গল্প — নতুনপাতা, বর্ষ ৩
রবি ঠাকুরের ম্যাজিক
সৌরীশ মিশ্র
গল্প
রবিবার আজ।
বিকেলবেলা এখন।
দুপুরের খাওয়া সেড়ে একটা বই পড়ছিলাম ঘরে ইজ়ি-চেয়ারে বসে। পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিই না।
এই মাত্র ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে প্রথমেই দেখতে পেলাম মেয়েকে। কুঁড়ি ঘরের এক কোণে থাকা বিছানায় আধশোয়া হয়ে এক মনে কি একটা যেন বই পড়ছে। বইটা কি, এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি না, মেয়ের আড়াল হয়ে যাওয়ায়। তবে, বুঝতে পারলাম, পুরো মগ্ন হয়েই বইটা পড়ছে ও।
ব্যাপারটা অবাকই করল আমায়। কারণ, বই পড়তে বিশেষ ভালোবাসে না আমার মেয়ে। তার চেয়ে টিভির কার্টুন চ্যানেল ওকে টানে অনেক বেশি। তবে, কেউ যদি ওকে বই থেকে কোনো গল্প বা কবিতা পড়ে শোনায়, সেটা মনোযোগী হয়েই শোনে।
কাল যেমন রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর শুনিয়েছিলাম ওকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "শিশু ভোলানাথ" থেকে কয়েকটা কবিতা, রবীন্দ্র রচনাবলীর ঐ খন্ডটা বুক-শেল্ফ থেকে বের করে। পড়তে-পড়তে লক্ষ্য করছিলাম, মেয়ে আগ্রহ নিয়ে শুনছে খুব। কিন্তু, ওর ঘুমোনোর সময় হয়ে যাওয়ায়, কয়েকটা কবিতা পড়ার পর বলেছিলাম, আজ ডিনারের পর বাকি কটা শোনাবো। কুঁড়ি প্রথমে শুনতে চাই নি কথাটা। বায়না করছিল, ওকে "শিশু ভোলানাথ"-এর সবকটা কবিতাই শোনাতে হবে তখুনি। আমারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু যখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্রায় এগারোটা বাজতে যায়, তখন একটু বকে-ঝকেই ঘুম পাড়ালাম ওকে।
যাই হোক। ইজ়ি-চেয়ার থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠি এবার। মেয়ে তখনও বইটাতে ডুবে আছে। এইবার একটা কথা মাথায় এলো হঠাৎই। যে কথাটা মাথায় এলো, সেটাই কি তবে ঠিক? তবে কি সেই বইটাই পড়ছে ও?
আমি পায়ে-পায়ে মেয়ের কাছে যাই। তাকাই, মেয়ের দু'হাতে ধরা বইটার দিকে। ঠিক। যা ভেবেছি, তাই। রবীন্দ্র রচনাবলীর সপ্তম খন্ড, যেটা গতকাল রাতে বের করেছিলাম বুক-শেল্ফ থেকে, হাতে ধরা আমার মেয়ের। এবার চোখ রাখি বইটার খোলা পাতা দুটোয়। দেখতে পাই, খোলা পাতা দুটোর একটা পাতায় "বুড়ি" আর অন্য পাতাটায় "রবিবার" কবিতাটা। "শিশু ভোলানাথ" পড়ছে আমার মেয়ে! কি যে আনন্দ হোলো আমার তা কি বলব। মনে মনে ভাবি, যে মেয়ে বই পড়তে একটুও ভালোবাসে না, সে কিনা নিজে থেকে নিয়ে পড়ছে বই! একেই বোধহয় বলে, রবি ঠাকুরের ম্যাজিক।
"শিশু ভোলানাথ পড়ছিস, মা?" জিজ্ঞেস করি এবার মেয়েকে।
কুঁড়ি বই থেকে মুখ তুলে আমার পানে চায়।
"হ্যাঁ, বাবা। কি সুন্দর কবিতাগুলো! কাল রাতে, যেগুলো শোনালে তুমি, সেগুলোর মতোই।"
"হবেই তো মা। রবি ঠাকুরের লেখা। সুন্দর হবে না! পড়। দেখবি, কি ভালই না লাগবে।" বলে, মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিই আমি।
মেয়ে আমার ঠোঁটের কোণে একটু মিষ্টি হেসে ফের ডুবে যায় "শিশু ভোলানাথ"-এ।
Comments :0