সংসদে গ্রামের কাজের নিশ্চয়তা আইন বদলানোর বিল পেশের সময়ই তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়েছে। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান আইন বাতিল করতে ‘বিকশিত ভারত রোজগার ও আজীবিকা মিশন (গ্রামীণ) বিল পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান।
কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বিলের কড়া বিরোধিতা করেন। তিনি বলেছেন, গত কুড়ি বছর ধরে এমজিএনআরইজিএ গ্রামীণ বিকাশে ভূমিকা নিয়ে চলেছে। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে চলেছে। তার নাম বদলানোর কারণ কী? তাড়াহুড়ো করে নাম বদলানোর হিড়িক কার স্বার্থে?
প্রিয়াঙ্কা বলেন, মূল আইন অনুযায়ী এই আইনের আওতায় কেউ কাজ চাইলে দিতে বাধ্য থাকত কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে বাজেটে বরাদ্দ ছাপিয়ে চাহিদা থাকলে বাড়তি বরাদ্দ করতে হত। নতুন বিলে সেই সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। বাজেট বরাদ্দের মধ্যে কাজ কাটছাঁট করার দিকে এগনো হচ্ছে।
এদিকে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো বিবৃতিতে বলেছে যে প্রস্তাবিত বিলটি শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন নয়, পূর্বতন আইনের মৌলিক বৈশিষ্ট্যকেই অস্বীকার করতে চেয়েছে। একারণেই প্রস্তাবিত ওই বিল অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম)।
পলিট ব্যুরোর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত আইন (এমজিএনআরইজিএ)-এর বদল ঘটিয়ে বিকশিত ভারত—রোজগার ও আজিবিকা মিশন (গ্রামীণ) বিল, ২০২৫ (ভিবি-জিআরএএমজি) আনতে চলেছে। প্রস্তাবিত বিলে এমএনরেগার মূল বৈশিষ্ট্যকেই অস্বীকার করা হয়েছে, যা একটি সর্বজনীন চাহিদাভিত্তিক আইনের মাধ্যমে কাজের সীমিত অধিকার দেওয়ার উল্লেখ রয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারকে চাহিদা অনুসারে তহবিল বরাদ্দ থেকে অব্যাহতি দেওয়াকেও বৈধতা দেওয়া হবে।
নয়া বিলে সরকারের তরফে ১০০-র বদলে ১২৫ দিন কাজের নিশ্চয়তা দেওয়ার যে উল্লেখ আছে, তাকে প্রসাধনী বলে কটাক্ষ করেছে পলিট ব্যুরো। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিলটিতে জব কার্ড যুক্তিসঙ্গত করার অছিলায় গ্রামীণ পরিবারের বৃহৎ অংশকে বাদ দেওয়ার দরজা বস্তুত খুলে দেওয়া হবে। কৃষি মরশুমে সরকারকে ৬০ দিন পর্যন্ত কর্মসংস্থান স্থগিত করার বিধানের ফলে গ্রামীণ পরিবারগুলির যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখন কাজ থেকে বঞ্চিত করবে এবং তাদের মহাজনদের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। কর্মক্ষেত্রে ডিজিটাল উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করার ফলে শ্রমিকদের কাজ হারানো এবং তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মতো বিশাল অসুবিধা তৈরি করবে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, তহবিল ব্যবস্থার প্রস্তাবিত পরিবর্তন। বিলে কেন্দ্রের মজুরি দেওয়ার দায় ১০০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬০:৪০ ভাগে ভাগ করে নেওয়ার কথা রয়েছে, যা প্রধান রাজ্যগুলির জন্য প্রযোজ্য। এর ফলে বেকার ভাতা এবং বিলম্বিত ক্ষতিপূরণের ব্যয় বহনের দায়িত্ব রাজ্যগুলির ওপরেই বর্তাবে। এর জেরে রাজ্য সরকারগুলির উপর একটি অস্থিতিশীল আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের ভূমিকাও অস্বীকার করা হবে। ‘আদর্শ বরাদ্দ’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে কেন্দ্র রাজ্যভিত্তিক ব্যয়ের ঊর্ধ্বসীমা চাপিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত ব্যয় রাজ্যগুলিকেই বহন করতে হবে। এর ফলে রাজ্যগুলি কর্মসূচি যেমন কাটছাঁট করতে বাধ্য হবে, তেমনই কেন্দ্রের দায়বদ্ধতাও আরও লঘু হয়ে যাবে।
