মণ্ডা মিঠাই / নতুনপাতা
জয়নুল আবেদিন
গৌতম রায়
বাংলার চিত্রশিল্পের ইতিহাসে জয়নুল আবেদিন ( ২৯ শে ডিসেম্বর, ১৯১৪-- ২৮ শে মে , ১৯৭৬) এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে তাঁর জন্ম। জয়নুলের পিতা ছিলেন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর। মা ছিলেন গৃহবধূ।
পারিবারিক পরিমণ্ডলে পড়াশোনা শুরু করলেও খুব ছোট থেকেই ছবি আঁকার দিকে তাঁর ছিল বিশেষ রকমের আগ্রহ। জয়নুলের যখন বয়স মাত্র ১৬ বছর, তখন তিনি বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন বাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়ে ।উদ্দেশ্য কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুল দেখা।
প্রথাগত পড়াশোনার দিকে জয়েনুলের খুব একটা আগ্রহ ছিল না ।১৯৩৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করবার পর জয়নুল চলে এলেন কলকাতায় । মায়ের সমর্থনেই তিনি ভর্তি হলেন সরকারি আর্ট স্কুলে ।চিত্রকলার প্রতি ছেলের এই গভীর আগ্রহ দেখে জয়নুলের মা জয়নাবুন্নেছা নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার টাকা দিয়েছিলেন।
১৯৩৮ সালে জয়নুল আবেদিন কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট থেকে ড্রয়িং এন্ড পেইন্টিং বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন ।
'৪৩ এ দুর্ভিক্ষ নিজের চোখে দেখেছিলেন জয়নুল। এই সময়ে তাঁর সৃষ্টি যা 'দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা' নামে দেশে-বিদেশে খ্যাত , একদিকে যেমন দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক গাথা আমাদের সামনে তুলে ধরে ।অপরদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মদতে কিভাবে এই কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ গোটা বাংলার বুকে এক বিভীষিকা তৈরি করেছিল, সেই ইতিহাস কেও জানান দেয়।
দুর্ভিক্ষের সময়কালকে কেন্দ্র করে জয়নুল আবেদীন , চিত্তপ্রসাদ প্রমূখ ব্যক্তিত্বেরা প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন ।সহযোদ্ধাদের রাজনৈতিক বোধ এবং সামাজিক চেতনা থেকে স্নাত হয়ে কেবলমাত্র দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকাই নয় ।দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও জয়নুল আবেদীনের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক।
এই সময় কালে কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের কর্মী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, মহঃ জাকারিয়া, কলিম শরাফি, সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় ( মিত্র) , কামরুল হাসান প্রমুখের সঙ্গে একযোগে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন জয়নুল আবেদিন ।বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন নারী আত্মরক্ষা সমিতি যেসব লঙ্গরখানা খুলেছিল, সেখানেও জয়নুল আবেদিন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় সে যুগের কমিউনিস্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেনের নেতৃত্বে বর্ধমান শহরে যে লঙ্গরখানা পরিচালিত হয় ,সেখানে বিশেষ অবদান ছিল রাবেয়া বিবি( সৈয়দ শাহেদুল্লাহের পত্নী) , মকসুদা খাতুন( সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহের পত্নী) , সুফিয়া কামাল, সৈঈদা বিবি( শাহেদুল্লাহের বোন) প্রমুখের। এই লঙ্গরখানা কে সংগঠিত করবার জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য জয়নুল আবেদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
শুধু তাইই নয়, ' ৪৬ এর দাঙ্গার পর, দাঙ্গা ক্লান্ত মানুষদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে কলকাতার পার্ক সার্কাস অঞ্চলে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে যে কর্মকাণ্ড চলে, তাকেও সবরকম ভাবে সাহায্য করেছিলেন জয়নুল আবেদিন ,কামরুল হাসান, কলিম শরাফির মত মানুষেরা।
' ৪৭এ দেশভাগের পর কামরুল হাসান তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের চলে যান ।এই সময়কালে তার আঁকা 'নৌকো' ( ১৯৫৭), '৬৯ এর আইয়ুব খান বিরোধী অভ্যুত্থান বিষয়ক চিত্রাবলী , তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য নবান্ন' । '৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক চিত্রাবলী, বিশেষ করে ' ম্যাডোনা' ,'৭৪ এ আঁকা ' মনপুরা' -- কেবলমাত্র বাঙালি জনজীবনের প্রেক্ষিতেই নয় , আন্তর্জাতিক দুনিয়ার ক্ষেত্রেও চিত্রকলা কেন্দ্রিক এক সম্পদ। বিশ্বের প্রাচীনতম ব্রিটিশ নিলামকারী প্রতিষ্ঠান 'বনহাহামসে' আকাশ বিক্রি হয়।
চিত্রকলার দুনিয়ায় জয়নুল আবেদিন নিজে একটি ধরা সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, প্রাচ্যের চিত্রশিল্পের ধারা অতিমাত্রায় রীতি নির্ভর এবং অপরিবর্তনশীল। এই বোধ তিনি ধারণ করতে পারেননি। এই ভাবনার সঙ্গে তিনি সহমত ছিলেন না বেশিরভাগ সময় ।আবার ইউরোপীয় ধারা , তাঁর কাছে সীমাবদ্ধ হিসেবেও বহু ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে।এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন রিয়ালিজিমের দিকে ।আর সেখান থেকেই তাঁর মধ্যে রেখাচিত্রের প্রতি একটা বিশেষ রকমের আকর্ষণ তৈরি হয় ,যার অসামান্য উপস্থাপনা আমরা দেখেছি দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার মধ্যে ।
রেখাচিত্রের উপস্থাপনার ভেতর দিয়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার যে বারোমাস্যা তিনি অঙ্কণ করেছিলেন, তেমনটা কিন্তু বাংলায় চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে জয়নুল আবেদিনের আগে আমরা কাউকে দেখিনি। দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা যখন তিনি অঙ্কণ করেন , আঁকবার জন্য খুব ভালো ধরনের উপকরণ তাঁর হাতের কাছে ছিল না। সস্তার প্যাকিং পেপার ,চাইনিজ কালি আর তুলির টানে তিনি যেভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তির পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে তৈরি এই মানুষের তৈরি করা দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছিলেন ,তা বিশ্বের ইতিহাসে একটি বিস্ময় হয়ে রয়েছে।
এই চিত্রমালার মধ্য দিয়ে জয়নুল যেভাবে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছিলেন, এমনটা কিন্তু ভারতীয় চিত্রকলায় জয়নুলের আগে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায়নি। বাস্তবতার সঙ্গে উচ্চমার্গের নন্দনতত্ত্বের এই মেলবন্ধন-- এমনটা ভারতীয় চিত্রকলার ক্ষেত্রে জয়নুল আবেদিনের আগে কেউ আনেননি বললে মনে হয় না ভুল বলা হবে।
Comments :0