STORY — SOURAV DUTTA — MUKTADHARA | 10 JUNE 2024

গল্প — সৌরভ দত্ত | তোমার পতাকা যারে দাও — মুক্তধারা | ১০ জুন ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

STORY  SOURAV DUTTA  MUKTADHARA  10 JUNE 2024

গল্প

তোমার পতাকা যারে দাও

সৌরভ দত্ত

মুক্তধারা

      ( গত সংখ্যার পর )

        গ্রামে একটা সময় একটা প্রবাদ চালু ছিল–“ভব গোলুইয়ের বলদ /কোথাও নেই‌কো কোনো গলদ।”--সে এক গোঁয়াড় গোবিন্দ লোক ছিল মশাই।এঁটে‌ বাগিয়ে‌ বর্ষায়‌ নিজের হাল বলদ নিয়ে রোয়াগারা-চাষাবাদ।
হারাধনের ধানের গোলাটা এখনো আছে। হারাধনের মা নারকেল দিয়ে ভালো খুদ রান্না করত।বাবার থেকেই বাঁশের‌‌ মই বানাতে শিখেছিল চাঁদু গোলুই ওরফে হারাধন। এখনো সে দীপুদের সদরে বসে‌ জাওয়া বাঁশ কেটে মই তৈরি করে‌ লুপ্তপ্রায় শিল্পটিকে ‌বাঁচিয়ে‌ রেখেছে।কংগ্রেসি‌ আমল ভবতারণ‌ গোলুইয়ের নাম শুনলে গ্রামে কোনো দক্ষিণপন্থী লোক‌ সহজে ঘেঁষতে‌ সাহস‌ পেত না। একবার ভোট প্রচারে এসে মাইকে জ্যোতিবাবুকে নিয়ে‌ ব্যঙ্গাবিদ্রূপময় প্রচার করাতে কেষ্ট সরকারকে জোর ছুট কাটিয়েছিল।ভব‌ গোলুইয়ের সাকরেদ বলতে মৃত্যুঞ্জয় গোলুই আর অশোক নস্কর।সুজন মাস্টার আগে সি.পি.(আই) এম করত এ.বি.টি.এ এর জেলা কমিটির মেম্বার ছিল এখন বিজেপি করে। গৈরিক বস্ত্র পড়ে মাথায় ইয়া বড় টোপ্পা লাগিয়ে টো টো করে ঘোরে।বাম ভোট কাটানোর চেষ্টা করে। হারাধন সেই কৌশল আটকে‌ দেয়।সুজন মাস্টার চরিত্রটা অদ্ভুত সবজান্তা ভক্তপ্রসাদ টাইপের।এক সময় সে দাসপাড়ায় লোহা কাটত বাম আমলে চাকরিটা পেয়েছিল।মার্কসপুঁজি,নিকোলাই গোগল ছেড়ে সে এখন গ্রামের মহিলাদের রামমন্দিরের ফটো, হনুমানজির পতাকা আর প্রসাদ বিলি করে ভুলভাল বুঝিয়ে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে চায়।

      লোকসভা ভোট মিটে গেছে কয়েকদিন হল। গ্রামের চারিদিকে পোঁতা‌ অজস্র ফ্লেক্স, ঝান্ডা। গাছে গাছেও বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থা আর রাজনৈতিক দলের মলীন হয়ে নুয়ে পড়া ঝান্ডা, ছেঁড়া ফাটা ফ্লেক্স।মনে‌ ব্যথা‌ লাগে‌ তার। গাছগুলোকে‌ দূর থেকে মনে‌ হয়‌ ক্রুশবিদ্ধ যিশু। পাখিগুলো ডানা‌ ঝাপটায়।যদিও পরিবেশ সংগঠনগুলো এ বিষয়ে কঠোর আপত্তি জানিয়েছে ।প্রেস ক্লাবে পরিবেশ রক্ষার তাগিদে পরিবেশ বান্ধব ইস্তেহার প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে গাছপালার গায়ে পেরেক দিয়ে ফ্লেক্স-ঝান্ডা মারা যাবে না।তবু টনক নড়েনি রাজনৈতিক দলগুলোর।কারণ, হীরক রাজার দেশে সবই হয়।মঙ্গলবার জঙ্গল‌ সাফ করবার দিন।হারাধন‌ একটা মই নিয়ে আসে।বাপ কা ব্যাটা! বাপের মতোই ঠিক লুঙ্গিটাকে এঁটে বাগায়।প্রতিটা গাছে মই লাগায় খুলতে থাকে দলীয় ঝান্ডা গুলো ও গাছে আটকানো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বহু পুরনো বাবরের আমলের ঝান্ডা হীন পেরেক বিদ্ধ ডান্ডা, ছেঁড়াখোঁড়া ফ্লেক্স। পতাকার কাপড়ের অপমান সহ্য হয় না তার। মনের কোণে উঁকি দেয়‌‌ নৈতিক‌ মুল্যবোধ ও মানবতা।গাছে গাছে এ হেন দৃশ্য দূষণ তাকে ভাবিয়ে তুলেছে।মাঝখানে ভুলবোঝাবুঝিতে পার্টির সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন‌ হয়েছিল‌‌ অনীকের।নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল।পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে অনীক একদৃষ্টে দেখছিল হারাধনের ঝান্ডা খোলা।মইটা একটু টাল খেতেই সে দৌড়ে গিয়ে হারাধনের মইটা ধরে।সে অবাক চোখে তাকায়।অনীক আজ বিধ্বস্ত একা।মই থেকে নেমে হারাধন‌ বলে–বাকি গাছের গুলো খুলতে হবে।কামড়ি দিয়ে পেরেক গুলো সব তুলব।তুই‌ মইটা ধরবি । ওপাশের ছাদের উঁচুরটা‌ আমার হাত যাবে না।ওটা তোকে খুলতে হবে। অনীকের মনে ভেসে ওঠে তেভাগার ডায়েরি।সব দলীয় ঝান্ডা খোলা হয়ে যায় স্কুলমাঠের পাশ থেকে শনশন হাওয়া বইছে।হারাধন আর অনীকের হাতের ঝান্ডা গুলো লাট খাচ্ছে। ইচ্ছে ঘুড়ির মতো উড়ে যেতে চাইছে আকাশে। ‘আকাশের চাঁদ আজ কাস্তে’।

