Post Editorial

বাংলার স্বাস্থ্যব্যবস্থায় পিতৃতন্ত্র, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দায়

উত্তর সম্পাদকীয়​

ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী


আরজি কর, পাঁশকুড়া, দুর্গাপুর, উলুবেড়িয়া, পিজি হাসপাতাল সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলি কেবল বিচ্ছিন্ন নয়। বরং, এগুলি সমগ্র রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্নীতি, পিতৃতান্ত্রিক হিংসা, এবং রাজনৈতিক অপশাসনের নৃশংস বাস্তবতা তুলে ধরে, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়, নারীর ওপর রাষ্ট্রের দমননীতি এবং শাসকদলের নোংরা রাজনৈতিক খেলার এক ভয়াবহ যোগসূত্র স্পষ্ট।
পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আজ ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে। সরকারি হাসপাতালগুলি সিন্ডিকেটরাজের কবলে জর্জরিত। চিকিৎসক, থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পর্যন্ত প্রতিটি নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতি, রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে পদ বণ্টন, টেন্ডারে স্বজনপোষণ-অনাচারের তালিকা দীর্ঘ। রাজ্যের হাসপাতালগুলি এখন দুর্নীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এখানে চিকিৎসক বা নার্স নয়, বরং শাসকদলের ছত্রছায়ায় থাকা দালাল, ঠিকাদার ও গুন্ডারাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতালের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক। ওষুধ সরবরাহ থেকে শুরু করে টেন্ডার, অ্যাম্বুলেন্স, পার্কিং - প্রতিটি খাতে চলছে কোটি কোটি টাকার বেআইনি লেনদেন।
যখন স্বাস্থ্যক্ষেত্র কেবলমাত্র দুর্নীতির বাজারে পরিণত হয়, তখন মানুষের জীবন আর নিরাপত্তা কোনোটাই সুরক্ষিত থাকে না। হাসপাতালের আউটডোর, ওটি বা ওয়ার্ড, যা হওয়ার কথা মানবসেবার পীঠস্থান, সেখানে নারীর দেহকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় হায়েনাদের ভোজসভায়। দুর্নীতি কেবল অর্থের নয়, তা মানুষের মনুষ্যত্বকেও গ্রাস করে। এবং এই গ্রাসের ফলেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলি পরিণত হয় ধর্ষণ-খুনের আস্তানায়।
পশ্চিমবঙ্গে লিঙ্গ-ভিত্তিক হিংসার উত্থান বুঝতে হলে, এটি যে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে নিহিত তা বুঝতে হবে। ২০১১ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে পরেই চূড়ান্ত শোষণের একটা কাঠামো দ্রুত খাড়া করে ফেলে নতুন শাসক। প্রকৃতপক্ষে, রাজ্যে অতি দ্রুত ধান্দাবাজির মক্কেলদের শাসনব্যবস্থার একটা মডেল নির্মাণ করা হয়, যেখানে কাটমানি র্যা কেট, সিন্ডিকেট এবং মাফিয়া চক্রের পিরামিড নতুন ক্ষমতা-কেন্দ্র হিসাবে আবির্ভূত হয়। রাজ্যের কয়লা-বালি-পাথর, পাহাড়-জমি-জঙ্গল থেকে শুরু করে গরিব মানুষের মজুরি, আবাসন, রেশনের খাদ্য, সরকারি চাকরি— সমস্ত কিছু অবাধে লুট করে লুটের বখরা ভাগ হতে হতে সিংহভাগ পৌঁছায় ঐ পিরামিডের শীর্ষে। রাজ্যে নারী শ্রমিকদের বিপুল অংশকে মর্যাদা দিয়ে উৎপাদনের কাজে লাগানোর বদলে যৎসামান্য ভাতার বিনিময়ে তাদের বিনা মজুরির সামাজিক পুনরুৎপাদনে বেঁধে রেখে ভোট বৈতরণী পার করার কৌশল নেওয়া হয় এর সমান্তরালে।
এই রাজনৈতিক অর্থনীতির মডেলে, রূপক অর্থে তথা আক্ষরিক অর্থে নারীদেহ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাজনৈতিক দুষ্কৃতীরা নিয়মিত ভিন্নমতকে দমন করতে, শাসকদলের সাথে নেই এমন মহিলা ও তাদের পরিবারগুলিকে শাস্তি দিতে এবং জনগোষ্ঠীগুলিকে নিরুপায়-সমর্থন ও সম্মতিতে বাধ্য করতে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, হুমকি এবং ভয় দেখানোর মতো কাজ করে থাকে। পুলিশকে সংবিধানের রক্ষক হিসাবে ব্যবহার করার বদলে শাসকদলের দমনমূলক উপকরণে পরিণত করা হয়েছে। অপরাধ ঘটলে এফআইআর রুজু করতে অস্বীকার করা, ভুক্তভোগীদের ভয় বা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে