প্রবন্ধ
ছোটোদের অবনীন্দ্রনাথ
জয়ন্ত সিংহ মহাপাত্র
মুক্তধারা
'ছোটদের পড়বার মতো বই বাংলা ভাষায় বিশেষ নেই ৷ এ অভাব আমাদের ঘোচাতে হবে ৷ তুমি লেখ ৷ যাতে ছোটরা পড়ে আনন্দ পায় এমন বই লিখে ফেল ৷' রবিকাকা পরামর্শ দিয়েছিলেন ভাইপো অবনীন্দ্রনাথকে ৷ রঙ-তুলি পাশে রেখে হাতে কলম তুলে নিলেন অবনীন্দ্রনাথ ৷ একের পর এক রচনা করলেন ছোটদের বই ৷ শকুন্তলা ,ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা, রাজকাহিনী, ভূতপত্ রীর দেশে, খাতাঞ্চির খাতা , নালকএর মতো শিশু-কিশোরদের বই ৷ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ৭ আগস্ট , ১৮৭১ জোড়াসাঁকোয় ৷ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতি সুরেন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান অবনীন্দ্রনাথ ৷ মাতা সৌদামিনী দেবী ৷ গৃহশিক্ষকের কাছে শিক্ষাজীবনের পাঠ শুরু ৷ পরে কিছুদিন পড়াশোনা করেন সংস্কৃত কলেজে ৷ বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত , ফরাসি নানা ভাষায় তাঁর যথেষ্ট দখল ছিল ৷ ইতালিয়ন শিল্পী গিলার্ডি ছিলেন তাঁর প্রথম শিল্প-শিক্ষক ৷ তাঁর কাছে তিনি প্যাস্টেল ড্রইং, ওয়াটার কালার ড্রইং শিখেছিলন ৷ পরে ইংরেজ শিল্প-শিক্ষক পামারের কাছে অয়েল পেন্টিং শেখেন ৷ ১৮৯৬ সালে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে কলকাতা আর্ট কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ হন ৷ 'ওমর খৈয়াম চিত্রাবলী' তাঁকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয় ৷ ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিতে আঁকা তাঁর ছবিগুলি ভারতীয় চিত্রশিল্পজগতে নতুন ভাবনার দ্বার খুলে দেয় ৷ ভারতীয় শিল্পের নবজন্মদাতা হিসেবে তিনি পরিচিত হন ৷ পরবর্তীকালে গদ্যশিল্পী হিসেবেও আশ্চর্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন ৷ বিশেষত বংলা শিশুসাহিত্যে তাঁর অবদান ভোলার নয় ৷ রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় শিশুদের জন্য অবনীন্দ্রনাথের প্রথম বই 'শকুন্তলা'৷ রূপকথার আদলে লোকসমাজের ইচ্ছেপূরণের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের জাল বুনেছেন লেখক এই বইটিতে ৷ 'ক্ষীরের পুতুল' এক নিটোল রূপকথার বই ৷ মৃণালিনী দেবীর রূপকথা সংগ্রহের খাতা থেকে মূল কাহিনি নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ৷ বইটি যেন লেখায় ছবির আলপনা ৷ 'বুড়ো আংলা'য় তিনি ছোটোদের চিনিয়ে দিয়েছেন আশ্চর্য পৃথিবীকে ৷ ছোটো বড়ো সকলেই ঢুকে পড়ে রূপকথার এক মায়াবী জগতে ৷ অবনীন্দ্রনাথ একসময় যাত্রাপালা লেখার নেশায় মেতেছিলেন ৷ কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে নানা উপকরণ নিয়ে লিখছিলেন একটার পর একটা পালা ৷ কিন্তু মন ভরেনি ৷ লিখতে শুরু করলেন পুঁথির মতো করে রামায়ণ ৷ আমরা পেলাম 'চাঁইবুড়োর পুঁথি, পোড়ালঙ্কার পুঁথি, হনুমানের পুঁথি , মারুতির পুঁথি, জয়রামের পুঁথি ৷ 'ভূতপত্ রীর দেশে' তাঁর অদ্ভুত কল্পজগতের গল্প ৷ ১৯১১ সালে এক নৈশযাত্রায় পুরী থেকে কোনারক যাবার গা ছমছম স্মৃতিসূত্র অবলম্বনে লেখা ৷ রূপকথা-কথকতা, ভূত-পেতনি, হাসি, মজা নিয়ে এক উদ্ভুতুড়ে দেশের গল্প বলেছেন 'ভূতপত্ রীর দেশে' ৷ ১৩২৩ সালে লেখেন 'খাতাঞ্চির খাতা' ৷ সচিত্র এই বইটি ছোটো বড়ো সকলের কাছেই বেশ উপভোগ্য ৷ লেখায় ছবিতে যেন এক আশ্চর্য জগৎ ৷ তিনি বাংলা গদ্যের এক অনন্য শিল্পী ৷ জন্মের দেড়শো বছর পরেও তিনি শিশু-কিশোরদের বান্ধব ৷ আমাদের আত্মীয় ৷ তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ' অবন ঠাকুর যেমন ছবি আঁকেন তেমনি গল্প আঁকেন ৷...অবন কি আশ্চর্য মানুষ, সত্যিই আর্টিস্ট ৷ ওর তুলিতে ছবি কলমেও ছবি ৷ একেবারে নিজস্ব স্টাইল ৷' ৫ ডিসেম্বর, ১৯৫১ অবনীন্দ্রনাথ প্রয়াত হন ৷ এক বর্ণমুখর অধ্যায়ের শেষ হয় ৷ জন্মের সার্ধশতবর্ষ তাঁর লেখাগুলো নতুন করে পড়া জরুরি ৷
Comments :0