Deucha Panchami

দেউচায় দুর্নীতি-১: কয়লা খনির ভাঁওতা দিয়ে ব্যাসল্ট তোলার ছক

রাজ্য

প্রসূন ভট্টাচার্য : কলকাতা

 গোড়াতেই গন্ডগোল। দরপত্র দিয়ে বরাত পেল ‘ক’, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই হাত বদলে সেই বরাত চলে গেল ‘খ’এর হাতে। এমনটাই ঘটেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ঘোষিত দেউচা পাচামি প্রকল্পে। টেন্ডার বা দরপত্রের শর্তে স্পষ্ট বলা ছিল যে, প্রকল্প রূপায়ণকালে মালিকানা বদল চলবে না। কিন্তু সেই শর্ত লঙ্ঘন সত্ত্বেও টেন্ডার বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকা রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম চোখ বুজে থেকেছে। 
দেউচা পাচামিতে ব্যাসল্ট পাথর তুলে বিপুল মুনাফা লোটার কারবার এভাবেই ঘুরপথে যাদের হাতে গিয়েছে, তাদের সঙ্গে রাজ্যের শাসকদলের ঘনিষ্ঠতাও প্রকাশ্যে এসেছে একটি বৃহৎ বাংলা সংবাদপত্রের মালিকানা বদলে। টাইমস গ্রুপের হাতে থাকা ‘এই সময়’ নামের সংবাদপত্রটির মালিকানাও এখন দেউচা পাচামিতে কারবার চালানো কোম্পানির মালিক এবং তাঁর অংশীদার এমন এক ব্যক্তির হাতে যিনি মমতা ব্যানার্জি ও অভিষেক ব্যানার্জির অতি ঘনিষ্ঠ। 
দেউচা পাচামি প্রকল্পের রূপায়ণকারী সংস্থা হিমাদ্রি স্পেশালিটি কেমিক্যালসের সিইও অনুরাগ চৌধুরি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর ভাইপো তৃণমূল সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির আইনজীবী সঞ্জয় বসু হাত মিলিয়ে টাইডিং মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি তৈরি করেন এক বছর আগে। সদ্যোজাত সংস্থাটি যখন টাইমস গ্রুপের থেকে ‘এই সময়’ পত্রিকাটি অধিগ্রহণ করে নেয়, তার এক সপ্তাহ আগেও সংস্থার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ছিল শূন্য। মূলত সঞ্জয় বসু এবং অনুরাগ চৌধুরি এই টাইডিং মিডিয়ায় টাকা ঢালেন, সঙ্গী হন গৌতম আগরওয়াল এবং অমিত আগরওয়াল যাদের গুদামের ব্যবসা রয়েছে। সঞ্জয় বসুর সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা এতটাই যে পিনকন ও টাওয়ার গ্রুপের চিটফান্ড দুর্নীতির ঘটনায় ইডি যখন সঞ্জয় বসুর বাড়িতে রেড করেছিল, তখন সেটাকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি। আইনজীবীই হোন বা ব্যবসায়ী, মমতা-অভিষেক ঘনিষ্ঠতায় রাজনৈতিক খেলোয়াড় হয়ে ওঠা সঞ্জয় বসুর দখলে টাইমস গ্রুপের আঞ্চলিক দৈনিকটির মালিকানা চলে যাওয়া তাৎপর্যপূর্ণ, স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সর্বভারতীয় মিডিয়া এনডিটিভি’কে আদানিদের দখলের ঘটনাকেও। কিন্তু এর পিছনেও মূল অবদান রেখেছেন হিমাদ্রির কর্ণধার অনুরাগ চৌধুরি। 
এই অনুরাগ চৌধুরির হিমাদ্রি স্পেশালিটি কেমিক্যালস সংস্থাই ঘুরপথে হাতে নিয়েছে দেউচা পাচামি প্রকল্প। কীভাবে তাদের হাতে গেল প্রকল্পটি?
রহস্যজনক অস্বচ্ছতায় ভরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ৫৬০০ কোটি টাকা মুনাফার দেউচা পাচামির পাথর খাদানের প্রকল্প গিয়েছে হিমাদ্রির হাতে। কলকাতা হাইকোর্টে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের দাখিল করা হলফনামায় উল্লেখ রয়েছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই নিগমকে বীরভূমের মহম্মদ বাজারের কয়লা ব্লকটি দেওয়া হয়েছিল এই যুক্তিতে যে, উৎপাদিত কয়লা তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করবে। কিন্তু কয়লা উৎপাদনের উদ্যোগ কই! কয়লা ব্লক বরাদ্দের চুক্তি অনুসারে, কেন্দ্রীয় সরকারের কয়লা মন্ত্রকের কাছে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের