Kalyan Banerjee

ঘুমের ব্যাঘাত, পুলিশ দিয়ে হেনস্তা দুই শ্রমিককে

কলকাতা

 রাজপরিবারের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটলে শাস্তি তো অনিবার্য!
খাস কলকাতাতেই শাস্তিও পেতে হলো গ্রিল কারখানার দুই শ্রমিককে! তাঁদের ‘অপরাধ’, ভোর রাতে কারখানায় লোহার রড নামাতে গিয়ে একটু আওয়াজ হয়েছিল। সেই আওয়াজে ‘বিরক্ত’ হয়েছিলেন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুহূর্তেই ফোন যায় থানায়। হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে ফোন এসেছে বলে কথা, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সক্রিয় হয়ে ওঠে কালীঘাট থানা, যে থানারই এক আধিকারিক ইতিমধ্যে কয়লা পাচারকাণ্ডে মানি লন্ডারিং বা অর্থ নয়ছয়ের তদন্তে ইডি’র জেরার মুখে পড়েছেন।
ভোররাতে ফোন পেয়ে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ওই ছোট্ট গ্রিল কারখানায় এসে দু’জন শ্রমিককে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। কারখানায় লোহার রড নামাতে গিয়ে কেন আওয়াজ হয়েছে, এই অভিযোগে! সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আটকে রাখার পরে তাঁদের ছাড়া হয় উপযুক্ত ‘শিক্ষা’ দিয়েই। পরিণামে ওই কারখানা বন্ধ ছিল শুক্রবার।
এই ছবি খাস মুখ্যমন্ত্রীর পাড়াতেই। নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটেছে বলে পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের— ‘জমিদারি শাসন’-এর ছবিই যেন মহানগর কলকাতায়, ২০২২-এ দাঁড়িয়েও।
ঠিক কী ঘটেছে? হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটেরই এক প্রবীণ বাসিন্দার কথায়, ‘‘এখানে এক পরিবারের রাজ, মুখ ফুটে বলাও সমস্যা।’’ তারপরে তিনি যা জানালেন, তা হলো— হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঢুকে প্রথম বাঁদিকের রাস্তাতেই হিন্দু মিশন আশ্রম রয়েছে। তার বাঁদিকে একটি ছোট্ট কারখানা আছে লেদের, পাশে একটি গ্রিল ফ্যাক্টরি। ৫০-৬০ বছর ধরে ছোট ছোট এমন কারখানা রয়েছে। কোনও দিন কোনও সমস্যা হয়েছে বলে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দারাও বলতে পারছেন না। সাধারণভাবে রাতে কারখানায় কাজও হয় না। তবে বুধবার ভোর রাতে ওই গ্রিল কারখানায় মাল আসে। তাতে লোহার রড নামানোর সময় না কি একটু আওয়াজ হয়েছিল। আর তাতেই পুলিশের কাছে ‘না‍‌লিশ’ যায়। 