মুখ বন্ধ করতে বাধ্য করা, মেডিক্যাল রিপোর্ট বিকৃত করা, তদন্তে দীর্ঘসূত্রিতা ও ঢিলেমি, অর্থের বিনিময়ে আইন-বহির্ভূত মীমাংসায় বাধ্য করার পাশাপাশি অভিযোগকারী ও প্রতিবাদীদের উপর জুলুম, তাদের  মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো, থানায় ডেকে হয়রান করা— এগুলিই পুলিশের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মডেলে। যেসব ক্ষেত্রে মিডিয়ার নজরদারি থাকে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবাদ জোরালো হয়, সেখানে শাসক ও প্রশাসনের সমস্ত মেশিনারি আসরে নামে ড্যামেজ-কন্ট্রোল করতে। আর তা করতে গিয়ে প্রায়শই ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করা হয়, অথবা অন্তহীন চলমান তদন্তের গল্পের আড়ালে অপরাধীদের সুরক্ষা দেওয়া হয়।
নারীদেহ সবসময়ই পুঁজিবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণের দ্বৈতভূমি। বাংলায় শাসকদল যে সংস্কৃতিকে লালন করছে, তা মূলত একধরনের পুরুষতান্ত্রিক আধা-ফ্যাসিবাদ। এখানে নারীর দেহকে কেবল ভোগের বস্তু হিসাবে দেখা হয়, এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাসে সেই দেহকে ব্যবহৃত করা হয় ভীতি প্রদর্শনের অস্ত্র হিসাবে। হাসপাতালের মতো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতর, ক্ষমতাসীন দলের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা নারীর দেহকে পদদলিত করেছে। অর্থাৎ, নারীর নিরাপত্তা যেখানে সর্বাধিক সুরক্ষিত থাকার কথা, সেই জায়গাতেই রাষ্ট্র পিতৃতন্ত্রের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখিয়েছে।
পিতৃতন্ত্র কেবল পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নয়, বরং একটি বস্তুগত রাজনৈতিক অর্থনীতি— যেখানে নারীর শ্রম ও দেহকে শোষণের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক স্বার্থ রক্ষা করা হয়। বাংলার বর্তমান শাসনতন্ত্রে এই শোষণ দ্বিগুণ মাত্রায় কার্যকর। একদিকে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দুর্নীতি থেকে মুনাফা লুট হচ্ছে, অন্যদিকে নারীর দেহকে অবমাননার মাধ্যমে ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ পাচ্ছে।
পিতৃতন্ত্র ও পুঁজিবাদের গাঁটছড়াই এই নীল নকশার কারিগর। এখানে লিঙ্গভিত্তিক হিংসা কেবল ব্যক্তিগত নৈতিক স্খলন নয়, পদ্ধতিগত 'শৃঙ্খলা'। দরিদ্র এবং শ্রমিকশ্রেণির নারীদের, বিশেষ করে যাঁরা জাতি, শ্রেণি, ধর্ম বা লিঙ্গের নিরিখে শাসকের নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করেন, তাঁদের উপর এই শৃঙ্খলার বেড়ি পরিয়ে চালু 'সিস্টেম'টিকে ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মডেলটিকে সচল রাখে। অর্থাৎ এই মডেল লিঙ্গগত হিংসাকে শুধু মেনেই নেয় না, তাকে শাসনের চাবুক হিসাবেও ব্যবহার করে। লক্ষণীয় যে রাষ্ট্রীয় হিংসা শ্রেণি শোষণের সাথে মিলে গেছে। লিঙ্গগত হিংসার প্রায় সব শিকার প্রান্তিক জাতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অথবা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারের। তাঁদের কোনও রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর নেই, তাঁরা কেউ প্রভাবশালী  নয়। অন্যদিকে, অপরাধীরা হয় স্থানীয় নেতা অথবা কোনও বড় নেতার, ঠিকাদারের বা পুলিশকর্তার ঘনিষ্ঠ। অর্থাৎ, রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীদার, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ এবং কাটমানি অর্থনীতিতে ফুলে ফেঁপে ওঠা খুদে-বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠীর সদস্য। এখানেই দ্বান্দ্বিকতা নিহিত-সমাজ যত বেশি অসম, স্থিতাবস্থা বজায় রাখার উপায় তত বেশি নিষ্ঠুর।
