অনাদি সাহু
এবারের মে দিবসের প্রাক্কালে বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের ক্রমর্ধমান সঙ্কট ও মালিক শ্রেণির মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থে শ্রমিক শ্রেণি সহ সর্বস্তরের জনগণের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি দেশে দেশে মাথা তুলছে। আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়লাভ বা ভারতে চরম দক্ষিণপন্থী আরএসএস তথা বিজেপি’র মতো শক্তির জয়লাভ কোনও বিছিন্ন ঘটনা নয়। এরা মুখে চটকদারী জনদরদি কথা বলে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির স্বার্থে, বৃহৎ পুঁজির স্বার্থেই কাজ করছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ ও মধ্য প্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে নতুন করে যুদ্ধ উন্মাদনা তৈরি করা, মার্কিন মদতে ইজরায়েলের, প্যালেস্তাইনে গণহত্যা এবং সিরিয়া, লিবিয়ার উপর আক্রমণ বিছিন্ন ঘটনা নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণি ও শান্তিকামী মানুষ এটা মেনে নিতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদ ও লগ্নিপুঁজির শোষণ ও আধিপত্য বিস্তার বা যুদ্ধের চক্রান্তের বিরুদ্ধে বামপন্থী ও শ্রমিকশ্রেণির লড়াই আগামী দিনে আরও তীব্র করতে হবে। সমস্ত অংশের শ্রমজীবী মানুষ, শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর শেষিত বঞ্চিত মেহনতি শান্তিকামী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
ভারতে মে দিবসের প্রাক্কালে বিজেপি ও আরএসএস এবং আদানি, আম্বানি জোট শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোড লাগু করতে অগ্রসর হচ্ছে। মালিক শ্রেণির আরও মুনাফা বৃদ্ধি করতে শ্রমিক শ্রেণিকে শৃঙ্খলিত করে মধ্যযুগীয় স্বৈরাচারী বর্বর শোষণ ব্যবস্থা কায়েম করতে চাইছে। শ্রমিক শ্রেণির তীব্র প্রতিবাদ ও ধর্মঘটের কারণে ২০১৯-২০ সালে এই শ্রম কোড তৈরি করলেও বিজেপি-আরএসএস এতদিন তা কার্যকর করতে পারেনি। কিন্তু তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদী সরকার শ্রমিক শ্রেণির অর্জিত অধিকার খর্ব করতে অগ্রসর হচ্ছে। বিজেপি-আরএসএস দেশজুড়ে স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী পথে অগ্রসর হতে চাইছে। শ্রম কোড লাগু হলে প্রথমেই দেশের সংগঠিত শিল্পে ৭৫ শতাংশ শ্রমিক শ্রম আইনের বাইরে চলে যাবে। ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার, ন্যূনতম মজুরি, স্থায়ী কাজে স্থায়ী চাকরি, সমকাজে সমবেতন, ধর্মঘট করার অধিকার, শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া, সংগঠিত হওয়ার অধিকার সবই আক্রান্ত হবে। শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘ লড়াই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত অধিকারগুলি কোনও শিল্পে আদায়ের জন্যে সম্মিলিত পদক্ষেপকে এই স্বৈরাচারী শ্রম কোডে অপরাধ বলে গণ্য করা হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোড ২০২০ ত্রয়োদশ চ্যাপ্টারে বলা হয়েছে, ট্রেড ইউনিয়নের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের জন্যে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বদের বিরাট জরিমানা বা জেল ও জরিমানা দুই শাস্তি হতে পারে। শ্রম আইনে আগে এসব কিছু ছিল না। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস) এর ১১১ ধারায় শ্রমিকদের 'সম্মিলিত পদক্ষেপকে সংগঠিত অপরাধ' হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যার ফলে জামিন অযোগ্য ধারায় কারাদণ্ড সহ পুলিশি ব্যবস্থা ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের জন্যে করেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিপতিদের দালাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চোরের মতো এই বিল বিরোধী শূন্য পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে আইন করেছেন। কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে এখন তা কার্যকরী করা হচ্ছে।
এই শ্রম কোড লাগুর মধ্য দিয়ে কর্পোরেট শোষণ ব্যবস্থাকে কলকারখানায় তীব্র করা এবং শ্রমিক শ্রেণির সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। দেশের শ্রমশক্তি ও জাতীয় সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে লুট করাই এর লক্ষ্য। ভারতবর্ষের শ্রমিক শ্রেণি মানবে না।
