গল্প
ভক্ত
সৌরীশ মিশ্র
নতুনপাতা
অলোকস্যারের কোচিং ক্লাস থেকে বেড়িয়েই ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে ওর মা-র মোবাইলে ফোন লাগায় মৌ।
দু'বার রিং হতেই ফোনটা ধরলেন মৌ-এর মা পূজাদেবী। "হ্যাঁ বল্।"
"মা, দিদাকে তৈরি হয়ে থাকতে বলো তো চটপট। আমি বাড়ি ফিরছি মিনিট দশেকের মধ্যেই। দিদাকে নিয়ে একটু বেরোবো।"
"কোথায় বেরোবি?"
"এতো কিছু বলার সময় নেই মা। দিদাকে বলো রেডি হয়ে থাকতে, কেমন? রাখছি আমি।" আর এইটুকু বলেই লাইনটা কেটে দেয় মৌ। তারপর হাত দেখিয়ে থামায় একটা অটোকে। তারপর ওতে চড়ে বসে সে।
মৌ ক্লাস টুয়েলভের স্টুডেন্ট। অলোকস্যারের এই কোচিং-এ পড়ছে ও ক্লাস ইলেভেন থেকেই। মৌদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূর নয় এই কোচিং সেন্টারটা। তবে, রাস্তায় একটু জ্যাম থাকায় আজ একটু বেশি সময় লাগল মৌ-এর বাড়িতে পৌঁছতে। এই সারাটা রাস্তা ও ওর মোবাইলে ক্রমাগত দেখে গেছে ক'টা বাজে। আর মনে মনে নিজেকেই বলেছে, যে করে হোক ওকে ওর দিদাকে নিয়ে পৌঁছতেই হবে গন্তব্যে ছ'টা বাজার আগেই।
বাড়িতে ঢুকেই সে একপ্রকার ছুটে সোজা চলে এল ওর দিদার ঘরে। মৌ-এর দিদা সরযূবালাদেবী তৈরি হয়েই ছিলেন। তাই দেখে মৌ বলে উঠল, "বাঃ, রেডি। চলো তাহলে।"
"কোথায় নিয়ে যাবি আমায়?"
"এতো কথা বলার হাতে সময় নেই দিদা। চলো বেরোই।"
সরযূবালাদেবী কথা বাড়ালেন না। বৌমাকে বলে নাতনির সাথে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লেন।
বড় রাস্তায় এসেই একটা রিকশা নিল মৌ। রিকশাওয়ালাকে সে বলল, "চৌমাথার কাছে যে বড় কালীপুজোর প্যান্ডেলটা করেছে না, সেটায় চলো।"
সরযূবালাদেবী এবার বুঝতে পারলেন, আগামীকাল কালীপুজো, তাই নাতনি তাঁকে কোথাও একটা কালী প্রতিমা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে।
"কালী ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিস, দিদি?"
"সে তো সেখানে গেলে তুমি দেখবেই। তবে আরো একটা কারণও আছে। আর সেটা কিন্তু ভীষণই স্পেশাল তোমার জন্য দিদা।"
ঠিক তখনই রিকশাটা থামে এসে যেই কালীপুজোর প্যান্ডেলটার কথা রিকশাওয়ালাকে বলেছিল মৌ, তার সামনে। ভাড়া মিটিয়ে দু'জনই রিকশা থেকে নামে। আর নেমেই এদিক-ওদিক চাইতে থাকে মৌ। তারপর স্বগতোক্তি করে সে, "এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা। আসেননি নাকি?" মৌ-এর চোখ দুটো চঞ্চল হয়ে খুঁজতে থাকে কাকে যেন। তারপর হঠাৎই কাকে যেন দেখতে পেয়ে বলে ওঠে সে, "ঐ তো।"
সরযূবালাদেবীর, নাতনির এই সবকটা কথাই কানে গিয়েছিল, কিন্তু ব্যাপার-স্যাপার যে কি হচ্ছে তা কিছুই তাঁর বোধগম্য হোলো না।
তাই তিনি নাতনিকে না বলে পারলেন না, "কি যে বলছিস দিদি, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।"
"দাঁড়াও, বুঝিয়ে বলছি। আচ্ছা, ঐ দিকে প্যান্ডেলের সামনে পাতা চেয়ারে যে চারজন ভদ্রলোক বসে আছেন তাঁদের মধ্যে ঐ যে সবচেয়ে বয়স্ক কিন্তু সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ভদ্রলোক তাঁকে চিনতে পারছো, দিদা?"
সরযূবালাদেবী এবার ভালো করে তাকান যে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথা বলছে নাতনি তাঁকে তাঁর দিকে। বছর আশির মতোন বয়সী ভদ্রলোকের পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবি। ব্যাক্ ব্রাশ করা চুল। ধবধবে ফরসা গায়ের রঙ। হাসি-হাসি মুখে চেয়ারে বসে থাকা বাকি তিনজনের সাথে কথা বলছেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যে চিনতে পেরে যান ভদ্রলোককে সরযূবালাদেবী। বলে ওঠেন একপ্রকার উত্তেজিত হয়েই নাতনির দিকে তাকিয়ে, "নয়ন কুমার, না?"
"হ্যাঁ গো দিদা, নয়ন কুমার। তোমার মোস্ট ফেভারিট হিরো। আজ কোচিং-এ গিয়ে শুনি, উনি আসছেন এখানে এই প্যান্ডেল উদ্বোধন করতে। তোমার তো কতোদিনের ইচ্ছা নয়ন কুমারকে দেখবে সামনা-সামনি। তাই ভাবলাম, এই চান্সটা নিতেই হবে আমায়।"
"খুব ভালো করেছিস দিদি। সেই ইয়ং বয়স থেকে আমি ওনার ভক্ত। এমন কোনো ওনার অভিনীত সিনেমা বোধহয় নেই যেটা আমি একাধিক বার দেখিনি। সত্যিই খুব সাধ ছিল একবার অন্তত দেখি সামনে থেকে আমার প্রিয়তম নায়ককে। কিন্তু, কখনো সেই সুযোগ হয় নি। আজ তোর জন্য আমার এই ইচ্ছাপূরণ হোলো দিদি।" বলতে বলতেই মৌ-কে জড়িয়ে ধরলেন সরযূবালাদেবী। ওনার চোখে আনন্দাশ্রু।
মৌ-ও দু'হাতে জড়িয়ে ধরে ওর দিদাকে। ওর দু'চোখেও তখন জল টলটল করছে।
Comments :0