিযোগও আছে।’’ তবে রাজ্যের থানাগুলিতে সেই অভিযোগ লিপিবদ্ধ আছে, এমন গ্যারান্টি সেই অফিসার দিতে পারেননি। অর্থাৎ অনেকক্ষেত্রে ঋণগ্রস্ত গরিব মহিলা তাঁর শ্লীলতাহানির অভিযোগ থানায় জানান না। 
মাইক্রোফিনান্সের জুলুম আটকাতে তামিলনাডু এবং কর্নাটক সরকার আইন করেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার কোনও আইন করেনি, এমন কোনও পরিকল্পনাও নেই রাজ্য সরকারের। তামিলনাডুতে তিন থেকে পাঁচ বছর, কর্নাটকে দশ বছর কারাদণ্ডের সুযোগ আছে আইন লঙ্ঘনের অপরাধে।
রাজ্যে মাইক্রোফিনান্সের দাপট শুরু হয়েছে তৃণমূলের চুরি, দখলদারীতে সমবায়গুলি ধসে পড়তে থাকার পর। তবে রাজ্যে একশো দিনের কাজ বন্ধ হওয়ার পর মাইক্রোফিনান্সগুলির দৌরাত্ম্য বেড়েছে বেশি। গ্রামবাসী মহিলাদের উপার্জনের একটি উৎস ছিল একশো দিনের কাজের প্রকল্প। রাজ্যে মহিলাদের একাংশ একশো দিনের কাজ থেকে কিছু টাকা উপার্জন করতেন। কাজ বন্ধ হওয়ায় তার সুযোগ নিয়েছে মাইক্রোফিনান্স। তবে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের এক আধিকারিকের কথায়,‘‘যদি রেগার পারফরমেন্স খতিয়ে দেখেন, দেখবেন ২০১৮ থেকে মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে রেগার কাজেও বঞ্চনা স্পষ্ট। একদিকে আয় কমেছে। অন্যদিকে খরচ বেড়েছে। পুরুষদের অনেকেই ভিন রাজ্যে। তাঁদের উপার্জনের টাকা নিয়মিত, নির্দিষ্ট সময়ে আসে, তা বলা যায় না। এই অবস্থায় অনেক মহিলাই মাইক্রোফিনান্স থেকে ধার করেন।’’ তবে এই ভয়ঙ্কর জালে অনেক পুরুষও জড়িয়েছেন। তাঁদের কয়েকজন আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হয়েছেন।

Comments :0

Login to leave a comment