Assam Elephant Death

উন্নয়নের বলিদান

সম্পাদকীয় বিভাগ

আসামের বনাঞ্চলে 'রাজধানী এক্সপ্রেস'-এর ধাক্কায় হাতির মৃত্যু কোনও বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়; বরং এটি একটি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। যখন একটি দেশ তার 'জাতীয় ঐতিহ্যবাহী পশু'কে দ্রুতগামী ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হতে দেখে, তখন বুঝতে হবে সেই দেশের উন্নয়নের দর্শনেই বড় ধরনের গলদ রয়েছে। উন্নয়নের এই মরণনেশায় পরিবেশ আজ গুরুত্বহীন, আর বন্যপ্রাণী কেবল সংখ্যামাত্র।
আসামে প্রায় ৫,৭০০-এর বেশি এশীয় হাতির বাস। কিন্তু এই বিশাল প্রাণীকুলের চলাচলের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রেললাইন। আসামের লুমডিং-লাম্পু, দীপোর বিল এবং কাজিরাঙা সংলগ্ন এলাকায় রেললাইনগুলো হাতির প্রাচীন চলাচলের পথ বা 'করিডোর'কে দ্বিখণ্ডিত করেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে ভারতে ট্রেনের ধাক্কায় ২০০-র বেশি হাতির মৃত্যু হয়েছে, যার সিংহভাগই ঘটেছে আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে। রাজধানী বা বন্দেভারতের মতো উচ্চগতির ট্রেনগুলো যখন এই স্পর্শকাতর এলাকা দিয়ে যায়, তখন চালকের পক্ষে ব্রেক কষে এই বিশালকায় প্রাণীদের বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। সরকার 'গজরাজ সুরক্ষা' বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক 'ইন্ট্রিউশন ডিটেকশন সিস্টেম'-এর কথা ঘোষণা করেছে। অপটিক্যাল ফাইবার সেন্সর ব্যবহার করে হাতি শনাক্ত করার যে প্রকল্পের ঢাকঢোল পেটানো হয়, তার প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত। আসামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ করিডোরে এখনও এই প্রযুক্তি পৌঁছায়নি। রেল মন্ত্রক এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট। রেল চায় গতি, আর বন দপ্তর চায় সুরক্ষা— এই দুইয়ের টানাপোড়েনে প্রাণ যায় বন্যপ্রাণীর। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও করিডোরগুলোতে ট্রেনের গতিবেগ সীমিত রাখার নিয়ম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লঙ্ঘন করা হয়। হাতিকে পরিবেশবিজ্ঞানে 'আম্ব্রেলা স্পিসিস' বা 'ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার' বলা হয়। একটি হাতি দিনে প্রায় ২০০-২৫০ কেজি খাদ্য গ্রহণ করে এবং মাইলের পর মাইল চরে বেড়ায়। তাদের বিষ্ঠার মাধ্যমে বনের গভীরে বীজের বিস্তার ঘটে। হাতির করিডোর ধ্বংস হওয়ার অর্থ হলো বনের স্বাভাবিক পুনর্জন্ম প্রক্রিয়া থমকে যাওয়া। বন সংকুচিত হওয়ায় হাতিরা লোকালয়ে হানা দিচ্ছে, যার ফলে প্রতি বছর ভারতে প্রায় ৫০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। অর্থাৎ, পরিবেশ রক্ষা না করলে মানুষও নিরাপদ নয়।
১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা) আইনের ৫-এ ধারা অনুযায়ী জাতীয় বন্যপ্রাণী পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বড় বড় পরিকাঠামো প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই পর্ষদ খুব সহজেই 'ক্লিয়ারেন্স' দিয়ে দিচ্ছে। 'প্রজেক্ট এলিফ্যান্ট' (১৯৯২) থাকা সত্ত্বেও হাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। সংবিধানের ৪৮-এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে বাধ্য, কিন্তু বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোয় সেই অঙ্গীকার কেবল কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ।
উন্নয়নকে অস্বীকার না করেও হাতি বাঁচানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন— করিডোরগুলোতে পর্যাপ্ত আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণ। অতি স্পর্শকাতর বনাঞ্চল এড়িয়ে নতুন রেলপথের নকশা তৈরি করা অথবা বনাঞ্চল এলাকা দিয়ে যাওয়ার রেলপথকে মাটির তলা অথবা ব্রিজ দিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। বন্যপ্রাণী হত্যার দায়ে সংশ্লিষ্ট আধিকারিক ও চালকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনাও জরুরি।
শুধুমাত্র জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি দিয়ে সভ্যতার মাপকাঠি নির্ধারিত হয় না; বরং একটি রাষ্ট্র তার অন্যান্য প্রাণীদের প্রতি কতটা সহনশীল, তা দিয়েই সভ্যতার আসল পরিচয় পাওয়া যায়। আসামের রেললাইনের রক্তদাগ মুছে ফেলা যাবে না যতক্ষণ না আমরা বুঝব যে, বন্যপ্রাণী ছাড়া এই পৃথিবী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তথাকথিত এই 'গতি'র আড়ালে আমরা অদূর ভবিষ্যতে এক প্রাণহীন মরুভূমির দিকে ধাবিত হবো।

Comments :0

Login to leave a comment