Editorial

বর্বরতায় বৈধতা!

সম্পাদকীয় বিভাগ

গাড়িতে গোরুর মাংস রয়েছে এই অভিযোগে ফের চারজন সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে বর্বরভাবে মারধর করা হয়েছে উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে। নিছক কিছু দুষ্কৃতীর কাণ্ডকারখানা হলে ততোটা উদ্বেগ হয়তো হতো না, উত্তর প্রদেশের পুলিশ এবং সরকার যদি আইনানুগ পথ গ্রহণ করে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতো হয়তো কিছুটা স্বস্তি অবশিষ্ট থাকতো, ঘটনাটি যদি সামাজিকভাবে নিন্দার ঝড় তুলতে পারতো তাহলেও হয়তো শ্বাস নেওয়ার অবকাশ মিলতো। কিন্তু আলিগড়ের ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে ধর্মান্ধতায় উন্মত্ত একদল মানুষের পশুসুলভ নিষ্ঠুরতাকে সার্বিক বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা। হামলাকে সমর্থন করে শাসকদলের নেতা কর্মীদের প্রকাশ্যে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির বেপরোয়া হুমকি। এভাবে সাম্প্রদায়িক উসকানিতে সাধারণ মানুষকে উন্মত্ত জনগোষ্ঠীতে পরিণত করে নৈরাজ্য ডেকে আনার ভয়াবহ ইঙ্গিতকে শুধু উদ্বেগজনক বলাও হয়তো কম হয়ে যায়। 
গোরুর মাংস রাখার গুজব ছড়িয়ে পশ্চিম উত্তর প্রদেশেরই নয়ডার দাদরিতে মহম্মদ আখলাক নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীরা। মোদী জমানায় সেটাই ছিল গোহত্যা নিবারণের নামে প্রথম মানব হত্যা। তারপরের বছরগুলিতে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়েছে গোরুর নামে হিংসা। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বা যে সব জায়গায় বজরঙ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সহ অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শক্তিশালী, সেখানে এইধরনের হামলা, হিংসা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আখলাক হত্যার পরে তাঁর ঘরের ফ্রিজে রাখা টিফিন বক্সের মাংস যা মথুরার ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল, অনুসন্ধানে জানা যায় তা গোরুর মাংস ছিল না। অথচ শুধুমাত্র সন্দেহের বশে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে-থেঁতলে খুন করে দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘটনার থেকে রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুলি যে কোনও শিক্ষাই নেয়নি তার প্রমাণ মিললো এবার আলিগড়ের জাতীয় সড়কে। শনিবার সকালে আলহাদপুর স্টেডিয়ামের কাছে একটি ম্যাক্স গাড়ি আটকায় বজরঙ দল এবং অখিল ভারতীয় হিন্দু সেনার জনা পঞ্চাশেক উন্মত্ত লোকজন। গাড়িতে গোরুর মাংস আছে এই সন্দেহে তারা গাড়ি থেকে টেনে নামায় চারজনকে, তারপর তাদের নাম জিজ্ঞাসা করে তাদের মুসলিম ধর্ম পরিচয় জানা মাত্র শুরু হয় মারধর। বিবস্ত্র করে তাঁদের এমন মারা হয় যে রাস্তা রক্তে ভিজে যায়। গাড়িটি ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অনেক পরে পুলিশ এলেও রক্তাক্ত আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধা দেয় উন্মত্ত হামলাকারীরা। শেষপর্যন্ত পুলিশ আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করেছে বটে, তবে তাঁদের আঘাত গুরুতর, একজনের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক বলেও জানা গেছে।
এমন বর্বর হামলার পরেও পুলিশ যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করেছে এমন কোনও স্বস্তিদায়ক সংবাদ মেলেনি। বরং পুলিশ আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই গোরুর মাংস বহনের অভিযোগে এফআইআর দায়ের করেছে। কারণ উত্তর প্রদেশে গোরুর মাংস নিষিদ্ধ। পুলিশ জানতে পেরেছে, স্থানীয় একটি মাংসের কারখানা থেকে মাংস স্থানীয় একটি বাজারে সরবরাহের জন্যই গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন চারজন। মাংসের কারখানা এবং বাজারটি যদি সরকারি নিয়ম মেনে চলে তাহলে এই আক্রান্ত চারজনও যে নিয়ম মেনেই কাজ করছিলেন তা সহজেই অনুমেয়। তা সত্ত্বেও পুলিশ কেবল সন্দেহের বশে, মাংসের নমুনা ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষার আগেই গোমাংস রাখার অভিযোগ দায়ের করেছে। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক হিংসায় প্ররোচনাকারী, প্ররোচনায় পা দেওয়া উন্মত্ত মানুষজন এবং পুলিশ প্রশাসন সবাই একলাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা তাহলে কতটুকু? আইনি শাসনের অস্তিত্ব নিয়েই যেখানে প্রশ্ন ওঠে সেখানে গোরুর মাংস বহন করাকে ‘অপরাধ’ হিসাবে গণ্য করার আইন কতটা নৈতিক তা নিয়ে আলোচনা তো অনেক পরের কথা। আইনি শাসনের পরিবর্তে তালিবানি শাসনের মতোই সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীদের সংবিধান বহির্ভূত শাসন যে অরাজকতা তৈরি করবে তাতে জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে দেশের কোনও মানুষই নিরাপদ থাকবেন না, কারোর অধিকারই সুরক্ষিত থাকবে না।

Comments :0

Login to leave a comment