প্যালেস্তিনীয় মানবাধিকারকর্মী, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ বাসিন্দা মাহমুদ খলিল, ১০০ দিনেরও বেশি সময় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)-এর হেপাজতে থাকার পর অবশেষে তাঁর স্ত্রী ও সদ্যোজাত পুত্রের কাছে ফিরলেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে গাজায় ইজরায়েলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণে সবচেয়ে উচ্চপ্রোফাইল ছাত্র হিসাবে যিনি টার্গেট হয়েছিলেন, সেই খলিল শনিবার দুপুর ১টা নাগাদ নিউ জার্সিতে এসে পৌঁছান—যদিও তাঁর উড়ান প্রথমে ফিলাডেলফিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়ায় নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দুই ঘণ্টা দেরি হয়।
নিউয়ার্ক বিমানবন্দরে কালো স্ট্রলারে তাঁর শিশুপুত্রকে ঠেলতে ঠেলতে খলিল যখন নিরাপত্তা চৌকি পেরিয়ে আসছিলেন, তখন তাঁর কাঁধে জড়ানো ছিল প্যালেস্তিনীয় কেফিয়াহ এবং ডান হাত উঁচু করে তিনি সাড়া দিচ্ছিলেন উল্লসিত সমর্থকদের অভ্যর্থনায়। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী নূর আব্দাল্লা, আইনজীবীদের দল ও নিউ ইয়র্কের ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসওম্যান আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ।
ছোট্ট সাংবাদিক সম্মেলনে খলিল বললেন, “আমাকে যদি হুমকি দেওয়া হয় বন্দি করার, এমনকি মেরে ফেলার, তাহলেও আমি প্যালেস্তাইনের পক্ষে কথা বলা বন্ধ করব না। আমি কেবল সেই কাজেই ফিরতে চাই যা আমি করছিলাম—প্যালেস্তাইনের অধিকারের পক্ষে কথা বলা, যা আসলে উদ্যাপনের দাবি রাখে, শাস্তির নয়।”
ওকাসিও-কর্তেজ বলেন, “এটা এখানেই শেষ নয়। আমাদের এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মতপ্রকাশের অধিকারকে ভিত্তি করে কাউকে দমন করা—এটা শুধু মাহমুদের নয়, আমাদের সবার সংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন।”
তিনি আরও বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন জানে, তারা এক ব্যর্থ লড়াই চালাচ্ছে।”
সমর্থকদের জড়িয়ে ধরে, যাঁদের অনেকেই কেফিয়াহ পরে এসেছিলেন, খলিল জানালেন—তাঁকে শুক্রবার রাতে লুইজিয়ানার একটি আইসিই বন্দিশিবির থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। নিউ জার্সির ফেডারেল বিচারপতি মাইকেল ফারবিয়ার্জ রায় দেন যে, শুধুমাত্র ইমিগ্রেশনের মতো একটি অসামরিক বিষয় নিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে।
৩০ বছর বয়সি খলিলকে মার্চের শুরুতে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টলের লবি থেকে তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীর সামনে, সাদা পোশাকের আইসিই এজেন্টরা তুলে নিয়ে যায় এবং লুইজিয়ানা প্রদেশের জেনা বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ফলস্বরূপ, খলিল তাঁর প্রথম সন্তানের জন্মের সময় থাকতে পারেননি, পরিবারের সঙ্গে প্রথম মাদার্স ডে বা ফাদার্স ডে কিংবা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর স্নাতক সমাবর্তন— কোনাটাতেই হাজির থাকতে পারেনি খলিল। তাঁকে ৮ মার্চ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত মোট ১০৪ দিন বন্দি রাখা হয়।
