rg kar

সিবিআই: তদন্ত না প্রতারণা?

উত্তর সম্পাদকীয়​

ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী

আর জি কর ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডে বিচারহীনতা এবং কেন্দ্র-রাজ্য আঁতাতে কেন্দ্রীয় সংস্থার নিন্দনীয় ভূমিকা

একটি বছর কেটে গেছে। ২০২৪-এর আগস্ট মাসে আর জি কর মেডিকেল কলেজের বক্ষবিভাগের সেমিনার হল থেকে উদ্ধার হয়েছিল এক তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষিত মৃতদেহ। ঘটনাটি নিছক কোনও অপরাধের ঘটনা ছিল না, এর পিছনে ছিল এক পরিকল্পিত পৈশাচিকতা। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে উঠে আসে প্রশাসনিক প্রশ্রয়ে ও রাজনৈতিক মদতে প্রমাণ লোপাটের রাষ্ট্রীয় প্রতিচ্ছবি। আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা, চিকিৎসক ও ছাত্র-যুব-মহিলাদের মিলিত বাধা অগ্রাহ্য করে তড়িঘড়ি শবদাহ, পুলিশ আধিকারিক মারফত বিপুল অর্থের বিনিময়ে তরুণীর পরিবারের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা, ঘটনাস্থল ভেঙে ফেলা— সব মিলিয়ে এই ঘটনায় যে নগ্ন নৃশংসতা শাসক দেখিয়েছে, তা এককথায় বেনজির। যে পুলিশের তদন্ত করে অপরাধীদের ধরার কথা, সেই পুলিশ যখন অপরাধ ধামাচাপা দিতে সক্রিয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই পরিবার চাইল স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত। আমরা চেয়েছিলাম বিচারবিভাগীয় তদন্ত। শেষতক উচ্চ আদালত তদন্তের ভার দিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’র হাতে। যুক্তি ছিল, রাজ্য পুলিশ অপরাধীদের ধরতে ব্যর্থ, তাদেরকে আর বিশ্বাস করা যায় না, সুতরাং কেন্দ্রীয় সংস্থাই দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার নিশ্চিত করবে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও সিবিআই সম্পূর্ণ চার্জশিট পেশ করল না, মূল অভিযুক্তদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করল না, ফরেনসিক রিপোর্টে নানান অসঙ্গতির কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারল না। সিবিআই’র কার্যকলাপ তাই বড়সড় প্রশ্নের মুখে।

কেন্দ্রীয় সংস্থা নাকি কেন্দ্রের পদলেহী?
সিবিআই, ইডি— এগুলি বর্তমান আমলে নামেই ‘স্বাধীন’ সংস্থা, আদতে এগুলি কেন্দ্রীয় শাসকের রাজনৈতিক অভিসন্ধি বাস্তবায়নের হাতিয়ার। পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক দুর্নীতির পাহাড়—সারদা, নারদ, শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি, কয়লা পাচার, গোরু পাচার—এসব মামলায় সিবিআই তদন্ত শুরু করেছিল ঠিকই, কিন্তু বছর পেরোলেও মূল অভিযুক্ত শাস্তি পায়নি। কিছুদিন কিছুজনের বাড়ি বা অফিসে হানা দেবার নাটক, কিছুদিন গ্রেপ্তার, তারপর জামিন ও তদন্ত স্তব্ধ। যেন অভিযুক্তরা রাজ্যের শাসকের ছায়াতলে থাকলেই তাঁদের অপরাধ বিচারের বাইরে চলে যায়। বিশেষত শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়, অথচ সিবিআই, ইডি তদন্ত সম্পূর্ণ করতে ব্যর্থ। সারদা ও নারদ মামলায় অভিযুক্ত নেতারা আজও সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে দন্তবিকশিত দম্ভের বাণী ছড়াচ্ছেন। সিবিআই-ইডি যেন দেখেও না দেখার অভিনয় করছে।
অথচ দেশের অন্য প্রান্তে কী তৎপরতা!
সিবিআই’র দ্বিচারিতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সর্বভারতীয় পরিসরে। যেখানে যে রাজ্যে বিরোধী সরকার আছে, সেখানে সিবিআই ও ইডি’র যৌথ অভিযান অবিরাম:
মহারাষ্ট্রে এনসিপি নেতা নওয়াব মালিক ও অনিল দেশমুখ গ্রেপ্তার হন।
ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন পদত্যাগে বাধ্য হন কয়লা দুর্নীতির মামলায়।
তামিলনাড়ুতে ডিএমকে নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক হানা হয়।
দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল জেল খাটেন। তাঁর সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে মদের নীতির অজুহাতে ইডি-সিবিআই অভিযান চলে।
অথচ পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দফায় দফায় অকাট্য প্রমাণ মেলা সত্ত্বেও সিবিআই কার্যত নিরুত্তাপ। কেন?

