Mohan Bhagwat

বামপন্থীদের প্রচারের ধাক্কা ভাগবতের সওয়াল-জবাবের সভায়

জাতীয় রাজ্য

  সভা আরএসএস-র। হল ভরতি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতা, কর্মী, সমর্থক। কিন্তু সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতা মোহন ভাগবতকে উত্তর দিতে হলো বামপন্থীদের তোলা প্রশ্নের। এক নয় একাধিক। যাঁরা সেই প্রশ্নগুলি করলেন লিখিত আকারে, তাঁরাও সঙ্ঘের সমর্থক। কিন্তু কমিউনিস্টদের ধারাবাহিক প্রচার তাঁদেরও সঙ্ঘের, হিন্দুত্ববাদের দর্শন সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত করেছে। প্রশ্নগুলি তারই প্রমাণ।
রবিবার সায়েন্স সিটির সভাগৃহে আরএসএস-র ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক আলোচনাসভা হয়। প্রধান বক্তা ছিলেন সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। মূলত কলকাতার বিভিন্ন ক্ষেত্রের নামজাদা ব্যক্তিদের মধ্যে বাছাবাছা কয়েকজন সভায় উপস্থিত ছিলেন। যেমন মমতা শঙ্কর, চিকিৎসক জয়ন্ত চৌধুরি। এছাড়া বেশিরভাগই ছিলেন সঙ্ঘের, বিজেপি’র নেতা, কর্মী, সমর্থকরা। বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও ছিলেন। তিনটি পর্বে সভা হয়। দুই পর্বে ভাষণ দিয়েছেন ভাগবত। তৃতীয় পর্বে ছিল প্রশ্নোত্তর। 
প্রশ্নোত্তর পর্বে মমতা চাওলা নামে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেন যে, বামপন্থীরা বলে সঙ্ঘ মনুস্মৃতি মেনে চলে। মনুস্মৃতি মহিলাদের বিরোধী। এই বিষয়ে সরসঙ্ঘচালকের মতামত কী? মোহন ভাগবত গোড়াতেই বলেন,‘‘সঙ্ঘ মনুস্মৃতি মেনে চলে না। সঙ্ঘের নিজস্ব গঠনতন্ত্র আছে।’’ তারপর দাবি করেন,‘‘সঙ্ঘ মহিলাদের বিরোধী নয়। সঙ্ঘ মহিলাদের সন্মান করে। আমি আমার পরিবারের তৃতীয় পুরুষ যে সঙ্ঘে যুক্ত। পরিবারের মহিলাদের সহায়তা না পেলে আমার পক্ষে কী তা সম্ভব হতো?’’ এই জবাবে দু’টি বিষয় আছে। প্রথমত, মনুস্মৃতির দায়িত্ব ঝেড়ে ফেললেন ভাগবত। হিন্দুত্ববাদের ভিত্তি মনুস্মৃতিতে মহিলাদের সম্পর্কে যা লেখা আছে, তা উচিত নাকি অনুচিত, সেই আলোচনার ধারেকাছে যাননি মোহন ভাবত। যদিও সঙ্ঘের ‘গুরুজী’ গোলওয়ালকারের লেখায় অনেকবার মনুস্মৃতির উল্লেখ আছে। দ্বিতীয়ত, সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক হতে পারেন শুধু পুরুষ। মহিলারা স্বয়ংসেবক হতে পারেন না। তাদের জন্য আলাদা সংগঠন—  ‘রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি।’ ১৯৩৬-এ এই সংগঠনের জন্ম। তার আগে তৎকালীন সরসঙ্ঘচালকের হেডগেওয়ারের কাছে মহিলাদের আরএসএস-এ কাজ করার সুযোগ দেওয়ার আবেদন জানান কয়েকজন। কিন্তু হেডগেওয়ার সেই সুযোগ দেননি। বিস্তর আলোচনার পর আলাদা সংগঠন, ‘সেবিকা সমিতি’ গড়ার অনুমতি দেন। মহিলাদের এইভাবে সমাজ গঠনের কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন থেকে দূরে রাখার সঙ্ঘের দর্শনের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা লাগাতার প্রচার করে। তারই প্রভাব পড়েছে এদিনের প্রশ্নোত্তর পর্বে।
আর একজন মোহন ভাগবতকে এদিন প্রশ্ন করেন, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি টাকায় মন্দির বানানো হচ্ছে। যেমন দীঘায় হয়েছে। এটা কী কোনও সরকার করতে পারে? সঙ্ঘের কী মনোভাব? এই প্রশ্নের জবাবে মোহন ভাগবত প্রথমেই বলেন,‘‘আমাদের সংবিধানে ওই যে দু’টি কথা আছে, কী আছে? সেকুলার এবং সোসালিস্ট। সেই অনুসারে সরকার মন্দির বানাতে পারে না।’’ অর্থাৎ ‘সেকুলার’ এবং ‘সোসালিস্ট’ শব্দদু’টির কারণে ভারতের সংবিধান সরকারি খরচে মন্দির বানাতে পারে না বলে মোহন ভাগবতের মত। উল্লেখ্য, ভারতের সংবিধান থেকে ওই দু’টি শব্দ তুলে দেওয়ার পক্ষপাতি সঙ্ঘ এবং বিজেপি। এই নিয়ে তারা সংসদের ভিতরে অনেকবার আলোচনা তুলেছে। ওই দু’টি শব্দ সংবিধানে যুক্ত করার জন্য বামপন্থীদের এবং জওহরলাল নেহরু সহ কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন প্রয়াত নেতার তারা তীব্র সমালোচনা করে। এদিন ওই প্রশ্নের উত্তরে এরপর মোহন ভাগবত বলেন,‘‘সোমনাথ মন্দির তৈরি হয়েছিল। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল সেই মন্দির উদ্বোধনে গেছিলেন। রাষ্ট্রপতিও গেছিলেন। কিন্তু সেই মন্দির হয়েছিল মানুষের থেকে সংগৃহীত টাকায়। সরকারের টাকায় মন্দির না হওয়াই উচিত।’’ পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির সরকার দীঘায় মন্দির বানিয়েছে। আরও কিছু জায়গায় মন্দির বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘ এবং বিজেপি’র মনোভাব হলো, সরকার এটা করতে পারে। তাই দীঘার মন্দির নির্মাণে আমন্ত্রণ পেয়ে চলে গেছিলেন সঙ্ঘের দীর্ঘদিনের প্রচারক, বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ। কিন্তু কে বড় হিন্দু তার প্রতিযোগিতায় সরকারি টাকায় মন্দির বানিয়ে মমতা ব্যানার্জি কিছুটা এগিয়ে যাচ্ছেন বলেও বিজেপি নেতাদের আশঙ্কা। তাঁরা এই বিষয়ে মোহন ভাগবতকে একাধিকবার জানিয়েছেন তাঁদের এই সঙ্কটের কথা। এই ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) ধারাবাহিক ভাবে প্রচার করছে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের কথা। সরকারি টাকায় কোনও ধর্মস্থান তৈরি হতে পারে না, পার্টি তা সোচ্চারে বলছে। বামপন্থীদের এই প্রচারের চাপও পড়েছে বিজেপি এবং সঙ্ঘের অন্দরে। এদিনের প্রশ্ন এসেছে সেই সূত্রেই। মোহন ভাগবতের উত্তরে অবশ্য একটি ভাঁজ আছে। যদি সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দদু’টি না থাকে তাহলে কী সরকারি টাকায় মন্দির বানানো ন্যায্য—  ভাগবত এই প্রশ্ন রেখে গেলেন তাঁর জবাবে।
শুভেন্দু অধিকারী প্রশ্ন করেন, রাজ্যে ‘ইসলামিক কট্টরবাদ’-এর প্রভাব বৃদ্ধি, বাংলাদেশে বর্তমান হিংসাত্মক ঘটনা নিয়ে। তাঁর জবাবে মোহন ভাগবত বলেছেন,‘‘পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের ঘটনার প্রভাব আছে। আপনার বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত।’’ এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন,‘‘সীমান্ত পেরিয়ে কে আসবেন সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। হিন্দুদের জন্য সেই ব্যবস্থার সুযোগ অন্য কেউ নিচ্ছে কিনা, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।’’ অর্থাৎ বাংলাদেশের হিন্দুরা এলে ‘শরণার্থী’ আর মুসলমানরা এলে ‘অনুপ্রবেশকারী’। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর আক্রমণ বিষয়ে শুভেন্দুর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন,‘‘ভারত সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে পরিস্থিতি বদলে যেতে সময় লাগবে না।’’
ভারতের বিদেশ নীতি সম্পর্কিত প্রশ্নে সঙ্ঘ প্রধান বলেছেন,‘‘আন্তর্জাতিক সুরক্ষা পরিষদে ভারতকে যাতে আসন দিতে বাধ্য হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিদেশনীতি ঠিকই আছে। তবে তার গতি বাড়াতে হবে।’’
এই সাংবিধানিক কাঠামোয় দেশ ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হতে পারে কিনা, কবে তা ঘোষিত হতে পারে, এই প্রশ্ন করেছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর পরিবারের সদস্য চন্দ্র বসু। ভাগবত বলেছেন,‘‘সংসদে কী বললো, কী বলল না, তাতে কিছু যায় আসে না। ভারতে একজন হিন্দুও বেঁচে থাকলে এই দেশ হিন্দু রাষ্ট্র।’’

Comments :0

Login to leave a comment