বিচারপতি রায়ে বলেন, “এই ব্যক্তি জনগণের জন্য কোনও হুমকি নয়। এটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।” তিনি আরও বলেন, কোনও অসামরিক ইমিগ্রেশন বিষয়ে কাউকে শাস্তিস্বরূপ আটকে রাখা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক।
বন্দিশিবিরের বাইরে সাংবাদিকদের খলিল বলেন, “ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন ভুল লোককে বেছে নিয়েছে। যদিও এর মধ্যে কোনও সঠিক ব্যক্তি থাকার কথাই নয়। শুধু গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য একজনকেও বন্দি করা উচিত নয়।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “কেউই অবৈধ নয়—কোনও মানুষই অবৈধ নয়। ন্যায়বিচার জয়ী হবেই।”
তবে এনবিসি জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের নোটিস জমা দিয়েছে।
শর্তসাপেক্ষে মুক্তির অংশ হিসাবে, খলিলকে তাঁর পাসপোর্ট ও গ্রিন কার্ড আইসিই-কে জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া তাঁর ভ্রমণ সীমাবদ্ধ করা হয়েছে নিউ ইয়র্ক, মিশিগান, লুইজিয়ানা, নিউ জার্সি এবং ওয়াশিংটন ডিসি’র মধ্যে। নিউ ইয়র্কে পৌঁছনোর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে বর্তমান ঠিকানা জানাতে হবে।
খলিলের বিরুদ্ধে এই নির্দেশকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলা হিসাবে দেখা হয়েছে। এটি ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চপ্রোফাইল ‘বর্ণবাদী’ হানাদারির প্রথম ধাপ, যার লক্ষ্য ছিল গাজায় ইজরায়েলের আগ্রাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা।
বিশেষ করে, কলাম্বিয়ার প্যালেস্টাইন পন্থী ক্যাম্পাস আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধক ছিলেন খলিল—যেখানে বহু ইহুদি শিক্ষার্থীও তাঁর পাশে দাঁড়ইয়েছেন এবং আদালতে সমর্থনপত্র দাখিল করেছেন।
খলিল একবার সিএনএন-এ বলেন, “প্যালেস্তিনীয় ও ইহুদি জনগণের মুক্তি একে অপরের সঙ্গে জড়িত। একটির মুক্তি ছাড়া অন্যটির মুক্তি অসম্ভব।”
খলিলের মুক্তির খবর ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে আরেকটি বড় ধাক্কা, যারা প্রমাণ ছাড়াই বলে আসছে, ইজরায়েলবিরোধী মতামত মানেই ইহুদিবিদ্বেষ।
এই ঘটনায় আরও তিন শিক্ষার্থী—রুমাইসা ওজতুর্ক, বাদার খান সূরি এবং মোহসেন মাহদাভি—অবশ্য আগেই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। অনেকে স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়েছেন, আবার কেউ লুকিয়ে বৈধ লড়াই চালাচ্ছেন।
খলিলের মুক্তির পর তাঁর সমর্থনে এবং আমেরিকায় বন্দি হাজারো অভিবাসী ও ইজরায়েলে বিচারহীনভাবে আটক প্যালেস্তিনীয়দের মুক্তির দাবিতে রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় নিউ ইয়র্কের সেন্ট জনস দ্য ডিভাইন ক্যাথেড্রালের সামনে একটি সমাবেশের আয়োজন হয়েছিল। তাঁর আইনজীবীদের সঙ্গে খলিলও সেখানে ভাষণ দিয়েছেন।
প্যালেস্তিনীয় ইয়ুথ মুভমেন্টের মিরিয়াম ওসমান বলেছেন, “মাহমুদের মুক্তি আমাদের সংগ্রামকে আরও তীব্রতর করেছে। যতক্ষণ না সব বন্দি মুক্ত হচ্ছে, গাজায় গণহত্যা বন্ধ হচ্ছে এবং ইজরায়েলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে, আমাদের লড়াই চলবে।”
Mahmoud Khalil
‘কেউই অবৈধ নয়, ন্যায়বিচার জয়ী হবেই’ ১০০ দিনের বন্দিত্ব শেষে বললেন খলিল

×
Comments :0