আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ঠিক কেমন হতে চলেছে তার ছোটখাট মহড়া সেরে নিয়েছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। নদীয়া জেলার কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন। গত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এরাজ্যে উপনির্বাচনে শাসক দল হারে না। সাধারণ ভোটারদের ভোটে জেতা সম্ভব না হলেও প্রশাসন ও পুলিশ নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করে জোর জবরদস্তি জিততেই হবে। তথাকথিত গণতন্ত্র আছে। নির্বাচন কমিশন আছে। নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোট পর্বে সরকারি প্রশাসন ও পুলিশ আছে। কিন্তু নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে নিজের পছন্দ মতো ভোটদানের অধিকার বেশিরভাগ ভোটারের নেই। গুন্ডা-দুষ্কৃতীদের নিয়ে এমন এক ভয়াল পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয় যেখানে শাসক দলের বিরুদ্ধে কোনও অবস্থান নেওয়া শুধু বিপজ্জনকই নয়, অনেক সময় সেটা প্রাণঘাতীও হতে পারে। অর্থাৎ ভোটে তৃণমূলকে জেতাতেই হবে। তারজন্য যেভাবেই হোক আর যে কোনও মূল্যেই হোক আগাম পরিকল্পনা করে ব্যবস্থাপনা সাজিয়ে রাখতে হবে। কোন বুথে বা কোন অঞ্চলে কত ভোটে মার্জিন দিতে হবে টার্গেট বেঁধে দেওয়া হয়। যেখানে বিরোধীরা শক্তিশালী অথবা মানুষ বিরূপ সেখানে ভোটের কয়েকদিন আগে থেকেই হুমকি বার্তা পৌঁছে দেওয়া। অল্প হুমকিতে কাজ হলে ভালো না হলে ভয় ধরিয়ে দিতে হবে। ভিটে মাটি ছাড়া, রুজি বন্ধ করা, এক ঘরে করে দেওয়া থেকে শুরু করে খুনের হুমকি পর্যন্ত কোনও কিছুই বাদ যায় না। প্রয়োজনে মারধর বা রাতবিরেতে বাড়িতে হামলা করে আগাম জানান দেওয়া হয়। সর্বত্র গুন্ডা, মস্তান, দাগী অপরাধী জড়ো করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ছক অনুযায়ী ভোট করার দায়িত্ব তাদের। সঙ্গে থাকে অভয় বার্তা। যত অপরাধই করুক না দল, সরকার, পুলিশ তাদের রক্ষা করবে। অতএব খুন করতেও আর অসুবিধা নেই।
কালীগঞ্জেও এই ধারার অন্যথা হয়নি। তবে প্রকাশ্যে ভোটের দিন পর্যন্ত বড়সড় কোনও গোলমাল হয়নি। যা কিছু অপারেশন সব হয়েছে আড়ালে আবডালে। মুখ খোলার দুঃসাহস যাতে কেউ দেখাতে না পারে তা নিখুঁতভাবে হয়েছে। দুষ্কৃতীদের কড়া নজরদারিতে ভোট হয়েছে। পকেটে বোমা-বন্দুক উঁকি মেরেছে। সাধারণ মানুষ দেখে শিউরে উঠলেও পুলিশ কিছুই দেখেনি। ভোটের পথেই আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে কি করতে হবে। তে কিছুর পরও শাসক প্রার্থী জিতেছে বটে তবে আগের থেকে ভোট কমেছে। ভোট কমেছে বিজেপি প্রার্থীরও। কিন্তু অল্প হলেও ভোট বেড়েছে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর।
চেনা ছকে প্রত্যাশিতভাবেই জিতেছে শাসক দল। ভোট যদি রাজনৈতিক আদর্শের লড়াই হয় তাহলে জিতলে আনন্দ হবারই কথা। কিন্তু সেটা যদি প্রভুত্ব বা আধিপত্য রক্ষার লড়াই হয়, চুরি-দুর্নীতি-লুঠতরাজের লড়াই হয় তাহলে আনন্দ প্রতিফলিত উন্মত্ততায়, উদ্দামতায়। সেই জয়ে আনন্দ-আবেগ থাকে না। বদলে হিংসার বাহুল্যে নৃশংসতা ও বর্বরতার উৎসবে পরিণত হয়। কালীগঞ্জে তেমনটাই হয়েছে। গণনা শেষের অনেক আগেই যখন মনে হয়েছিল জয় নিশ্চিত সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে বিজয় মিছিল। বিজয়ীর মুখে থাকে আবেগঘন আনন্দের অভিব্যক্তি। কিন্তু এই মিছিলে ছিল হিংসার, ঘৃণার মুখাবয়ব। সঙ্গে আবীর বা আতশ বাজি ছিল না। ছিল বোমা, বন্দুক। মানুষের সঙ্গে আনন্দ বিনিময়ের জন্য এই মিছিল ছিল না। ছিল বিরোধী, বিশেষ করে সিপিআই (এম) সমর্থকদের হাড়হিম করার বার্তা দেওয়া। তাই মিছিল থেকে বোমা ছোঁড়া হয়েছে সিপিআই(এম) সমর্থকদের বাড়ি লক্ষ্য করে একের পর এক। সেই বোমার আঘাতে মরতে হলো দশ বছরের এক শিশু কন্যাকে। মমতা ব্যানার্জি ও অভিষেক ব্যানার্জির ছবি নিয়ে নিষ্পাপ শিশুকে খুন করে তারা জোরালো বার্তা দিতে চেয়েছে তৃণমূলকে ভোট না দিলে কী হতে পারে। আগামী বিধানসভা ভোটের সময় এটা যেন সবাই মনে রাখে।
Editorial
ভোটের মহড়া

×
Comments :0