গল্প / মুক্তধারা , বর্ষ ৩
চা না কফি
স্বস্তিক সেনগুপ্ত
— এই শতাব্দী! বল না...
— কি বলব? তোর যাকে পছন্দ তার ব্যাপারে আমি কি বলবো, অদ্ভুত তো!
— না, তুই তো ওর ভালো বন্ধু, তাই তোকেই জিজ্ঞেস করছি।
একটু মনমরা হয়ে যায় অনিন্দ্য। কৌশিকীকে ভালো লাগে ওর, কিন্তু যা গোমড়া মুখে থাকে, কথাই বলা যায় না, প্রেমালাপ তো বহুদূর। একবার শুধুমাত্র অফিস শেষে একটু টাইম কাটাবে বলে ' চা না কফি? ' জিজ্ঞেস করতে গেছিল, জবাবে ওই গোমরা মুখ তুলে, চুল সরিয়ে ' কেনো? ' শুনে দ্বিতীয়বার আর জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি। তবে হাল যে একেবারে ছেড়েছে তাও না। সকালে এসে হাসি মুখে ' গুড মর্নিং ' , কাজের ফাঁকে একটু মুখ বাড়িয়ে তাকানো আর কৌশিকী তাকালেই মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া, লাঞ্চটাইমে একবার করে এসে 'খেয়েছ', যাওয়ার সময়ে ', এমনকি একদিন ' একটু এগিয়ে দেবো?' বলাতে যখন ও না তাকিয়েই চলে যায়, সেইদিন যে একটু রাগ ওঠেনি ওর ওপর সেটা বললে ভুলই বলা হবে। তারপর দিয়ে কৌসিকীর সাথে সোজাসুজি কথা বলে না অনিন্দ্য, যতই হোক ' বাঙালি হয়ে অগাধ প্রেমের নিদর্শন দিতে পারলেও, আত্মসম্মান বিলিয়ে তো কখনই না '। তবে প্রেমকে অফিসে ফাইলের চাপে মেরে দেয়নি অনিন্দ্য, সো ট্রাই দ্যা নেক্সট স্ট্র্যাটেজি, অফিসে কৌশিকী এই শতাব্দীর সাথেই যা একটু কথা বলে, তাই শতাব্দীকেই একটু বেশি তেল মেরে ওর ব্যাপারে জানতে চায় অনিন্দ্য, সুফল তেমন পায় না, যেই তিমিরেই ছিল, সেই তিমিরেই পরে থাকলো অনিন্দ্য। সামান্য বাড়ির অ্যাড্রেস টুকুও বলতে পারে না শতাব্দী, কিভাবে এগোবে সেটা তো বহু দূরের কথা। তাই আজকে একটু মনমরা হয়েই শতাব্দীকে একটা ছোট ' আচ্ছা ' বলে একটু থমকে যায়। সামনের দোকান দিয়ে একটা সিগারেট কেনে, জ্বালিয়ে দুটো সুখটান দেয়, ' ধুর, মুড ভালো না থাকলে রিং গুলোও হয় না। ' আর কটা টান দিয়ে সিগারেটটা ফেলে দেয়। একটু এগিয়ে দেখে রাস্তার মোড়ে কৌশিকী দাঁড়িয়ে, হয়তো বাস ধরবে বলে, দেখেও না দেখার ভান করে হেঁটে বেরিয়ে যেতে চায় অনিন্দ্য, কিন্তু পারে না। পাশ দিয়ে যেতেই ' ওই অনিন্দ্য ' ডাকটা শুনে ওর চলায় পুরো ফুলস্টপ পরে যায়, মনে হয় বুকের মধ্যে হাজারজন দুম দুম করে দুরমুশ পিটচ্ছে, ডাকটা শুনে কান জুড়িয়ে গেলো। আজ মনে হলো দিদার দেওয়া এই 90s মার্কা নামটাও এত সুন্দর হতে পারে!
কি করবে এখন? চট করে ঘুরে দাঁড়াবে? না, তাহলে তো বুঝে যাবে যে সে আগেও দেখেছে আর দেখে না দেখার ভান করেছে। তাহলে উল্টো দিক করে ঘুরুক, আর ভাবতে পারে না, চট করেই ঘুরে যায় সে, —
— হ্যাঁ বলো।
— কি ব্যাপার! আজকাল ব্যাস্ত নাকি? অবশ্য থাকারই কথা, শতাব্দী এক্সপ্রেসের পিছনে গেলে তো ছুটতেই হবে।
' এক সেকেন্ড, কৌশিকী ওকে মক করলো! হ্যাঁ, এই বাংলার পাঁচমুখী মেয়েটা মক করতে পারে! '
— হুররর। শুধু বন্ধু হয়।
— বন্ধু?
