ওয়েস্ট বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট, ১৯৯৩- কে সরাসরি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্যের পৌর প্রশাসনের মদতেই প্রোমোটার অয়ন শীলের সংস্থার মাধ্যমে চলেছে একের পর এক পৌরসভায় অবৈধ নিয়োগ।  
দু’টি সংস্থার ডিরেক্টর। দু’টি সংস্থার জন্মই তৃণমূল সরকারের আমলে। একটি সংস্থার মাধ্যমে রাজ্যের প্রায় অধিকাংশ পৌরসভায় বেআইনি নিয়োগ হয়েছে, আরেকটি সংস্থা সেই সব পৌরসভার যাবতীয় নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজের বরাত পেয়েছে। এতটাই প্রভাবশালী ছিল সামান্য এক প্রমোটার অয়ন শীল? পিছনে কার মদত? কীভাবে গোটা পৌর প্রশাসনকে পকেটে পুরেই গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলল এই দুর্নীতির নেটওয়ার্ক? টাকার ভাগ কোন শীর্ষস্তর পর্যন্ত পৌঁছাতো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই দফায় দফায় জেরা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। 
  এখনও পর্যন্ত রাজ্যের মোট ৬০টি পৌরসভায় এমন টাকার বিনিময়ে নিয়োগের হদিশ মিলেছে। মূলত দক্ষিণবঙ্গের ৬০টি পৌরসভা। দমদম পৌরসভা, উত্তর ও দক্ষিণ দমদম পৌরসভা থেকে কামারহাটি, পানিহাটি, বারাকপুর, বরানগর, হালিশহর, হুগলী, হাওড়ার একাধিক পৌরসভায় এমন টাকার বিনিময়েই চাকরির দুর্নীতি হয়েছে। পার্থ-মানিক-শান্তনু-কুন্তল বাহিনী টাকার বিনিময়ে সরকারি স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বিক্রির অভিযান যখন চালাচ্ছে ঠিক একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তখন চলছে রাজ্যের একের পর এক পৌরসভায় টাকার বিনিময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া!
 অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ নিয়োগকাণ্ডে ধৃত শান্তনু ব্যানার্জির বন্ধু সেই প্রমোটার অয়ন শীলের মাধ্যমে তৃণমূলের পৌরসভার দুর্নীতির মডেল ঠিক কেমন?
  টাকা দিলেই পরীক্ষায় বসতে পারবে। টাকার অঙ্ক ন্যূনতম ৭ লক্ষ, সর্বোচ্চ ১২ লক্ষ। 
উদাহরণ হিসাবে দেখা যাক বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের গাড়ুলিয়া পৌরসভা। তৃণমূল পরিচালিত গাড়ুলিয়া পৌরসভায় বহুবার পৌরপ্রধান বদল হয়েছে। গাড়ুলিয়া পৌরসভায় স্থায়ী পদে ২৬জনের বেশি লোক নিয়োগ হয়েছে। এই নিয়োগ হয়েছে ২০১৫ সালে। লোক দেখানো একটা পরীক্ষাও নিয়েছে পৌরসভা। ওএমআর শিটেই এই পরীক্ষা হয়েছে। অয়ন শীলের এবিএস ইনফোজেনই সেই ওএমআর শিট ছাপায়, পরীক্ষার আয়োজনের দায়িত্বেও তারা।  কিন্তু পরীক্ষায় বসতে হলে আগে টাকা দিতে হবে। টাকার পরিমাণ ৭ লক্ষ থেকে ১২ লক্ষ। এলাকা ভিত্তিক ভাগ করা শাসক দলের হাতেই পৌঁছেছে সেই টাকা। মূর্শিদাবাদ, মালদহ, করিমপুর সহ উওরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে এই নিয়োগ হয়েছে। টাকার লেনদেন পৌরসভার এক কর্মচারীর মাধ্যমেই। সেখান থেকেই টাকা যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে!