কয়লাখনি লিজ এবং মাইনিং প্ল্যান জমা দিয়ে অনুমোদন নেওয়ার সময়সীমা ছিল ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আজ অবধি লিজের আবেদন এবং মাইনিং প্ল্যান জমাই দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ দেউচা পাচামিতে কয়লা উত্তোলন পুরোপুরি ভাঁওতা, তেমন কোনও উদ্যোগ ও সম্ভাবনাই নেই। এটা আরও প্রমাণিত হয়েছে পরে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম কয়লা খননের জন্য মাইন ডেভেলপার কাম অপারেটর নিয়োগের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহবান করেছিল। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টেন্ডার জমা দেওয়ার সময়সীমা ছিল, পরে তা এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু কোনও আবেদনই জমা পড়েনি। অথচ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি গত ফেব্রুয়ারিতেই শিল্প সম্মেলনে ঘোষণা করে দেন, ‘‘দেউচায় কয়লা খনি প্রকল্পে ১ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে এবং আগামী একশো বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লা সরবরাহ করা যাবে।’’ 
কয়লা খনি প্রকল্পের আড়ালে, তলে তলে রাজ্য মন্ত্রীসভায় অন্য উদ্যোগ চলেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসেই  মন্ত্রীসভায় প্রস্তাব পাস করানো হয় দেউচা পাচামির বিরাট এলাকা জুড়ে ব্যাসল্ট উত্তোলন করে বিক্রি করা হবে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের মাধ্যমে। রাজ্য বিদ্যুৎ দপ্তরের সেই প্রস্তাবেই বলা হয়েছিল, ৪৩১.৪৭ একর জমি থেকে ১৪১১.২ লক্ষ মেট্রিক টন ব্যাসল্ট পাথর উত্তোলন করে প্রায় প্রতি টন পাথর পিছু ৪০০ টাকা লাভ ধরে মোট ৫৬০০ কোটি টাকার মুনাফা করা হবে। সোজা কথায় কয়লা নয়, ব্যাসল্ট পাথর বেচার জন্য এমডিও বা মাইন ডেভেলপার কাম অপারেটর নিয়োগ করবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম। বেড়াল পরিণত হলো রুমালে। 
এর পরের অস্বচ্ছতা পাথর খাদান পরিচালনার টেন্ডার প্রক্রিয়ায়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের টেন্ডারে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে এমডিও বেছে নেওয়া হয় ট্রান্সমেরিন অ্যান্ড কনফ্রেইট লজিস্টিকস প্রাইভেট লিমিটেডকে। তারা নাকি ০.৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব প্রদানের দর হেঁকেছিল। অর্থাৎ তাদের খননে প্রাপ্ত পাথর বেচে মুনাফার ২৮.৫০ শতাংশ নেবে তারা ৭১.৫০ শতাংশ পাবে সরকার। ৫৬০০ কোটি টাকার ২৮.৫০ শতাংশ অর্থাৎ ১৫৭০ কোটি টাকা মুনাফা করে নিয়ে যাওয়ার বরাত পাওয়া এই ট্রান্সমেরিনের অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেমন? স্টক এক্সচেঞ্জে দাখিল করা হিমাদ্রি স্পেশালিটি কেমিক্যালসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ সালে তাদের বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৫ কোটি টাকার। কী কাজ করে এই সংস্থা? লজিস্টিকসে পণ্য বাবদ মাশুলের থেকে আয় হতো তাদের, সেই ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গেছে। এমনই একটি সংস্থাকে ‘উপযুক্ত’ বলে বেছে নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম। ৪৩১ একর জুড়ে বিশাল পাথর খনি পরিচালনার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতাই যাদের নেই, পরিকাঠামো ও সম্পদ নেই।