এলাকাবাসীর কথায়, ৩৮ নম্বর হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ ব্যানার্জির তরফেই অভিযোগ জানানো হয় পুলিশের কাছে। কারখানাটি থেকে প্রায় ৮-৯টি বাড়ি পরে কল্যাণ ব্যানার্জির বাড়ি, সাধারণভাবে আওয়াজ সেখানে পৌঁছানোরও কথা নয়। কিন্তু অভিযোগ পাওয়ার পরেই ‘অতি তৎপর’ পুলিশ গিয়ে বাদল ও বিপ্লব নামে ওই কারখানার দুই শ্রমিককে তুলে নিয়ে যায়, শুক্রবার রাত পর্যন্ত থানায় আটকে রাখার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। 
গত বেশ কিছু দিন ধরেই মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ায় পাঁচ-ছয় দশক ধরে চলা লেদ কারখানা তুলে দেওয়ার কথা প্রচার করছে শাসক তৃণমূলের একাংশ। লেদ কারখানায় না কি শব্দ হয়! মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ভিভিআইপি এলাকা বলে কথা। সাংসদ কল্যাণ ব্যানার্জিরও না কি অসুবিধা হয় সকালে ওই আওয়াজে। ঘটনা হলো, কালীঘাট রোড থেকে ৪৫ নম্বর হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট পর্যন্ত প্রায় ৮-৯টি ছোট লেদ ও গ্রিল কারখানা আছে। দশকের পর দশক ধরে চলছে, বাড়ির ভিতরে বা ছোট ঘরের সামনে। তাতে কাজও করেন অনেকে। আগে কোনও সমস্যার কথা শোনা যায়নি। এখন কেন? শুধুই নিদ্রায় ব্যাঘাত বা আওয়াজে কাজ করতে অসুবিধা, না কি সিংহভাগ এলাকা নির্দিষ্ট একটি পরিবারের দখলে পরিণত করার পরিকল্পনারই অংশ এই ঘটনাক্রম?
হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে হরিশ মুখার্জি রোড, কালীঘাট রোড ধরে রানি শঙ্করী লেন, বলরাম বসু ঘাট— এই বিস্তীর্ণ তল্লাটে সর্বগ্রাসী দাপট কেবল একটি প্রভাবশালী পরিবারেরই। এখন কার্যত মুখ্যমন্ত্রীর দাদা-ভাইদের দখলেই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট ও কালীঘাট রোডের সিংহভাগ এলাকা। শহরের এই প্রান্তে অনুপ্রেরণার ছোঁয়ায় একের পর এক পরিবার হয় জমি বেচে দিচ্ছে নয়তো জোর করে উচ্ছেদের মুখে। মূলত যাদের আর্থিক ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি কম, সেই সব পরিবারই ‘টার্গেট’। জমি মাফিয়ার শহুরে সংস্করণ কী হতে পারে, তার ভয়াবহ উদাহরণ হয়ে উঠছে এই তল্লাট। কালীঘাট মোড় থেকে ৫০০ গজ দূরত্বের মধ্যেই রয়েছে এমন ১৭টি প্লট, যার প্রত্যেকটির দখলদারি এখন ব্যানার্জি পরিবারের হাতে। প্রতিটি প্লটের কোনওটা এখন কার্তিক ব্যানার্জি, কোনওটা অজিত ব্যানার্জি, কোনওটা আবার স্বপন ওরফে বাবুন ব্যানার্জির নামে, বেনামে বা দখলে। আদিগঙ্গাও জায়গায় জায়গায় বুজে যাচ্ছে। কেউ বাধা দেওয়ার নেই। প্রশাসনও চোখ বন্ধ করে আছে। তাই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কালীঘাট রোডের একাধিক জমি ও ঘর অনেকেই স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে বাধ্যও হচ্ছেন। কালীঘাট মোড় থেকে কালীঘাট রোডের সপ্তপল্লি ক্লাব পর্যন্ত, অন্যদিকে কালীঘাট মোড় থেকে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ৪৪ কলোনি পর্যন্ত। বিস্তীর্ণ এই এলাকায় এখনও পর্যন্ত ৩৮টি প্লট চলে এসেছে সেই পরিবারের হাতে। 
সেই দখলের জমি বাড়াতেই কি চলছে এমন তৎপরতা? সামান্য অজুহাতে আসলে ওই কারখানাগুলি বন্ধ করে জমি হাতানোর পরিকল্পনা? প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয় বাসিন্দারাই। তবে প্রকাশ্যে নয়, কিছুটা ভয় নিয়েই। তাই কি সামান্য লোহার রড নামানোর আওয়াজে সাধারণ গরিব শ্রমিকদের থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ছোট ছোট লেদ ও গ্রিল কারখানার শ্রমিকরাও এখন এই নতুন আতঙ্কের মুখে।
 

Comments :0

Login to leave a comment