  একই ভাবে দক্ষিণ দমদম পৌরসভায়তেও স্থায়ী পদে নিয়োগ হয়েছিল। এক্ষেত্রেও নিয়োগের বরাত পায় এবিএস ইনফোজেন প্রাইভেট লিমিটেড। ওএমআর শিট থেকে শুরু করে ইন্টারভিউ সমস্তটাই এই সংস্থার মাধ্যমে হয়েছে বলে জানা গেছে। পরীক্ষাটাও লোকদেখানো হয়েছে। আগে থেকেই টাকার বিনিময়ে প্যানেল নির্দিষ্ট করা ছিল। এক্ষেত্রেও টাকার পরিমাণ সর্বোচ্চ ১২ লক্ষ। এক্ষেত্রে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, খিদিরপুর এলাকার লোক নিয়োগ হয়েছে। পৌরসভায় স্থায়ী পদে নিয়োগ পেয়েছেন কিন্তু সরকারি চিঠি পর্যন্ত পড়তে পারে না, নিজের নাম কোনোমতে সই করেন এমন ব্যাক্তিও পৌরসভার স্থায়ী পদে চাকরি পেয়েছেন লিখিত পরীক্ষা দিয়েই। কীভাবে? এখানেও সেই খালি খাতা, শুধু রোল নম্বর লেখা ওএমআর শিট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌরসভার অনেক অস্থায়ী কর্মচারীরা বলছেন আমরা টাকা দিতে পারিনি তাই আমাদের স্থায়ী করার বদলে যারা টাকা দিয়েছে তাদের চাকরি হয়েছে।
হালিশহর পৌরসভার ২০১৮ সালে স্থায়ী পদে বেশ কিছু লোক নিয়োগ হয়েছে। এক্ষেত্রেও বিরাট আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে। নৈহাটি পৌরসভায় স্থায়ী পদে প্রায় একশো কর্মী নিয়োগ হয়েছে। এক্ষেত্রেও লোকদেখানো পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। সব খেলা খালি ওএমআর শিটেই। চাকরির ফর্ম রাস্তায় বসে লোকজন বিক্রি করেছে। হাজার হাজার ফরম জমা পড়েছে। এখানেও উত্তরবঙ্গ সহ মুর্শিদাবাদ, খিদিরপুর এলাকার মানুষ চাকরি পেয়েছে। 
অল বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল ওয়ার্কমেন্স ফেডারেশনের রাজ্য সভাপতি দীপক মিত্র বলেন, তৃণমূল পরিচালিত সারা রাজ্যের পৌরসভা ও কর্পোরেশনে স্থায়ী পদে নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে।  টাকা যে দিয়েছে চাকরি তার হয়েছে। সারা রাজ্যের ক্ষেত্রে বেআইনিভাবে টাকা দিয়ে এই  নিয়োগের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি, সঠিক ভাবে এবং দ্রত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
  এদিকে, এদিন সাংবাদিকদের নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ২০১৮সালে শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনে ১৮জনকে নিয়োগ করা হয়েছিল। বাম পরিচালিত বোর্ডের তরফে এই ১৮জনকে নিয়োগ করা হয়নি। এদের নিয়োগ করা হয়েছিল মিউনিসিপ্যল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে। নিয়োগ করা ১৮জনের মধ্যে সবাই ছিল মালদহ, নদীয়া ও মুর্শিদাবাদের। উত্তরবঙ্গের অন্য জেলার কেউ ছিল না। তখন আমি কোনও অভিযোগ করিনি। কেউ কেউ অভিযোগ করেন শিলিগুড়ি বা উত্তরবঙ্গের অন্য কোনও জায়গার কেউ কেন পেল না? এই প্রশ্ন অনেকের মধ্যেই মনে মনে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কোনও পৌরসভাতেই এমনটা হয়নি। শুধুমাত্র শিলিগুড়ি পৌরসভার ক্ষেত্রেই এমনটা হয়েছে। ওরা বলেছিল, আপনারা নিয়োগ করতে পারবেন না। মিউনিসিপ্যল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে আমরা নিয়োগ করে দেব। 
 অশোক ভট্টাচার্য বলেন, সার্ভিস কমিশনগুলি ছিল বামফ্রন্টের সময়ে স্বচ্ছভাবে নিয়োগের মাধ্যম। তৃণমূল সরকারের আমলে যা দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সার্ভিস কমিশনগুলির মধ্যে দিয়েই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। সার্ভিস কমিশনের উদ্দেশ্যই পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে এরা।
 
 
 
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0