' কি ব্যাপার, কৌশিকী কি সবটা উল্টো বুঝল? আর অনিন্দ্য ওকে ছেড়ে শতাব্দীর পিছনে গেছে বলেই কি আজ ডেকে কথা বলল? নইলে তো আগে কোনদিন মুখ তুলেও সেরকম তাকায়নি।' আবার প্রশ্ন আসে, -
— কি হল? বলো, বন্ধু হয়?
— হ্যাঁ, খালি বন্ধু।
উত্তরে সুর করে ' ওওও.....' বলে কৌশিকী, যেই কান এই কিছুক্ষণ আগে জুড়িয়ে গেছিল, সেই কানই এই ' শুনে জ্বলে ওঠে।
... না, আমি তো ভাবলাম আমার খবর নেওয়ার জন্য ওর প্রেমে পড়লে।
' আবার, আবার বুকে দুরমুশ পেটানো শুরু, তারমানে কি ও সবটা জানে, আর জেনে এরম করছে! কি নিষ্ঠুর মনের হয় এই মেয়েজাতি! রাগে মুখে যা আসে বলে দেয় অনিন্দ্য।'
— হ্যাঁ, নয়ত কি? কতোদিন ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছি, আর তুমি বুঝবো না বলে মনের সব দরজায় ডবল লক করে রেখেছ, তো কি করবো? ওর কাছ দিয়ে খবর নিচ্ছিলাম যে কি করে তোমার সাথে একটু কথা টুকু বলব, আর কিছুই না। আমি কোনো এক্সপ্রেসের পিছনে ছুটছি না, আমার গাড়ি এখনো লোকাল হিসাবেই সিগন্যাল পেলো না, আমি নাকি শতাব্দী এক্সপ্রেসের পিছনে ছুটব।
— বুঝলাম।
কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। এই দু'মিনিটে অনিন্দ্য বাচ্চাদের মত করে যেন অভিমান বার করলো। স্তব্ধতা ভেঙে কৌশিকীই প্রথম কথা বলে।
— নাহ, ঠিকই করেছো। ডবল লক ভাঙতে তো স্পেশাল কি -ই লাগে। আসলে কি বলতো এই প্রেম-ভালোবাসা এগুলোকে না কেমন জানি ছোটো থেকেই ভয় পাই, একটা মানুষ একটা অন্য মনের অন্য রকম মানুষের সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি, মনের অমিল হয়, কত ঝামেলা, কি করে থাকবো একটা ভিন্ন মানসিকতার মানুষের সাথে?
— এই তোমার বাবা মা কি তাহলে ভাই - বোন?
— মানে? কিরমক কথা! ভাই বোন হতে যাবে কেনো?
— না মানে ওদের কি মতের মিল হয় সবসময়?
— আমার বাবা - মা ডিভোর্সি।
বলেই মুখটা নামিয়ে নেয়। এই সেরেছে। হয়ে গেছে, শেষ, আর কিছু বাকি নেই, এবার কি করবে? সরি বলবে নাকি। কিন্তু এরপর যা করে সে, সেটা হয়তো কৌশিকীও ওই কথাটার পর আশা করেনি। হাঁটু গেড়ে হঠাৎ করে সামনে বসে একটা হাত ঝপ করে ধরে বলে, ' আমি কোনোদিনও ছেড়ে যাব না তোকে, বিশ্বাস কর। আমি সত্যিই তোকে অনেক ভালবাসি। '
খুবই কমন ভাষায় প্রেম নিবেদন। হাতটা ছাড়িয়ে নেয় কৌশিকী, উঠে দাড়ায় অনিন্দ্য, আবার কিছুক্ষনের স্তব্ধতা, দুজনেই অনড় অবস্থায় দাড়িয়ে, এবারেও স্তব্ধতা ভাঙিয়ে অনিন্দ্যর হাতটা ধরে কৌশিকী, আর বহুকাল আগের অনিন্দ্যর করা প্রশ্নটাই পাল্টা করে, ' চা না কফি?'
Comments :0