গল্প
পলিট্যাকটিক্স ইউনিভার্সিটি
তুষার বসু
মুক্তধারা
-সন্তুটাকে কিসে ভর্তি করা যায় বলতো? - বলতে বলতে আমি আমাদের বৈকালিক আড্ডার ঠেক রঞ্জিতের সাইকেল সারাইয়ের দোকানের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। সেখানে আগে থেকেই বিশ্বনাথ, হিমাদ্রী আর সঞ্জীব বসে ছিল। হিমাদ্রী আর সঞ্জীব টিউশনি করে ভালোমতো। বিশ্বনাথ হাইস্কুলের শিক্ষক।সকলেই আধুনিক
বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যক্রম নিয়ে ওয়াকিবহাল বলেই আমার ধারণা। আমার ভাইপো সন্তু এবছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। আশা করা যায় ফার্স্ট ডিভিশনেই পাশ করবে। --
জেনারেল লাইনে পড়ে যে বিশেষ কিছু হবে না তা তো তুই জানিস। এই আমাদের মতো টিউশনি ছাড়া গতি নেই। বলল সঞ্জীব। -- ঠিকই বলেছিস,-হিমাদ্রী বলল। আইটিআইতে একবার দেখতে পারিস, অনেক রকম ট্রেড আছে।-- সে চান্স পেলে না হয় পড়বে। তবে প্রাইভেট কলেজে পড়া যায়, কিন্তু খরচটা বোধহয় দাদা টানতে পারবেনা।- আমি বলি।- জয়েন্টে বসছে তো? বিশ্বনাথ জানতে চায়।- হ্যাঁ, তা বসেছে। তবে সেখানেও বোধহয় প্রাইভেট কলেজই জুটবে। আমরা আবার জেনারেল কাস্ট।
ওরা একে একে নানান প্রস্তাব পেশ করে, কিন্তু ঠিকমতো সিদ্ধান্তে পৌঁছান যাচ্ছেনা।
-তা কি নিয়ে বাবুদের আলোচনা চলছে? ভবিষ্যৎ পাঠ-পরিকল্পনা?
প্রশ্নটা শুনে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি দরজার পাশ থেকে বকের মতো গলা বাড়িয়ে বরেনদা কথাটা ছুঁড়ে দিয়েছে। বরেনদা একটু খ্যাপাটে লোক। পড়াশোনায় নাকি বেশ ভালো ছিলো। কিন্তু ওই খ্যাপাটে স্বভাবের জন্যে চাকরি-বাকরি পায়নি। মায়ের পেনশনের টাকায় দিব্যি চলে যায় বলে সে চেষ্টাতেও সময় নষ্ট করেনি। যখন যা মনে হয় তাই নিয়ে লড়ে যায়। ‘কানানদীতে কালো পচা দুর্গন্ধযুক্ত জল এসেছে কেন ?’’ ‘'রাস্তার ধারে লাগানো গাছ কাটা হচ্ছে কেন? ‘’ ‘’ নদীর পাড় দখল করে বাড়ি উঠছে কেন?’’ ইত্যাদি হরেক প্রশ্ন বরেনদা খবরের কাগজে আলতা দিয়ে পোস্টার লিখে গাছে গাছে বা দেয়ালে দেয়ালে টাঙিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য বরেনদার তোলা এই প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। বরেনদা তাতে দমে যায়না, আবার একটা নতুন প্রশ্ন নিয়ে প্রচারে মত্ত হয়ে যায়। এহেন বরেনদা হঠাৎ আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছে দেখে আমরা চুপ করে যাই।
--ও তোমার ভাইপো সন্তু উচ্চমাধ্যমিকের পর কি পড়বে, তাই তো? - প্রশ্নটা আমার দিকে তাকিয়েই করে বরেনদা। আমি তাকে পাত্তা না দেবার মতো করে বলি - হ্যাঁ, ওই আরকি…।
-- তাহলে আমি বলি শোনো।- বলে বরেনদা হিমাদ্রীকে ঠেলে সরিয়ে বেঞ্চিতে জায়গা করে নিয়ে বেশ জুত করে বসলো।
-আমাদের এক্ষুনি একটা বিশ্ববিদ্যালয় খোলা উচিত। বরেনদা বলে ওঠে। আমরা তো থ। এরই মধ্যে এরাজ্যে নয় নয় করে ছেচল্লিশটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। আরো একটা খুলতে হবে!!
