অন্যকথা
“স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ ” এর আয়নায় কবি বিষ্ণু দে
সৌরভ দত্ত
মুক্তধারা
বিষ্ণু দে উত্তর তিরিশ পর্বের রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার অবিসংবাদি নাম। আপাতভাবে প্রচার বিমুখ এই কবি,অনুবাদক, চিত্র সমালোচকের জন্ম ১৯০৯ সালে ১৮ই জুলাই কলকাতার টেমার লেনে শ্যামা চরণ দে বিশ্বাসদের পরিবারে মাতামহ গিরীন্দ্রনাথ বসুর বাড়িতে। কবির পৈতৃক ভিটা হাওড়ার পাঁতিহাল গ্রামে শৈশবে মায়ের কাছে প্রারম্ভিক শিক্ষালাভ। মাত্র দশ বছর জ্যাঠামশাই এর নির্দেশে বয়সে মিত্র ইনস্টিটিউশন(মেন) এ সেভেন্থ ক্লাসে ) চতুর্থ শ্রেণি)-তে ভর্তি করানো হন।মিত্র ইনস্টিটিউশন এর ছাত্র থাকাকালীন ‘সন্দেশ’ পত্রিকা আয়োজিত ১৯২৩ এ মিত্র ইনস্টিটিউশন ছেড়ে সেকেন্ড ক্লাসে ভর্তি হন সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে।এরপর ১৯৩০ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন।এবং১৯৩২ এ সেন্ট পলস কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণির সাম্মানিক স্নাতক হন। কলেজে পাঠরত অবস্থায় অধ্যাপক ক্লাবটি, ক্রিস্টোফার একরয়েড প্রমুখ তাঁকে আলোকিত করেন। অধ্যাপক একরয়েড তাঁকে মার্কসবাদ ও পাশ্চাত্য
ধ্রুপদী সংগীতে দিক্ষীত করে তোলেন।১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম.এ (ইংরেজি) পাশ করেন।১৯৩৪ সালেই কবির সাথে বিবাহ হয় প্রণতি রায়চৌধুরীর।১৯৩৫ এ কবি রিপন কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এখানে তাঁর সহকর্মী ছিলেন বুদ্ধদেব বসু,অজিত কুমার দত্ত,প্রমথ নাথ বিশী ,হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।১৯২৩ সালে টি.এস এলিয়টের “দ্য ওয়েল্যান্ড” কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের বছরেই ‘কল্লোল’ পত্রিকার প্রকাশনার মধ্যে দিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে যে পালাবদলের ঢেউ উঠেছিল বিষ্ণু দে ছিলেন সেই আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারী।এর পরবর্তীকালে ১৯৩০ সালে কল্লোলের প্রকাশনা বন্ধ হলে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকায় যোগদান করেন এবং সেখানে একজন সম্পাদক হিসাবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেন। তিনি নিরুক্তা নামের একটি সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন।
তার কবিতার অন্যতম বিষয় ছিল– মানুষবেতর সমাজ, দেশীয় সংগ্রাম ও সমকালীন রাজনীতি, সেখানে সমকালীন জীবনের তান ধ্বনি অনুরণিত হয়। প্রথমদিকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দুই সংস্কৃতিরই প্রভাব পড়েছে তার লেখায়। দেশীয় পুরাণ, মিথ,ইতিহাস, দর্শন, শিল্পসাহিত্য, পরাবাস্তবতা থেকে ইউরোপীয় ক্লাসিক ও আধুনিক শিল্প সাহিত্যের প্রভাব এবং পরে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়, দ্বিতীয় মহাসমর, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, তেভাগা-আন্দোলনের ঘটনাবহুল ইতিহাস ইত্যাদি থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরের সমাজজীবন ও সংঘাতময় আন্দোলন তার কবিতায় আধিপত্য বিস্তার করেছে। পাশ্চাত্যের কবি টি.এস এলিয়টের দর্শনে প্রথমদিকে স্থির থাকলেও পরবর্তীতে মার্কসীয় বীক্ষণ তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ কবির জীবনে এক চিলতে বিশুদ্ধ বাতাস।কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উর্বশী ও আর্টেমিস ’প্রকাশ পায় ১৯৩৩ সালে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘চোরাবালি’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। কবির সর্বমোট গ্রন্থ সংখ্যা ১৭।কবি টি.এস এলিয়ট ,পল এল্যুয়ার,ও মাও-সে-তুঙ এর কবিতা অনুবাদকরেন।‘ক্রেসিডা’,‘ঘোড়সওয়ার’,‘দামিনী’,‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ ‘২২শে শ্রাবণ’,‘ভিলানেল’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতা। শিশু পাঠ্য উপযোগী ‘জন্ম দিন’,‘পার্কে’,‘বামী’ কবিতাগুলি উল্লেখযোগ্য।“ছড়ানো এই জীবন” নামে একটি আত্মজীবনী লিখছেন। কবির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ–‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’।‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ ' কাব্যের জন্য ১৯৭১ সালে তিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্যে কৃতিত্বের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান ১৯৬৫ সালে। সোভিয়েত-দেশ পুরস্কার পান ১৯৬৭ সালে। তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সাথে যুক্ত ছিলেন। চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের সঙ্গে কবির গভীর সখ্যতা ছিল।যামিনী রায়ের চিত্রের সমালোচনা মূলক ‘আর্ট অফ যামিনী রয়’ নামে গ্রন্থ লিখেছেন।কলকাতায় ৩রা ডিসেম্বর,১৯৮২ সালে এই কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আপাতভাবে দুরূহ মনে হলেও গভীরভাবে অভিনিবিষ্ট হয়ে পাঠ করলে বিষ্ণু দে-এর কবিতাগুলি জন্মের ১১৫ পরেও এখনো সমান প্রাসঙ্গিক।
“চোরাবালি ডাকি দূর দিগন্তে
কোথায় পুরুষকার ?
হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মাের!
আয়ােজন কাপে কামনার ঘোর
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার?”
Comments :0