এরপরেই স্পষ্ট হয়ে যায় এমন বরাত প্রদানের মূল উদ্দেশ্য। মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন হিমাদ্রি স্পেসালিটি কেমিক্যালসের অনুরাগ চৌধুরি। টাইমস গ্রুপের হাত থেকে ‘এই সময়’ পত্রিকা কেনায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠের অংশীদার হিসাবে টাকা জোগানোর ঠিক একবছর পরে, ২০২৫ সালের এপ্রিলে তিনি হিমাদ্রির পক্ষ থেকে ট্রান্সমেরিনকে কিনে নিয়েছেন। অর্থাৎ দেউচা পাচামির প্রায় দেড় হাজার লক্ষ মেট্রিক টন ব্যাসল্ট পাথর এখন তাঁর হাতের মুঠোয়। স্টক এক্সেচেঞ্জে দাখিল করা হিমাদ্রির রিপোর্টে বলা হয়েছে যে তারা ট্রান্সমেরিন কনফ্রেইটের ৬০ শতাংশ শেয়ার ৪.২৩ কোটি টাকায় কিনে নিয়েছে। এই অধিগ্রহণের জন্য তারা ট্রান্সমেরিনের সহযোগী সংস্থা স্টার্ডি নিকেতনকে ১৫০ কোটি টাকার ঋণও দিয়েছে। এই স্টার্ডি নিকেতনের গত তিন বছরে বার্ষিক আয় শূন্য। পাথর বেচে ১৫৭০ কোটি টাকা মুনাফার জন্যই এভাবে হাত বদল হয়ে গেল দেউচা পাচামি প্রকল্পের!
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর ভাইপোর বিশ্বস্ত হয়ে ওঠা হিমাদ্রির হাতে এই মালিকানা বদল নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, এই ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই প্রকল্প রূপায়ণ বা অপারেশন চলাকালীন বরাতপ্রাপ্ত সংস্থার মালিকানা বদলে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এক্ষেত্রেও তাই ছিল। ২০২৪ সালের ১৬ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের পক্ষে জেনারেল ম্যানেজার (মেটেরিয়াল অ্যান্ড কন্ট্র্যাক্ট কর্পোরেট অফিস) অরুন্ধতী বন্দ্যোপাধ্যায় ট্রান্সমেরিনকে বরাত প্রাপ্তির যে লেটার অব অ্যাওয়ার্ড পাঠিয়েছিলেন তার চতুর্থ প্যারাগ্রাফে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘টেন্ডার নোটিসের ৩ ডি ধারা অনুসারে প্রকল্প রূপায়ণকারী কনসর্টিয়ামের সদস্য পরিবর্তন করা যাবে না প্রকল্প চলাকালীন। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের আগাম অনুমতিক্রমে কোনও পরিবর্তন করতে হলেও মুখ্য সদস্যের অন্তত ৫১ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে প্রকল্প চলাকালীন পূর্ণ সময়কালে।’ সোজা কথায় বরাত প্রাপ্তির শর্তেই বলা আছে, বরাত প্রাপক সংস্থার মালিকানা পরিবর্তন চলবে না। 
সমাজকর্মী প্রসেনজিৎ বসু কলকাতা হাইকোর্টে দেউচা পাচামিতে সরকারের প্রকল্পের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তিনি টেন্ডার নথি দেখিয়ে বলেছেন, হিমাদ্রি স্পেশালিটি কেমিক্যালস নিজেই ঘোষণা করেছে যে তারা ট্রান্সমেরিনের ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনে সংস্থাটিকে অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। তাহলে টেন্ডারের শর্ত মান্য করা হলো কই? তাহলে কি একটা সঙ্গতিহীন যোগ্যতাহীন কোম্পানিকে ছায়ার মতো খাড়া করে বরাত আদায় করার পরে বেআইনি পথে হিমাদ্রিকে ১৫৭০কোটি টাকা মুনাফার সুযোগ করে দেওয়া হলো না? এর জবাব বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমকেই দিতে হবে। 
বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নিয়ম মেনেই বরাত দেওয়া হয়েছে দেউচা পাচামিতে ব্যাসল্ট পাথর খাদানের। তবে প্রকল্প রূপায়ণের গোড়াতেই বরাতপ্রাপ্ত এমডিও’র মালিকানা পরিবর্তন এবং তার ফলে টেন্ডার শর্তভঙ্গ সম্পর্কে তারা কোনও ব্যাখ্যা দেননি। সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম দেউচা পাচামি প্রকল্প ঘিরে টেন্ডার শর্তভঙ্গ সহ একগুচ্ছ বিধিভঙ্গের অভিযোগ করে বলেছেন, এখন স্পষ্ট হচ্ছে তো ‘এই সময়ে’ হঠাৎ অনুরাগ জন্মালো কেন? পুরোটাই কেলেঙ্কারি হয়েছে, আমরা সেইজন্যই বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।
 

Comments :0

Login to leave a comment