যদিও পিতৃতন্ত্রের নৈতিক পচন শতাব্দী প্রাচীন, বাংলায় লিঙ্গভিত্তিক হিংসার বর্তমান বৃদ্ধিকে নব্য উদারনীতিবাদের দ্বারা সৃষ্ট কাঠামোগত রূপান্তর থেকে আলাদা করা যায় না। এই সরকারের আমলে রাজ্য ক্রমবর্ধমানভাবে তার দায়িত্বগুলি কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে ব্যক্তিগত স্বার্থের কাছে বিকিয়ে দিচ্ছে। শাসনকে পুঁজি সঞ্চয়ের একটি হাতিয়ারে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন— সবকিছুরই বেসরকারিকরণ করছে, ক্ষেত্রগুলিকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির আখড়াতে পরিণত করেছে। ফলে এই ক্ষেত্রগুলি আর প্রথাগত ক্ষেত্র থাকছে না, অপ্রথাগত হয়ে উঠছে।
এই ধরনের কাঠামোর মধ্যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজেই বাণিজ্যিক হয়ে ওঠে। নাগরিকদের সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ এখন ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বার্থে কাজ করে। এফআইআর হয়ে দাঁড়ায় ক্রয়যোগ্য, চার্জশিট বিলম্বিত হয়, সাক্ষীদের সাক্ষ্য না দিতে বা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে জোর করা হয়। ভুক্তভোগীদের পরিবারের মুখ বন্ধ রাখতে মোটা অঙ্কের অর্থের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ন্যায়বিচার কেবল রাজনৈতিক পুঁজিপতিদের জন্য উপলব্ধ একটি লেনদেনের পণ্য হয়ে ওঠে।
মহিলা কমিশন এবং মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিকে পদ্ধতিগতভাবে অবদমিত করে রাখা হয়েছে। সেখানে নিয়োগ রাজনৈতিক আনুগত্য নির্ভর। সুপারিশগুলির বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক নয়। বিচার বিভাগ ইতিমধ্যেই বিচারাধীন মামলারভারে জর্জরিত। বিচারকদের একাংশ অবসরের পরে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবেশ করার লক্ষ্যে সতর্ক রায় দিচ্ছে, বিশেষ করে হাই-প্রোফাইল মামলাগুলিতে।
নয়া-উদারনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলির এই ক্ষয় এমন একটি শূন্যস্থান তৈরি করে, যা আইনের শাসনের বদলে অপরাধীদের সিন্ডিকেট, তোলাবাজ এবং রাজনৈতিক গুন্ডাদের দ্বারা দ্রুত পূরণ হয়ে যায়। এভাবে লিঙ্গভিত্তিক হিংসা একই সঙ্গে একটি রোগলক্ষণ এবং একটি কড়া ডোজের ওষুধ— উভয়ই হয়ে ওঠে। প্রাতিষ্ঠানিক পতনের উপসর্গ এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কড়া ওষুধ। এর মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এই বার্তা পাঠানো হচ্ছে যে তারা আসলে গুরুত্বহীন এবং প্রতিবাদী ও বিরোধীদের কাছে বার্তা পাঠানো হচ্ছে যে প্রতিরোধ করতে চাইলে চড়া মূল্য চোকাতে হবে। এককথায়, হিংসা এই শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়, বরং শাসন টিকিয়ে রাখার কার্যকরী কৌশলে পরিণত হয়েছে।
শাসকদল কেবল সংগঠিত দুর্নীতিই করে যাচ্ছে না, তার সঙ্গে একটি পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে রাজনৈতিকভাবে উৎপাদন করে চলেছে। লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থীপদ বণ্টন থেকে শুরু করে দলীয় মঞ্চে নারীর অবস্থান— সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় রূপালি পর্দার নারীরা কেবলমাত্র অলংকার। প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় তারা অনুপস্থিত। ফলে, নারীর উপর সংঘটিত হিংসা তাদের দলীয় দৃষ্টিতে কখনো অপরাধ নয়, বরং শাসনের স্বাভাবিক অঙ্গ।
বাংলা টেলিভিশন এবং সিনেমায় আধিপত্য বিস্তারকারী জনপ্রিয় সংস্কৃতিও এই পশ্চাৎগামী দৃষ্টিভঙ্গিকেই পুষ্ট করে। পিতৃতন্ত্রের সংজ্ঞায়িত শালীনতার প্রতি আচ্ছন্নতা, শ্রমজীবী নারীদের উপর নিয়ন্ত্রণের দানবীয়করণ, পিতৃতান্ত্রিক ভাবনা অনুসারে পৌরুষের অধিকারী হওয়ার রোমান্টিকতা— এই সবই এমন একটি সামাজিক পরিবেশ তৈরিতে অবদান রাখে যে সমাজে‌ লিঙ্গভিত্তিক হিংসা সহজেই কল্পনীয়, গ্রহণযোগ্য, এমনকি ন্যায্যও হয়ে ওঠে।
আন্তোনিও গ্রামসি সাংস্কৃতিক আধিপত্য সম্পর্কে বলেছিলেন, শাসক শ্রেণি কেবল বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, সাংস্কৃতিক সাধারণ জ্ঞান নির্মাণের মাধ্যমেও আধিপত্য বজায় রাখে। আজ বাংলায় এই সাংস্কৃতিক আধিপত্য আচার-অনুষ্ঠান, পৌরাণিক কাহিনি, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং এমনকি শিক্ষার মাধ্যমে পিতৃতন্ত্রকে পুনরুৎপাদিত করে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আইনি সংস্কারের চেয়েও বেশি জরুরি সাংস্কৃতিক বিপ্লব।