আরএসএস’র ছায়াতলে আঁতাত: দুই শাসকের গোপন বোঝাপড়া
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে উঠে আসে একটি অস্বস্তিকর অথচ বাস্তব সত্য— আরএসএস’র নির্দেশে বাংলার উপর এক কৌশলগত রাজনৈতিক সমঝোতা কায়েম হয়েছে, যেখানে রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই শাসক পরস্পরের পরিপূরক ভূমিকা নিচ্ছে। রাজ্যের‌ শাসক নেতাদের কেন্দ্রীয় এজেন্সি পুরোপুরি ছেড়েও দিচ্ছে না, আবার শাস্তির আওতায়ও আনছে না। মুখে বিরোধিতা, কিন্তু কাজে সহযোগিতা। ৩৭০ ধারা বিলোপে নিঃশব্দতা, এনআরসি নিয়ে দ্বিমুখিতা, সংসদে বিরোধী ঐক্যে না থাকা, কেন্দ্রের‌ শাসকের বিরোধিতার নামে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ, আবার সময় এলেই একেবারে চুপ— সব মিলিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই রাজনৈতিক রফার বাস্তবতা।
এই আঁতাতের লক্ষ্য দু’টি— একদিকে কেন্দ্রীয় শাসকের হিন্দুত্ববাদী ও কর্পোরেট ফ্যাসিস্ত প্রকল্পের সামনে বাধা না হয়ে সহযোগিতা করা, অন্যদিকে রাজ্যে বিরোধী বামপন্থী শক্তিকে দমন করে দুই শাসকের যুগল আধিপত্য কায়েম রাখা।

বিচারহীনতা আসলে রাজনৈতিক নীল নকশা
আর জি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় সিবিআই’র তদন্তে ব্যর্থতা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ওই বৃহত্তর ফ্যাসিবাদী কাঠামোরই প্রতিফলন। যেখানে শাসকগোষ্ঠী নারীদেহের উপর বারবার হিংসা চালিয়ে যাবে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা তার সমস্ত স্তম্ভকে ব্যবহার করে অপরাধীদের রক্ষা করে যাবে। এই বিচার না পাওয়া, এই বিচারহীনতা আসলে পরিকল্পিত— যেন মানুষ ভুলে যায়, হতোদ্যম হয়ে পড়ে, যেন প্রতিবাদ স্তব্ধ হয়ে যায়।

প্রতিবাদই একমাত্র পথ
বিগত এক বছর ধরে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স, অভয়া মঞ্চ, জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট, এসএফআই, ডিওয়াইএফআই, ও গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, শ্রমিক-কৃষক-বস্তিবাসী ও নানান নাগরিক মঞ্চের নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন রাজপথ থেকে আলপথে প্রতিবাদ জিইয়ে রেখেছে। এই লড়াই বলছে—তদন্ত যদি রাষ্ট্র না চায়, তবে জনতার লড়াই তাকে বাধ্য করবে।
আজ আর সময় নেই নীরবতার। প্রয়োজন উভয় শাসকের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণআন্দোলন। যারা আরএসএস’র ছত্রছায়ায় বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধ্বংস করছে, সংখ্যালঘু ও সমাজের দুর্বলতর অংশের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে, ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করছে, খুনী, ধর্ষক ও লুটেরাদের বারবার শাস্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। কারণ বিচার, মানবিকতা ও প্রগতির প্রশ্নে কোনও রাজনৈতিক আপস চলে না।