--কেন, বিশ্ববিদ্যালয় কি কম পড়িয়াছে? বিশ্বনাথ জানতে চায়।
-- তা কম পড়িয়াছে বৈকি। দ্যাখ, এরাজ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুনতিতে ৩৫টা, আর বেসরকারি ১১টা। লেখাপড়া, চাষবাস,বাড়ি তৈরি, মেশিন তৈরি, উকিল বানানো, হ্যানা-ত্যানা করে এই ছেচল্লিশটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসল বিদ্যে শিক্ষারই কোনও ব্যবস্থা হয়নি। এইসব ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, গোল্ড মেডেল-টেডেল নিয়ে পাশ করা হেব্বি হেব্বি পন্ডিতদেরও কাদের কাছে গিয়ে হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ করে হাত কচলাতে হয়? বলতে পারলিনা তো? সেটাই হলো আসল।
আমরা হাঁ করে বরেনদার কথা শুনছি আর আকাশ পাতাল ভাবছি। এরকম পেশা কার হতে পারে যার কাছে বড়ো বড়ো পন্ডিতরাও হাত কচলাবে! বিশ্বনাথের মাথা এসব ব্যাপারে একটু বেশি খেলে, কুইজ-টুইজে প্রাইজও পেয়েছে। ওই শেষ পর্যন্ত বলে
--ও, মন্ত্রীদের মানে রাজনৈতিক নেতাদের কথা বলছো?
--কারেক্ট, এইজন্যেই তোদের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। কতো সহজে বুঝে যাস ব্যাপারগুলো। শোন সবথেকে গ্লামারাস আর আয়বহুল পেশার জন্যেই কোনো টিউটোরিয়াল, মানে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়নি। এই অভাবটা এখনই পূরণ করা উচিত।
ধর বি,আই,পি, এম,আই পি,ডিগ্রি দেওয়া হলো।
--এসব কি আজেবাজে বকছো শুনি। আর বি,আইপি, এম আই পি ডিগ্রিই বা কি? সমস্বরে জানতে চাই আমরা
--তাহলে মোহনের দোকান থেকে ১০টাকার চা নিয়ে আয় বলছি।
চা আসে। চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বরেনদা বলে - ধর বি,আই,পি হলো ব্যাচেলার ইন ইন্ডিয়ান পলিটিক্স। আর এম,আই, পি হলো—
--মাস্টার ইন ইন্ডিয়ান পলিটিক্স। --বাক্যটা সম্পূর্ণ করে হিমাদ্রী।
--'হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস। তারপর ধর অনার্সও থাকবে।
বি,আই,পি ল্যাস হন্স। বি,আই,পি পার হন্স। মানে অনার্স ইন লেজিসটেটিভ অ্যাসেম্বলি, অনার্স ইন পার্লামেন্ট। এম,আই,পিতে আবার স্পেশালাইজেশন থাকবে। এম,আই,পি ইন সেন্ট্রাল মিনিস্টার, এম,আই,পি ইন স্টেট মিনিস্টার ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিকঠাক ভাবে শিখতে পারলে বিধায়ক বা সাংসদ হওয়া ঠেকায় কে? পাঠ্যক্রমে থাকবে রিগিং, বুথদখল, ছাপ্পাভোট, দলভাঙানো,পালটি খাওয়া, গুড়বাতাসা কি নকুলদানা খাওয়ানো, চড়াম চড়াম বাজনা বাজানো, থান পাঠানো ইত্যাদি নানান বাস্তবসম্মত ব্যবস্থাবলী।থিওরিটিক্যাল আর প্র্যাকটিক্যাল দু ধরনের শিক্ষারই ব্যবস্থা থাকবে। মাস্টার্স করলে মন্ত্রীত্ব, সেন্ট্রাল, স্টেট বা মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান। আর হ্যাঁ, নিত্য নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য গবেষণা করলে পি,এইচ,ডিও দেওয়া হবে। তাহলে বুঝলি তো আমি একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা কেন বলেছি। -বলে থামলো বরেনদা।
এমন আশ্চর্য পাঠ্যক্রমের কথা শুনে আমাদের মুখ দিয়ে আর বাক্য সরেনা।
-সবই তো ঠিক আছে, আমি ভাবছি কি নাম দেওয়া যায় এই ইউনিভার্সিটির। - বরেনদাকে চিন্তিত দেখায়। আমি বলি -আচ্ছা, পলিটিক্যাল ট্যাকটিক্স ইউনিভার্সিটি দিলে হয় না? মানে পলিটিক্সের ট্যাকটিক্সই তো শেখাতে চাইছো।!
কথাটা লুফে নেয় বরেনদা - ব্র্যাভো! ঠিক বলেছিস তো। তবে একটু ছোট করে পলিটিক্সের মাঝখানে ট্যাকটাকে ঢুকিয়ে দিলে একেবারে মার কাটারি নাম হয়ে যাবে - পলিট্যাকটিক্স ইউনিভার্সিটি। তোর হবে, বুঝলি বুধো। এক কাজ কর তুই ভালোভাবে একটা সিলেবাস তৈরি করে ফ্যাল। তারপর এটা নিয়ে কাগজে লেখালিখি করা যাবেখন।।
শেষ পর্যন্ত বিশ্বনাথ বলে ওঠে - তা, তোমার ইউনিভার্সিটিতে পাশকোর্সে পাশ করলে কি হবে?
-কেন? পঞ্চায়েত সদস্য। তাতেও আজকাল আয়পয় নেহাত কম নয়, বুঝলি? - বলে আমাদের কজনকে নির্বাক দাঁড় করিয়ে রেখে বেরিয়ে যায় বরেনদা।
Comments :0