পারভেজ রহমান
২০২২ এর আগস্ট মাসে আমেরিকান সংস্থা Health Effects Institute পৃথিবীর ৭০০০ শহরে বায়ু দূষণ নিয়ে একটি সমীক্ষা করে। সেই সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী দিল্লি পৃথিবীর সব থেকে ক্ষতিকারক শহর হিসাবে চিহ্নিত হয়। ২০১৯-এর ২৫ নভেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালত দিল্লির বায়ু দূষণ প্রসঙ্গে মন্তব্য করে, ‘দিল্লির অবস্থা নরকের থেকেও খারাপ।’ আরও কঠিনভাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এর থেকে বিস্ফোরক এনে সবাইকে মেরে ফেলা ভালো।’
২০১৮ সালের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে জানায়, যে দিল্লির দূষণের ৪১ শতাংশ ঘটে যানবাহনের ধোঁয়ার কারণে। ২১.৫ শতাংশ ঘটে ধুলোর কারণে আর ১৮ শতাংশ ঘটে শিল্পজনিত দূষণের কারণে। দিল্লির বায়ু গুণমান সূচক (Air Quality Index) সাধারণত থাকে ৫১ থেকে ১০০-র মধ্যে। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির এই সূচক বেড়ে ৪০০-৫০০ হয়ে যায়। এর কারণ প্রধানত বিজয়া দশমীর সময় কুশপুত্তলিকা পোড়ানো, দীপাবলির সময় আতশবাজি ফাটানো, জাতীয় রাজধানী অঞ্চলে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধোঁয়া নিঃসরণ, দিল্লি লাগোয়া কৃষি অঞ্চলে খড় পোড়ানো, রাস্তার ধুলো, যানবাহন দূষণ ও ঠান্ডা আবহাওয়া এবং রাজস্থানের থর মরুভূমির বালিকণা মিশ্রিত শুষ্ক হাওয়া।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত United Nations Convention to Combat Desertification (UNCCD) এর Conference of Parties (COP14) এর সম্মেলনে দিল্লির মানুষকে বাঁচাতে পরিবেশবিদরা চীনের ‘The Great Green Wall’ এবং আফ্রিকার ‘The Great Wall of Sahara’-এর অনুকরণে ‘The Green Wall’ এর প্রস্তাব দেন।
২০০৫ সালে African Union-এর উদ্যোগে সাহারা মরুভূমির গ্রাস থেকে আফ্রিকা মহাদেশকে রক্ষা করতে সাহারা মরুভূমি বরাবর ৭৭৭৫ কিলোমিটার লম্বা ১৫ কিলোমিটার চওড়া এলাকা জুড়ে গাছের দেওয়াল তৈরি হওয়া শুরু হয়। এটিই ‘The Great Wall of Sahara’ নামে পরিচিত।
চীনে গোবি ও টাকলামাকান মরুভূমির প্রসার আটকাতে ৪৪২৮ কিলোমিটার লম্বা এবং ১৪৪৮ কিলোমিটার চওড়া অঞ্চল জুড়ে বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে 'The Great Green Wall' নামে কৃত্রিম জঙ্গল তৈরির কাজ শুরু হয়। এটি বর্তমানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জঙ্গল হিসাবে চিহ্নিত। ২০২০ সালে বিবিসি’র একটি রিপোর্ট অনুযায়ী এই জঙ্গল চীনের কার্বন নিঃসরণ অনেকাংশেই কমাতে সাহায্য করেছে।
ভারতে পরিবেশবিদদের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘The Green Wall’ হলো গুজরাটের পোরবন্দর থেকে হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র পর্যন্ত আরাবল্লী রেঞ্জ বরাবর ১৬০০ কিলোমিটার লম্বা ৫ কিলোমিটার চওড়া গাছের দেওয়াল, যা প্রাকৃতিকভাবে দিল্লি সহ উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় অঞ্চলকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে এবং দূষণকে সহ্যের মধ্যে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে। এর মধ্যে ৬৭০ কিলোমিটার আরাবল্লী এবং বাকিটা শিবালিক রেঞ্জের মধ্যে পড়ে। কেন্দ্রীয় সরকার ১৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এই প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘এক পেড় মা কে নাম’ বলে গাছ লাগানোর আহ্বান জানান।