পলিট ব্যুরো মনে করে, প্রকল্পের নাম এমএনরেগা’র বদলে জি রাম জি করার মধ্যেও বিজেপি-আরএসএস’র মতাদর্শগত প্রবণতা স্পষ্টতই প্রতিফলিত হয়েছে।
পরিশেষে বিবৃতিতে, ভিবি-জিআরএএমজি বিল অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হোক বলে দাবি করেছে সিপিআই(এম)। কেন্দ্রীয় সরকারকে বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন এবং গ্রামীণ গরিবদের সংগঠনগুলির সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে যাতে এমএনরেগা শক্তিশালী হয়। এরই সঙ্গে এর কার্যকরী একটি সর্বজনীন ও অধিকার-ভিত্তিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করারও দাবি জানানো হয়েছে।
সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক এম এ বেবি এদিন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, রেগা আইনের সম্পূর্ণ সংস্কারের নামে কেন্দ্রীয় সরকারের মূল সত্যটি আড়াল করার চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে মৌলিক অধিকার-ভিত্তিক কাঠামো ভেঙে ফেলা হচ্ছে এবং কেন্দ্রের অংশ ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হচ্ছে। এর দায় রাজ্যগুলির উপর চাপানোর সঙ্গে কেন্দ্র এখন বরাদ্দ কমিয়ে বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলিকে শাস্তি দিতে পারে। এই বিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপগুলিকেও আইনে রূপান্তরিত করবে।
তিনি বলেছেন, কঠোর শ্রম আইনের বিজ্ঞপ্তির পরে আসা এই বেপরোয়া উদ্যোগ গ্রামীণ দুর্দশা এবং সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এই পদক্ষেপ অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমরা এই বিপর্যয়কর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে প্রাণপণে লড়াই চালাবো।
এদিকে, সারা ভারত কিষান সভা, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন সহ সিআইটিইউ কেন্দ্রের প্রস্তাবিত বিলের তীব্র বিরোধিতা করে অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। প্রতিটি সংগঠনই এই নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে আরএসএ-বিজেপি’র মতাদর্শকে কৌশলগতভাবে প্রয়োগের অভিযোগ জানিয়েছে।
কিষান সভা এদিন এক বিবৃতিতে মহাত্মা গান্ধীর নাম বদলে দিয়ে আরএসএস’র নির্দেশি জি রাম জি নামে এক সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করার পদক্ষেপের তীব্র ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে। এটি একটি গোপন উদ্দেশ্য নিয়েই করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বিলটি মূল আইনের বিধানগুলিকে দুর্বল করে দেবে এবং নিশ্চিত করা কাজের অধিকারকে সীমিত করবে। এই কারণেই প্রতারণামূলক এই বিল অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সারা ভারত কিষান সভা।
কিষান সভা জানিয়েছে, কৃষি শ্রমিক এবং কৃষক সংগঠনগুলির দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে এমএনরেগা তৈরি হয়েছিল, যেখানে বামপন্থীরা একে সারা বছর ধরে প্রযোজ্য একটি চাহিদা-ভিত্তিক আইনে পরিণত করার ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিল। সারা দেশে তথাকথিত এই ‘উচ্চ মরশুম’, যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজের সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে। এমএনরেগার অধীনে কাজ করার বিকল্পটি ছিল এক গ্যারান্টি যাতে গ্রামীণ শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি পাবেন এবং কৃষিকাজে কাজ করার সময় আরও বেশি মজুরি নিশ্চিত করার জন্য দর কষাকষির ক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন। পুরুষ এবং মহিলাদের সমান মজুরির নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল ওই আইনে, যখন কৃষিকাজে মহিলাদের কখনও পুরুষদের সমান মজুরি দেওয়া হয় না। গ্রামীণ ধনী ও জমিদাররা সর্বদাই রেগার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ প্রস্তাবিত বিলটি নিয়ে আসার উদ্যোগের মধ্যে তাদের শ্রেণি চরিত্রই আরও প্রকট করছে। ডিজিটাল উপস্থিতির মতো পূর্ববর্তী পরিবর্তনগুলি, যার ফলে কাজ বন্ধ এবং শোষণের ঘটনা ঘটেছে, প্রস্তাবিত বিলের মাধ্যমে তা বৈধতা দেওয়া হবে।
