শারদীয়া ১৪৩১
গল্প
আলো
পল্লবী আদক
মুক্তধারা
গোপীপুর গ্রামে একটাই পুজো হয়।গোপিপুর সদর বাড়ির পুজো। মহা আড়ম্বর হয়তো থাকে না সেখানে,তবে,প্রতিবছর ই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান হয়।গ্রামের ছেলে মেয়েরাই নাচ গান আবৃত্তি করে,মণ্ডপের দর্শনার্থীরাই সেই অনুষ্ঠানের দর্শক।প্রতিবছর তাই ই হয়ে আসছে।পুজো কমিটির সদস্য রাই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
কিন্তু এই বারে সবাই ঠিক করেছে,শুধু অনুষ্ঠান নয়, তার পাশাপাশি একটা প্রতিযোগিতা করবে বড়সড়।কুইজ প্রতিযোগিতা।বিজয়ী দলের জন্য থাকবে পাঁচ হাজার টাকা।দুজন নিয়ে একটি দল গঠিত হবে।এই আয়োজন টা অব্যশ পুজো কমিটির সদস্য রা একা করছে না। ব্লক স্তরের একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তত্ত্বাবধানে এই প্রতিযোগিতা টা হচ্ছে।সমস্ত টাকা ওরাই দেবে।
যথারীতি পঞ্চমীর দিন বিকেলে প্রতিযোগিতা আয়োজনের সমস্ত ব্যবস্থা হলো।প্রায় পনেরো টা দল অংশগ্রহণ করেছে।স্কুলের বিশেষজ্ঞ শিক্ষক মহাশয়দের দ্বারা কুইজের প্রশ্ন প্রস্তুত হলো।প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলতে লাগলো।অবশেষে এই প্রতিযোগিতা সমাপ্ত হলো। পূজা এবং পিহু নামক দুই বোন সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ঘোষিত হল।সম্পর্কে ওরা দুই বোন।ওদের মঞ্চে ডেকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হলো।সেই সঙ্গে ওদের শিক্ষার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলতে বলা হলো।পূজা প্রথমে শুরু করলো "নমস্কার আমি পূজা।গ্রামের বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী আমি।আমার বোন পীহু।আমার থেকে দুই বছরে ছোট।এই টাকা টা আমাদের কাছে খুব দরকার ছিল।মহালয়ার। ভোরে সবাই যখন বড় টিভির পর্দায় নিজের বাড়িতে মহালয়া দেখতে ব্যস্ত,আমরা তখন অন্যের জানলায় গিয়ে দাঁড়াই,মহালয়ার গান শুনতে কারণ টিভি পযন্ত আমাদের বাড়িতে নেই। স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ায় সবাই কত আনন্দ করে,কিন্তু আমাদের মনে কোনো আনন্দ থাকে না!!সবাই যখন পুজোর মাস খানেক আগে থেকে নানা দোকান থেকে কেনাকাটা করে,আমরা তখন ছেঁড়া ফাটা জামা পরে ঘুরে বেড়াই। নবম শ্রেণীতে উঠেছি এই বার।ক্লাসে দ্বিতীয় হয়েছি।টিউশন পড়ার মতো বিলাসিতা আমাদের নেই,বাড়িতেই যতটুকু সম্ভব পড়ে এই জ্ঞান অর্জন করেছি।বাবার কারখানা কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে গেলো।তারপর থেকে বাবা বাড়িতেই থাকেন। সামান্য সেলাই আর টুকটাক মাঠের আনাজ বিক্রি করে সংসার চলে।পড়াশোনা টা যে দুই বোনে করতে পারছি এটাই অনেক "।এতটুকু বলে পূজা থামলো।
এবার ওর বোন পিহু শুরু করলো " সবাই যখন পুজোয় নতুন জামা পরে ঘুরে বেড়াতো,আমরা তখন ঘরে বসে থাকতাম।নিজের সন্তানদের ,এক উৎসবের দিনে একটা জামা দিতে না পারার যন্ত্রণায় একটা পিতার মনের যে কষ্ট হয়,সেটা আমার পিতাকে দেখে বুঝতে পারতাম।মা দুর্গার কাছে মনে মনে প্রার্থনা করতাম,আমরা যেনো তোমার পুজোয় পরের বার নতুন জামা পরে অনেক আনন্দ করতে পারি।মা বোধহয় আমাদের কথা শুনেছেন।তাই আজ একেবারে এত টাকা আমরা পেলাম।এই টাকা নিয়ে আমরা জামা কিনব,বাবাকে জামা কিনে দেবো, মাকে নতুন শাড়ি দেবো,বাবা মাকে নিয়ে ভালো হোটেল এ খেতে যাবো।এগুলোই তো আমাদের কাছে সুখ।এর বেশি আর কি বা চাই!!আজ বোধহয় মা দুর্গা,আমাদের সেই সুখ দিতে চান।"এই বলে দুই বোন মাইকের সামনেই অঝোর ধারায় অশ্রুবর্ষণ করতে শুরু করলো।ওদের এই অশ্রু দেখে কিছু কিছু মানুষের চোখেও আজ অশ্রু।ওদের ই স্কুলের হেডমিস্ট্রেস সেখানে উপস্থিত ছিলেন।ওনার চোখেও আজ জল।উনি তখন স্টেজে উঠলেন।ওদের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে উনি মাইক নিয়ে সবার সামনে বললেন "আজ থেকে এই দুই মেয়ের পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব আমি নিলাম।আমার স্কুলের মেধাবী ছাত্রীটার মনে যে এত কষ্ট আমি জানতাম ই না,যদি না আজ এই মণ্ডপের আমন্ত্রিত অতিথি না হয়ে আসতাম।ওদের দুই বোনের টিউশন,বই খাতা দেওয়া,ড্রেস দেওয়া সব দায়িত্ব আমি নিলাম সেইসঙ্গে ওর বাবাকেও কোনো না কোনো কাজ পাইয়ে দেওয়ার দায়িত্ব টাও আমি নিলাম"।হাততালিতে ভরে উঠলো গোটা মণ্ডপ।হেডমিস্ট্রেস এবার দুই বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো "কোনো চিন্তা নেই তোমাদের মা,তোমরা শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করো।খুব শীঘ্রই আমি তোমাদের বাড়ি যাবো"।
আজ অষ্টমী।পুষ্পাঞ্জলি হবে।চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ।মা যেনো হাসছেন আজ। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পূজা, পিহু তাদের মা বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছে ।মায়ের কাছে আজ ওরা পুষ্পাঞ্জলি দেবে।হাতে পুজোর ডালা।পরনে নতুন জামা কাপড়। গত দিনের ঘটনা ওদের জীবন থেকে অন্ধকার দুর করে আলো নিয়ে এসেছে। মা বোধহয় নিজেই আলো নিয়ে এসেছেন ওদের জীবনে।আজ যেনো সকলে হাসছেন।এ হাসি খুশির হাসি।
Comments :0