আরাবল্লী রেঞ্জ দিল্লির কাছাকাছি শুরু হয়ে রাজস্থানের মধ্য দিয়ে গুজরাটের আহমেদাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতবর্ষের সবথেকে প্রাচীন এই ভঙ্গিল পর্বতমালা বেশ কয়েকটি নদীর উৎসভূমি, বহু প্রজাতির গাছ, পশুপাখির আবাসস্থল। অন্তত ২২ টি অভয়ারণ্য, বেশ কিছু জীব বৈচিত্র পার্ক, অসংখ্য জলাশয়, বেশ কিছু নদীর উৎসস্থল এই আরাবল্লী পর্বতশৃঙ্খলা। এর পাশাপাশি আরাবল্লী রেঞ্জ দিল্লি সহ উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় অঞ্চলকে থর মরুভূমির প্রকোপ থেকে রক্ষাকারী ঢাল হিসাবে কাজ করে। রক্ষা করে পরিবেশকে। আরব সাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্পকে আটকে রাজস্থানে বৃষ্টিপাত ঘটায় এবং তার পূর্ব দিকে যাওয়া আটকে হিমালয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
কয়েক দশক থেকেই অবৈধ খনি, পাথর খাদান, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নির্বিচারে গাছ কাটা, দুটি পাহাড়ের খাঁজে আবর্জনা স্তূপীকরণের মধ্যে দিয়ে আরাবল্লী পর্বতশৃঙ্খলা প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
২০২১ সালে আদলত রায় দেয়, আদালতের অনুমতি ছাড়া আরাবল্লী রেঞ্জ অঞ্চলে কোনও খনি খনন করা যাবে না। কিন্তু তা কার্যকর হয় না।
আরাবল্লী রেঞ্জে অবৈধ খনির বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোটে টিএন গোদাবর্মণ থিরুমলপাদ সরকারের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে আরাবল্লী রেঞ্জে খনি চালানো সঠিক কিনা, তা পরীক্ষা করতে বলে। তার সাথে এও বলে যে বিভিন্ন রাজ্যে আরাবল্লী পর্বত শৃঙ্খলার বিভিন্ন সংজ্ঞার সুযোগে আইনের আড়ালে পাথর খাদান, অবৈধ খনি পরিচালিত হচ্ছে। আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গড়ে তাদের সব রাজ্যের জন্য আরাবল্লীর একটি সাধারণ সংজ্ঞা নিরুপণ করার নির্দেশ দেয়। ২০২৫ সালের ৩ অক্টোবর এই কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের 'পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে'র মাধ্যমে তাদের রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়।
সেই রিপোর্টে তারা আরাবল্লী পাহাড় এবং পর্বত শৃঙ্খলার সংজ্ঞা নিরুপণ করে জানায়, আরাবল্লীর যে কোনও পাহাড়ের ক্ষেত্রেই পাহাড় শুরুর জায়গা থেকে চূড়া পর্যন্ত ১০০ মিটারের উচ্চতা সম্পন্ন কোনও পাহাড়কেই পাহাড় হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে এবং ১০০ মিটার বা তার বেশি উচ্চতা সম্পন্ন দু’টি পাহাড় যদি ৫০০ মিটার বা তার কম দূরত্বে অবস্থান করে তবেই তাকে পর্বত শৃঙ্খলা হিসাবে ধরা হবে।