কেন্দ্রের শাসক তথা এরাজ্যের বিরোধী দলের নাটক—
অভয়া পরিবার বারংবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে চিঠি দিয়েছেন, কেউ চিঠির উত্তর অবধি দেয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতায় এসেও দু'মিনিট সময় বরাদ্দ করেননি ওঁদের জন্য। জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন চলাকালীন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী কলকাতায় এলেন, পাঁচতারায় মিটিং করলেন, ফিরে গেলেন। ভুলেও দেখা করলেন না অভয়ার মা-বাবার সঙ্গে বা আন্দোলনরত চিকিৎসকদের সঙ্গে। ওঁরা দিল্লি অবধি ছুটে গেছেন, তাতেও চিড়ে ভেজেনি। আমাদের বাকসর্বস্ব প্রধানমন্ত্রী একলাইনের একটা বিবৃতি বা শোকবার্তাও পাঠাননি, এমনকি তাঁর মন্-কি-বাত-এও অভয়াকাণ্ড বা নারীনির্যাতন স্থান পায় না। কেন এই নীরবতা? 
এই নীরবতার আসল কারণ লুকিয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতায়। এরাজ্যে বর্তমান শাসক দলের পক্ষ‌ থেকে যখন যখন চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীতে নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষদের উপর পদ্ধতিগত ও ব্যবস্থাগতভাবে পরিকল্পিত আক্রমণ হয়েছে, তখনই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে বামপন্থীরা। পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, কাটোয়া, কামদুনি, বারাসত, ধূপগুড়ি, মধ্যমগ্রাম, হাঁসখালি থেকে শুরু করে সম্প্রতি আর জি কর, কালীগঞ্জ বা কসবা ল কলেজ— সর্বত্রই নাগরিক প্রতিবাদের ফর্ম ও কন্টেন্টে বামপন্থার স্পষ্ট উচ্চারণ। রাজ্যে যখন দুই শাসক মিলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পাশাপাশি মনুবাদী দর্শনের প্রয়োগে সচেষ্ট, তখন এই প্রতিবাদ আন্দোলনগুলির ব্যাপকতায় ও প্রতিবাদীদের শরীরী ও মৌখিক ভাষায়, সংস্কৃতিতে বামপন্থী ইকো সিস্টেমের পুনরুজ্জীবনে আরএসএস বিচলিত। তাই এই আন্দোলন যখন রাজ্যের শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছে, তখন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত কলম ধরলেন তাঁদের মুখপত্রে। লিখলেন, আর জি কর ইস্যুতে রাজ্য সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করছেন তাঁরা। অভয়ার পরিবার পরে তাঁর সঙ্গে দেখা করে স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়ে এলেও তিনি অবস্থান বদলাননি।
আরএসএস’র এই বার্তা পেয়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল আর জি কর কাণ্ডে শাসকের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলনরত চিকিৎসক ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বিরোধী দলের এতজন বিধায়ক ও সাংসদের মধ্যে একজনও বিধানসভায় বা সংসদে এই প্রসঙ্গ তোলেননি, সরকারকে প্রশ্ন করেননি। একবারও তারা সিবিআই দপ্তরে গিয়ে আধিকারিকদের প্রশ্ন করেননি তদন্ত কেন এগোচ্ছে না। আজ একবছর পর তারা এই প্রশ্নে নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়ে সস্তার রাজনীতি করতে চাইছেন। পশ্চিমবাংলার মানুষ তাদের এই চালাকি ধরে ফেলেছেন।
গণমাধ্যমে ভাসিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে, কলকাতা পুলিশের অপসারিত কমিশনার ও সিবিআই’র আধিকারিক ব্যাচমেট, ফলে আধিকারিক স্তরে বোঝাপড়ার জন্য নাকি তদন্ত ঠিকপথে এগোচ্ছে না! তাই যদি হয়, তবে গোরু-কয়লা পাচারে অভিযুক্ত, শিক্ষক নিয়োগে অভিযুক্ত শাসকনেতারা, কালীঘাটের কাকুর সাহেব— এদের কোন ব্যাচমেট সিবিআই আধিকারিক রয়েছেন যে এদের বিরুদ্ধেও তদন্ত থমকে থাকে? আসলে নাগপুরের মনুবাদ ডিসট্যান্ট লার্নিং কোর্সের ব্যাচমেটরা রাজ্যে ও কেন্দ্রে সরকার চালাচ্ছেন। তাই জনগণ সেটিং ধরে ফেলার পর তাকে আধিকারিক স্তরের সেটিং বলে চালানোর চেষ্টা চলছে রাজনেতিক সেটিং ধামাচাপা দিতে।
তাই, আজ পয়লা আগস্ট অভয়া মঞ্চের আহ্বানে সমস্ত প্রতিবাদী মানুষ স্বাস্থ্য-দুর্নীতির অন্যতম পীঠস্থান সল্টলেকের স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল করে যাবেন সিজিও কমপ্লেক্সের সিবিআই দপ্তরে। হাতে ঝাড়ু আর তালাচাবি নিয়ে যাবেন বিক্রি হয়ে যাওয়া সিবিআই আধিকারিকদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দপ্তরে তালা ঝোলাতে। সিবিআই-ইডি’র আর দরকার নেই, এরাজ্যের মানুষই এবার বিচার বুঝে নেবে।

Comments :0

Login to leave a comment