পরেরদিন পাড়ার সবাই যে যার কাজে।টিউশনি শেষ করে বাড়ি ফিরছে অনীক।পাড়ার মোড়ের বংশীর দোকানে সাইকেল থেকে নামতেই খবর পেল। কমিউনিস্ট পার্টির দীর্ঘ দিনের সৈনিক‌ বৃদ্ধ মৃত্যুঞ্জয় গোলুই মারা গেছে।ভোট লুটের মাঝেও তার বৌমা এবারে পঞ্চায়েত ভোটে লাল পার্টির প্রার্থী ছিল। জিতেছিল শুধুমাত্র হারাধনের পরিশ্রম ও বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তের জন্য। পার্টির প্রতি আনুগত্য মতাদর্শের সঠিক প্রয়োগ হারাধনের একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট করে তুলেছে।তার বাবার বন্ধু কমরেড মৃত্যুঞ্জয় গোলুই। দ্রুত খবর দেয় হারাধনকে।এরপর চলে‌ শবদাহের‌ প্রস্তুতি।এক‌ একে‌ পার্টির পরিচিত কমরেডরা‌ জড়ো হয় বকুলতলার শ্মশানে। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। বটগাছের ডাল চুঁইয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে নামে।শ্মশানে পড়ে আছে এক খেতমজুরের নিথর দেহ। মৃতদেহ ছুঁয়ে বসে তার নাতি।অনীক হারাধনের পরামর্শ মতো গোলায় টাঙানো লাল পতাকাটা খুলে এনে তার হাতে দেয়।লাল‌ ঝান্ডা দেখেই‌ বেপাড়া কমল রক্ষিত মদ্যপ অবস্থায় গালিগালাজ করতে থাকে।জোর‌ করে‌ বলে দাদু‌ আমাদের লোক–ভারতমাতা কি জয়!পাড়ার‌ অনেকেই আপত্তি তোলে।ঝান্ডা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে হারাধন চোখের কোণে আগুনের লেলিহান শিখা।এর মাঝে মৃত্যুর খবর পেয়ে তপাই মুখুজ্জে চলে আসে শ্মশানে।কমরেডদের ভিতর জেগে ওঠে‌ প্রতিরোধের‌ উলগুলান।কমলকে ঠেলে সরিয়ে দেয়‌।ম্যাক্সিম গোর্কির শত্রুপক্ষ‌ নাটকের সংলাপ পাক খায় বাতাসে–“এখন জ্বলে উঠেছি আমরা, হুমকিতে সে আগুন নিভবে না,কোন হুমকিতে নিভবে না”।সবাই এক‌ এক করে এগিয়ে আসে মৃতদেহের খুব কাছে। একেবারে শেষে‌ আসে অনীক‌। দলের সবার সাথে‌ রক্তপতাকাটা হাত বাড়িয়ে ধরে‌ বৃদ্ধের বুকের উপর। রজনীগন্ধা নয় একগুচ্ছ কৃষ্ণচূড়ার ফুল এনেছে বিজনদা।একটা রেড স্যালুট লেখা হয় ডায়েরির‌ পাতায়। নতমস্তকে দন্ডায়মান সব গাছেরা। হঠাৎ করে গাছেরা যেন ছায়ামানুষ হয়ে ওঠে।গাছেদের গা থেকে খুলে নেওয়া পেরেকের দাগগুলো সূর্যের আলোয় ‌কিরকম বীভৎস দেখাচ্ছে। মৃতদেহের পাশে‌ রাখা পতাকাটা‌ নিজের বুকে তুলে নিয়েছে পাড়ার একটা অল্পবয়সী ছেলে।ছেলেটা হারাধনের।পতাকায় লেগে থাকে উত্তরাধিকারের‌ গন্ধ। দাউদাউ জ্বলছে কমরেড মৃত্যুঞ্জয়ের নীলচে চিতা। গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে‌ আনমনে নিজের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় মেতেছে অনীক। স্মৃতিশক্তি ফিরে যাচ্ছে ত্রিশ বছর আগের ছেলেবেলায়। বাবার সাইকেলে‌র পিছনে চেপে গরানহাটা পেরিয়ে লাল পতাকা উঁচিয়ে ইনকিলাব ধ্বনিতে মুখরিত সেই সাইকেল মিছিল।না আর সমঝোতা নয়।নদীর হিল্লোলে‌ শুনতে‌ পায়–“আহ্বান, শোন আহ্বান,আসে মাঠ-ঘাট বন পেরিয়ে..”

( সমাপ্ত )

Comments :0

Login to leave a comment