কেন্দ্রের‌ শাসক তথা এরাজ্যের বিরোধীদল এই ঘটনাগুলোর ভিতরেও তাদের রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী চেহারা দেখিয়েছে। একদিকে তারা এরাজ্যে নারীর নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা বলেছে, অন্যদিকে হাথরাস থেকে উন্নাও— দেশের প্রতিটি কোণে নারীর উপর অত্যাচারে তাদের ভূমিকা আমরা দেখেছি।
তাদের রাজনৈতিক কৌশল হলো দ্বিমুখী— একদিকে নারীর উপর আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক ফ্রেমে সাজিয়ে সংখ্যালঘু-বিরোধী রাজনীতি চালানো, অন্যদিকে বাংলার মতো রাজ্যে শাসকদলের দুর্নীতিকে তুলে ধরে নিজেদের বিকল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা। কিন্তু বাস্তবে তারা নারীর নিরাপত্তা বা ন্যায়বিচার কোনোটিই নিশ্চিত করে না। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই’র ভূমিকা এ ক্ষেত্রে ভয়াবহভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। দীর্ঘ সময় ধরে তদন্তে কোনও অগ্রগতি না ঘটিয়ে মামলা টেনে নিয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক চাপ অনুযায়ী তদন্তের দিক পরিবর্তন করা— এসবই দেখায় যে সিবিআই আসলে জনগণের প্রতি নয়, বরং শাসকদলগুলির প্রতি অনুগত।
আজ বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও গভীর সঙ্কটে। যে সমাজ একদিন বিদ্যাসাগর, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের মুক্তিকামী চিন্তাধারার উত্তরাধিকার বহন করত, আজ সেই সমাজে নারীর উপর নৃশংসতম অপরাধ ঘটছে জনসমক্ষে। গণমাধ্যমের একাংশ শাসকদলের পৃষ্ঠপোষকতায় এই ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। তবে এর বিপরীতে তৈরি হয়েছে এক প্রবল প্রতিরোধ। একদা গণতন্ত্রের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গ কোনকালেই অন্যায় অনাচার মুখ বুজে সহ্য করেনি। ফলে এধরনের ঘটনার প্রতিবাদে বারবার রাস্তায় নেমেছে দুর্নিবার জনস্রোত। আরজি করের ঘটনার পর আমরা দেখেছি কীভাবে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, বাম ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠন ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়েছে। কলকাতার রাজপথে লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিল প্রমাণ করেছে— জনগণ আর চুপ করে থাকবে না। এই প্রতিরোধ কেবল ন্যায়বিচারের দাবি নয়, বরং গোটা ব্যবস্থার পরিবর্তনের আহ্বান। প্রতিরোধের এই উত্তরাধিকার আকস্মিক নয়। দশকের পর দশক ধরে রাজ্যে বামপন্থী ঘরানা ও চেতনার উপস্থিতি দ্বারা নির্মিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে দ্বান্দ্বিকভাবে জন্মগ্রহণ করেছে। যৌথ সংগ্রামের স্মৃতি এখনও বাংলার সামাজিক কাঠামোতে সজীব, টাটকা। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত ক্রোধ যতই বীরত্বপূর্ণ হোক না কেন, অবস্থার বদল আনবার জন্য যথেষ্ট নয়। তাকে সংগঠিত, আদর্শভিত্তিক সচেতন রাজনৈতিক শক্তিতে লালন করা জরুরি। তা না হলে এই আন্দোলনের আগুন রাষ্ট্রযন্ত্রের ছেটানো শান্তিজলে নিভে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ইতিহাস সাক্ষী, প্রতিটি অন্ধকারের বিপরীতে জন্ম নেয় প্রতিরোধের আলো। আজ বাংলার যুবসমাজ, নারীমুক্তির আন্দোলন, বাম সংগঠনগুলি সেই আলো বহন করছে। প্রতিরোধকে আরও সংগঠিত করে বৃহত্তর গণআন্দোলনের রূপ দিতে হবে। আন্দোলন কেবল এই নির্দিষ্ট ঘটনাগুলির ফৌজদারি ন্যায়বিচারের দাবিতে নয়, বরং রাজনীতিক-আমলা-অপরাধী জোট এবং পিতৃতান্ত্রিক নৈতিক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত যে কাঠামো এই ধরনের হিংসা ঘটায়, তার অবসানের লক্ষ্যে হওয়া জরুরি।

 

Comments :0

Login to leave a comment