শুধু তাই নয়, মালিক শ্রেণির দুর্নীতি ও শ্রম আইন ভঙ্গকে লঘু ধারা দিতে নরেন্দ্র মোদী সরকার ‘সংশোধিত জনবিশ্বাস আইন’কে ২০২৩ সালে বলবৎ করেছে। মালিকদের বিরুদ্ধে ১৮০টি কেসকে নিষ্ক্রিয় করেছে ও কারাদণ্ডের বিধানকে প্রত্যাহার করেছে। বর্তমান বছরে বাজেটের প্রাক্কালে আরও ১০০টি অপরাধকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে এবং শ্রম আইন ভঙ্গের অভিযোগ এলেও ভবিষ্যতে শ্রমদপ্তরের পরিদর্শন কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তাই মে দিবসের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের শ্রমিক শ্রেণি আগামী ২০ মে, ২০২৫ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী শ্রমকোড বাতিল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অনুসৃত জনবিরোধী, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী উদার আর্থিক নীতি, আর্থিক সংস্কার কর্মসূচির নামে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কলকারখানা বেসরকারিকরণ, পুঁজিপতিদের তোষণ করে জনগণের উপর বিপুল করের বোঝা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, তীব্র বেকারি, কেন্দ্রীয় ও রাজা সরকারের দপ্তরে লোক নিয়োগ বন্ধ, স্থায়ী কাজে অস্থায়ী চুক্তি ভিত্তিক কর্মী নিয়োগ, শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস, কৃষকদের ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা, শ্রমিক, খেতমজুর ও গরিব মানুষের কাজ না পাওয়া, দেশজুড়ে দারিদ্র, ক্ষুধার্থ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৭ দফা দাবিতে ২০ মে ২০২৫ দেশজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে।
সারা দেশে তার প্রস্তুতি চলছে। রাজ্যে সমস্ত কলকারখানা, গ্রামে গঞ্জে প্রচার চলছে। রাজ্যের শ্রমিক সংগঠনগুলি গত ২৪ মার্চ, ২০২৫ মৌলালি যুব কেন্দ্রে যুক্ত কনভেনশন করে ঐদিন সারা দেশের সাথে রাজ্যে ধর্মঘট সর্বাত্মক করার জন্যে সকলের কাছে আহ্বান জানিয়েছে। পশ্চিমবাংলায় এই ধর্মঘট সফল করতে গত ২০ এপ্রিল, ২০২৫ সিআইটিইউ, সারা ভারত কৃষকসভা, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন, বস্তি উন্নয়ন সমিতির ডাকে ঐতিহাসিক মেহনতি মানুষের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সমাবেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতি, দুর্নীতি, লুটের বিরুদ্ধে, হিন্দুত্বের নামে সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা, ঘৃণার রাজনীতি এবং দেশের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার ব্যবস্থার উপর বিজেপি, আরএসএস, সঙ্ঘ পরিবারের ক্রমবর্দ্ধমান আক্রমণের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছিলেন। দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার চক্রান্ত এবং আমাদের রাজ্যে মুর্শিদাবাদে সামশেরগঞ্জ, ধুলিয়ানে হরগেবিন্দ দাস, চন্দন দাস, পরিযায়ী শ্রমিক ইজাজ শেখের মৃত্যু কোনও বিছিন্ন ঘটনা নয়। সারা দেশে বিজেপি, আরএসএস এবং রাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপি বিভাজন হিংসা ঘৃণার রাজনীতি, মেরুকরণের রাজনাতি আমদানি করছে। গত ১৪ বছর ধরে রাজ্যে একটা শ্রমিক বিরোধী স্বৈরতান্ত্রিক চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দল সরকার চালাচ্ছে। চা বাগানে ১০ বছর মজুরি বৃদ্ধির ইস্যু, জমির ইস্যু ঝুলে আছে। সর্বত্র গুন্ডামি চলছে।
তৃণমূলের দুর্নীতির কারণে ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি চলে গেছে। ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের ভবিষ্যৎ হাইকোর্টে ঝুলে আছে। রাজ্যে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের পথে। চুরির দায়ে শিক্ষা মন্ত্রী ও খাদ্য মন্ত্রী জেলে। রাজ্যে শিল্প হচ্ছে না, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অথৈ জলে, মহিলাদের নিরাপত্তা নেই, আর জি কর কাণ্ডে কর্মরত মহিলা চিকিৎসকের খুন ও ধর্ষণের বিচারকে পুলিশ ও সিবিআই কার্যত প্রহসনে পরিণত করেছে। মমতা ও মোদীর এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে রাজ্যের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সবাইকে প্রতিবাদে আবার নামতে হবে। তৃণমূল ও বিজেপি-কে রাজ্য থেকে হটাতে হবে। রাজ্যকে বাঁচাতে হবে। একইভাবে কর্পোরেট ও বিজেপি-আরএসএস’র অশুভ জোট ও দেশবিরোধী, জাতীয় স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দেশকে রক্ষা করতে হবে। এই লক্ষ্যে ২০ মে-র সর্বভারতীয় ধর্মঘটকে সর্বাত্মক সফল করতে হবে। কলকারখানায়, চা বাগানে, চটকলে, সংগঠিত অসংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে সর্বত্র জোট বাঁধতে হবে। ২০ মে সকাল থেকেই কলকারখানার গেটে থাকতে হবে, রাস্তায় থাকতে হবে।
এই লড়াইতে দেশের কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি, শিল্প ভিত্তিক ফেডারেশনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দেশের কৃষক, খেতমজুর সংগঠনগুলি। সারা দেশের সাথে রাজ্যে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর সহ শ্রমজীবী সমস্ত অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। দেশ বিরোধী, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী ফ্যাসিস্ত বিজেপি-আরএসএস এবং দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরতন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের জনবিরোধী শ্রমিক বিরোধী নীতিকে পরাজিত করতে জেলায় জেলায়, অঞ্চলে অঞ্চলে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, বস্তিবাসীরা জোট বাঁধুন। শ্রমজীবী মানুষের জয় হবেই।
শ্রমিক শ্রেণির অর্জিত অধিকার রক্ষা করুন
২০ মে, ২০২৫ সাধারণ ধর্মঘট সফল করুন।
May Day Resolve
এবারের মে দিবসের আহ্বান

×
Comments :0