বিষয়টা আপাতভাবে সরল। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে এর ভেতরের খেলাটা বেরিয়ে আসবে। প্রথমত পাহাড়ের উচ্চতা পরিমাপ হয় সমুদ্র পৃষ্ঠ (Sea Level) থেকে। এক্ষেত্রে তা হয়নি। Forest Survey of India-র তথ্য অনুযায়ী আরাবল্লী পর্বতমালার মোট পাহাড়ের সংখ্যা ১২,০৮১ এবং এর মধ্যে মাত্র ১০৪৮ টি অর্থাৎ ৮.৭ শতাংশ পাহাড়ের উচ্চতা ১০০ মিটার বা তার বেশি। অর্থাৎ ১১,০৩৩ টি (প্রায় ৯১.৩ শতাংশ) পাহাড় নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী আর পাহাড় হিসাবে গণ্য হবে না। অর্থাৎ প্রথমে ১০০ মিটারের কম উচ্চতা সম্পন্ন পাহাড়গুলি ধ্বংস হবে তার পর ৫০০ মিটারের গেরোয় পড়ে বাকি ৮.৭ শতাংশ ১০০ মিটারের থেকে উঁচু পাহাড়গুলিও ধ্বংস হবে।
কেন এমন সংজ্ঞার সূত্রায়ন? লুটের ধনতন্ত্রের (Crony Capitalism) যুগে পুঁজিবাদীরা সরকারের মধ্যে নিজেদের বন্ধু খুঁজে নেয়। ভারতবর্ষে বর্তমানে সরকারগুলিই পরিচালিত হচ্ছে লুটের ধনতন্ত্রী কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের দরকার মুনাফা - আরও মুনাফা। তার জন্য জল, জঙ্গল, নদী, পাহাড় সব কিছুকেই গ্রাস করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।
দস্তা, তামা, সীসা, (সোনা, টাংস্টেনের থাকার সম্ভাবনাও আছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে) প্রভৃতি খনিজ এবং মার্বেল (বিশেষ করে গোলাপি রঙের কোয়ার্টজ), চুনাপাথর, গ্রানাইট, বেলেপাথর, জিপসাম, সাবানপাথর, সিলিকা বালি, মাইকা, শিলা ফসফেট, পাইরোফাইলাইট, অ্যাসবেস্টস, কায়ানাইট, বেরিল ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আরাবল্লী রেঞ্জ এখন তাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যকে পূরণ করার উদ্দেশ্যেই ‘মাকে নাম এক পেড়’ স্লোগান ভুলে আরাবল্লীর নতুন সংজ্ঞায়ন। তাতে দিল্লি সহ গাঙ্গেয় উপত্যকার পরিবেশ ধ্বংস হলেই বা ক্ষতি কি? আর সফল হলে পড়ে রইল দেশের অন্য অঞ্চল, ভবিষ্যতের মুনাফার জন্য। আন্দামান নিকোবর অপেক্ষা করছে লাইনে।
তবে দিল্লির সরকার বসে নেই। দিল্লির দূষণকে কমানোর জন্য তাদের পদক্ষেপ জারি আছে। 'দিল্লি পলিউশন কন্ট্রোল কমিটি' দূষণের মূল কারণ খুঁজে বের করেছে। তাদের হিসাবে দিল্লির মূল কারণ হলো মোগলাই ও তন্দুর খানা তৈরির জন্য ব্যবহৃত কয়লার আগুন থেকে তৈরি হওয়া ধোঁয়া। আদেশ জারি হয়েছে অবিলম্বে কয়লার বদলে গ্যাস বা এয়ার ফ্রাইয়ারের ব্যবহার। অন্যথায় ১ হাজার টাকা থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে।
পুরানো দিল্লি প্রধানত লাল কেল্লা, জামা মসজিদ সংলগ্ন এলাকা পৃথিবীর রসনাপ্রিয় মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় মোগলাই খাবার আর তন্দুর বা কাবাবের জন্য। কাবাব এবং তন্দুরের স্বাদ এবং গন্ধ আসে কাঠ-কয়লার আঁচে রান্না হওয়ার কারণে। কয়লার বদলে গ্যাস বা এয়ার ফ্রাইয়ারে তৈরি তন্দুর, কাবাব বা অন্যান্য খাবারে এই স্বাদ গন্ধ থাকবে না।। ফলে চাহিদা কমবে। মার খাবে ব্যবসা। এই ব্যবসায় প্রধানত যুক্ত মুসলমান সম্প্রদায় এবং পাঞ্জাবিরা। দূষণের নামে আমিষকে আটকানোর নতুন পদ্ধতির উদ্ভব হলো। ওই সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের আর্থিকভাবে আঘাত করাও সম্ভব হলো। মেরুকরণও হলো। দূষণ বিরোধী পদক্ষেপের প্রচারও হলো।
Aravalli Air Pollution
দিল্লি দূষণ - আরাবল্লী - মোগলাই খানা
×
Comments :0