কিষান সভা বলেছে, এই প্রস্তাবিত বিলের মাধ্যমে রাজ্যগুলিকে ৪০ শতাংশ ব্যয় বহন করতে বাধ্য করা হবে। এর সিদ্ধান্ত গ্রহণকে কেন্দ্রীভূত করার সঙ্গে রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার অস্বীকার করা হবে। এনডিএ সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলিকে আর্থিকভাবে শ্বাসরোধ করার জন্য এই ধরনের বিধান প্রকল্পের শেষ পেরেক হবে। এই বিলটি স্পষ্টতই শ্রমিক-বিরোধী শ্রম আইনের মতোই এবং বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ শ্রমিককে কাজের সুযোগ থেকে বাদ দেওয়া হবে। যার ফলে পরিযায়ীর পরিমাণ আরও বাড়বে দেশের গ্রামে গ্রামে। সারা ভারত কিষান সভা এই অশুভ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সকল শ্রেণির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
একই ভাবে সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন মনে করে, প্রস্তাবিত বিলের আড়ালে রেগা-কে সুচিন্তিতভাবে ধ্বংস করার চক্রান্ত রয়েছে। রেগা একটি চাহিদা-ভিত্তিক কর্মসূচি ছিল, যার ফলে রাজ্যগুলি গ্রামীণ কর্মসংস্থান তৈরি করতে আইনত বাধ্য থাকত। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে সেই সুযোগ উলটে কেড়ে নেওয়া হবে। পাশাপাশি আর্থিক এবং প্রশাসনিক দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যগুলির ঘাড়ে। এরই সঙ্গে চাহিদা বাড়লেও কেন্দ্রীয় সরকারের অতিরিক্ত বরাদ্দের আইনত দায়ও থাকবে না। রাজ্যের ঘাড়ে ৪০ শতাংশ বরাদ্দের দায় চাপানো হচ্ছে। এই চাপে রাজ্যগুলি কর্মসূচি রূপায়ণে ভয়ঙ্কর আর্থিক বোঝার সম্মুখীন হবে। আর কাজের দিন বাড়ানোর যে দাবি করা হয়েছে, তাও প্রসাধনী বলে মনে করছে খেতমজুর ইউনিয়ন। একারণেই প্রস্তাবিত বিলের বিরুদ্ধে সমস্ত সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ, বিরোধিতায় শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে খেতমজুর ইউনিয়নের পক্ষ থেকে।
এক বিবৃতিতে সিআইটিইউ বলেছে, এমএনরেগা প্রকল্পকে কার্যত বাতিল করে ১০০ দিনের কাজের অধিকারকে খর্ব করার কৌশল রয়েছে প্রস্তাবিত নতুন বিলে। এর ফলে কাজের দায় সম্পূর্ণভাবে সরকারের করুণার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এমনকি ১০০ দিনের বদলে ১২৫ কাজের যে কথা উল্লেখ রয়েছে নতুন বিলে, তাও প্রতারণামূলক বলে মনে করে সিআইটিইউ। এই বিলের পিছনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, সরকারের বাধ্যবাধকতা ছেঁটে ফেলার পাশাপাশি কাজের ক্ষেত্রে বাদ দেওয়াকে নিশ্চিত করা। সিআইটিইউ মনে করে, প্রস্তাবিত বিল রূপায়িত হলে সঙ্কটপূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতি আরও ভেঙে পড়বে এবং বঞ্চনার শিকার হবেন গ্রামের কর্মপ্রার্থীরা।
সিআইটিইউ মোদী সরকারের এমএনরেগা প্রকল্পকে নাশকতা এবং ভেঙে ফেলার অমানবিক উদ্যোগের নিন্দা জানানোর সঙ্গে বিলটি সরাসরি বাতিলের দাবি জানিয়েছে। শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ, বিরোধিতা এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে সিআইটিইউ।
VB G RAM G
সংসদে পেশ একশো দিন কাজের আইন বদলের বিল, প্রতিবাদ
×
Comments :0