মহম্মদ সেলিম
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয়েছিল ১৯২০ সালের ১৭অক্টোবর তাসখন্দে। এবার পার্টির ১০৫ বছর পূর্তি। ভারতের তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, অগ্রগতি, অভিজ্ঞতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এখনও তা করে চলেছে।
প্রেক্ষাপট:
১৯১৭ সালে সোভিয়েতে বিপ্লব হয়। কমরেড লেনিন এবং বলশেভিক পার্টির পরিচালনায় সংগঠিত সেই বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল অনেক দেশে। ভারতেও তার প্রভাব পড়েছিল। দেশ তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে। মূলত কংগ্রেসের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন গান্ধীজী। তার কিছুদিন পর থেকে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। ১৯১৯-এ জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বর্বরতার বিরুদ্ধে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশের দেওয়া খেতাব পরিত্যাগ করেন। গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সেই সময়েই খিলাফৎ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের বার্তা দিয়েছিল। চৌরিচৌরার ঘটনার পর গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের একাংশের মধ্যে তৈরি হয় নৈরাশ্য। হতাশা, নৈরাশ্য কাটিয়ে দেশের তরুণ দলের একাংশ সশস্ত্র সংগ্রামের পথে দেশের স্বাধীনতা আনার লক্ষ্যে সংগঠিত হতে থাকেন। সেই পথেই গড়ে ওঠে নওজওয়ান ভারত সভা। ভগৎ সিং, রাজগুরু, আসফাকউল্লাহ খান, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ ছিলেন তার সংগঠক। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা গান্ধীজীর নেতৃত্বাধীন অহিংসার পথে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা কংগ্রেসের মঞ্চে যুক্ত থেকেছেন। আবার সশস্ত্র সংগ্রামের পথে অগ্রণী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যেও সাম্যবাদের আদর্শ প্রচার করেছেন। হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির (পূর্বে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি) সদস্য বিপ্লবীদের মধ্যে সাম্যবাদী দর্শনের প্রভাব ছিল। পরবর্তীকালে সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনেকেই আন্দামানের সেলুলার সহ দেশের বিভিন্ন জেলে মার্কসবাদ অনুশীলনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।
১৯২১-এ কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনেই প্রথম ‘পূর্ণ স্বরাজ’-এর দাবি ওঠে। মৌলানা হসরৎ মোহানি এবং স্বামী কুমারানন্দ, দুই কমিউনিস্ট সেই দাবি তুলেছিলেন। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই সাম্রাজ্যবাদ কমিউনিস্ট পার্টিকে দমনের চেষ্টা চালিয়েছে। ১৯২০ থেকে ১৯২৪— কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে চারটি ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা করে ব্রিটিশ। তারপর মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯২৯-এর ১৯মার্চ মাঝরাতে জারি হলো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ২০ মার্চ ভোর থেকে শুরু হলো দেশজুড়ে কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা হয়ে উঠল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দমননীতি এবং কমিউনিস্টদের দেশপ্রেমিক চরিত্রের এক প্রমাণ। সম্প্রতি সীতারাম ইয়েচুরি স্মারক বক্তৃতায় ইরফান হাবিব তাঁর বাবার সূত্রে একটা কথা বলেছেন। ইরফান হাবিবের বাবার কাছে পরবর্তীকালে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম বিচারক বলেছিলেন তিনি সেই সময় রাতে ঘুমোতে পারেননি। এইভাবেই শাসকরা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে ব্যবহার করে। ভারতে ব্রিটিশের ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসাবে কাজ করা এইচ উইলিয়ামসনের লেখা ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড কমিউনিজম’ বইটি প্রকাশিত হলো ১৯৩৩-এ। বইটির ভূমিকায় লেখা ছিল ‘হোয়াট ইজ কমিউনিজম?’’ উত্তরে লেখা ছিল —‘গ্রেটেস্ট ডেঞ্জার টু দ্য সিভিলাইজেশন অব দ্য মর্ডার্ন ওয়ার্ল্ড’।
একটি বিষয় এখানে তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের আগে থেকেই দেশে সাম্প্রদায়িকতার তৎপরতা দেখা গেছে। হিন্দু মহাসভা তৈরি হয়েছে। আরএসএস তৈরি হয়েছে তারপর, ১৯২৫-এ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কমিউনিস্টদের ‘গ্রেটেস্ট ডেঞ্জার’ মনে করেছে। অনেকগুলি মামলা করেছে। পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে একাধিকবার। কিন্তু কোনও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি, নিষিদ্ধ ঘোষণা তো অনেক দূরের কথা।
প্রস্তুতি পর্ব:
১৯২০-তে তাসখন্দে পার্টি গড়ে তোলার সময়েই কলকাতা, মুম্বাই (তৎকালীন বম্বে), লাহোর এবং চেন্নাই (তৎকালীন মাদ্রাজ), দেশের এই চারটি জায়গায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। উদ্যোক্তাদের একে অপরের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। প্রথম থেকেই কমিউনিস্টরা দেশের শ্রমিক, কৃষক এবং সমাজের পিছিয়ে থাকা, নিপীড়িত অংশের মানুষকে স্বাধীনতার সংগ্রামে সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ১৯২৮-এর। কলকাতার পার্ক সার্কাসে কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। শহীদ মিনার (তৎকালীন মনুমেন্ট)-এর সামনে থেকে হাজারো শ্রমিক মিছিল করে কংগ্রেসের অধিবেশনে পৌঁছান। তাঁদের মেজাজ দেখে অধিবেশনে তাঁদের প্রবেশের অনুমতি দিতে বাধ্য হন কংগ্রেস নেতৃত্ব। চটকল, সুতাকল সহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের মুখে সেদিন স্লোগান ছিল ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’,‘পূর্ণ স্বরাজ চাই’ ইত্যাদি। সেই বিরাট মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ, আবদুল হালিম, বঙ্কিম মুখার্জি, রাধারমন মিত্র প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতারা। সেই সময়ের আগেই শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছেন কারখানাগুলিতে। কলকাতায় গাড়োয়ান ধর্মঘটের সংগঠকও ছিলেন কমিউনিস্টরা। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার সময় বোঝা যায় কমিউনিস্টরা বন্দর এলাকাকে মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছে। বন্দরে নজরদারি এড়িয়ে নানান দেশ থেকে সংবাদ ও বইপত্র আনা নেওয়ার সুযোগ ছিল। সাথে দেশবিদেশের বিভিন্ন ধরনের মানুষের মধ্যে মিশে থাকার সুবিধা। তাই বন্দর শ্রমিকদেরও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সংগঠিত করেছিলেন কমিউনিস্টরা।
কমিউনিস্ট পার্টি গোড়া থেকেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে সমাজের সব শোষিত মানুষকে যুক্ত করার লক্ষ্যেই কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত হয়েছে। সেই সময়ে সীমিত রসদ নিয়েও কমিউনিস্ট পার্টি পত্রিকা, বই, পুস্তিকা প্রকাশ, ছাপাখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় পার্টি নিজস্ব অবস্থান নিয়েছে এবং তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
সুমহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার:
এখনও পার্টি সেই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। প্যালেস্তাইনে লাগাতার হামলা চালাচ্ছে ইজরায়েলের জায়নবাদী, সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা। তাদের মদত দিচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং অন্যান্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি। সেখানে শিশু, নারী সহ নানা অংশের মানুষকে খুন করছে এই শক্তি। এমনকি সাংবাদিকরাও তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। প্যালেস্তিনীয়দের নিজভূমে পরবাসী করছে এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। কমিউনিস্ট পার্টি বরাবর প্যালেস্তাইনের মানুষের স্বাধীনতা, অধিকারের পক্ষে থেকেছে। তাঁদের পক্ষে লড়াই করেছে। সোভিয়েত রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের সাময়িক বিপর্যয়ের পর পৃথিবীতে দক্ষিণপন্থার আগ্রাসন বেড়েছে। এখনও তা জারি আছে। তবে এখন বিভিন্ন দেশে দক্ষিণপন্থী শাসকদের নীতির বিরুদ্ধে মানুষ আন্দোলনে সোচ্চার হচ্ছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দক্ষিণপন্থার আগ্রাসনের এই যুগেও পৃথিবী জুড়ে কমিউনিস্টরা প্যালেস্তাইন সহ বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের লড়াইয়ের পাশে থেকেছে। কিউবা, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সংহতিতে ভারতের কমিউনিস্টরা স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি নানাভাবে এর বিরুদ্ধে মিডিয়া সহ নানা মাধ্যমকে ব্যবহার করে আমাদের বিরুদ্ধে বিরূপ ধারণা গড়ে তোলার চক্রান্ত চলছে। কিন্তু আমাদের পার্টি সেই সব দেশের মানুষের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা যতটা হচ্ছে আমাদের দেশে হয়তো ততটা হয়নি। কারণ সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের দেশে কমিউনিস্ট সহ বামপন্থীদের দুর্বল করা হয়েছে। তবু আমরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, সমাজতন্ত্রের পক্ষে আমাদের সংগ্রাম জারি রেখেছি।
লক্ষ্য সমাজতন্ত্রই:
সমাজতন্ত্রের সাময়িক বিপর্যয়ের পরে পৃথিবী জুড়ে এই ধারণা প্রচার করার চেষ্টা করেছিল সাম্রাজ্যবাদী, দক্ষিণপন্থী শক্তি যে, সমাজতন্ত্র শেষ। শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবাদ মূল্যহীন। সাম্রাজ্যবাদ বলে কিছু নেই। আমাদের পার্টি সেই সময়েও সমাজতন্ত্রের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ঘোষণা করেছে। আমরা মনে করি এই যুগ সাম্রাজ্যবাদের পতন এবং সমাজতন্ত্রের উত্তরণের যুগ। আমরা সাম্যের গান গাই। আমাদের পার্টি গোড়া থেকেই শোষণহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। এমন এক সমাজ যেখানে আর্থিক, সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মানুষ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। আমাদের দেশের শাসন ক্ষমতায় এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক, নয়া ফ্যাসিবাদী দল। কিন্তু ভারতের উপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চড়া শুল্ক চাপানোর পর অনেকেই এখন আবার সাম্রাজ্যবাদের উপস্থিতি, তার শোষণ, আগ্রাসনের কথা বলতে শুরু করেছেন। আমরা বরাবর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের নতিস্বীকারের বিরোধিতা করেছি। আমরা দুনিয়া জুড়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের সংহতির কথা বলেছি, সেই উদ্যোগে আমরা বরাবর সামনের সারিতে থেকেছি। আজ সেই সংহতি আন্দোলনের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতির শক্তিশালী উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের চাহিদা। পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রমিক, কৃষক সহ মেহনতি মানুষ, ছোট ব্যবসায়ী, ছাত্র, যুব, মহিলা সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে যুক্ত করার দায়িত্ব পালন করতে হবে সিপিআই(এম)’র নেতা, কর্মীদের। পাশাপাশি পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙে আমূল পরিবর্তন আমাদের লক্ষ্যে ‘সমাজতন্ত্রই বিকল্প’ এই প্রচারকে জোরদার করতে হবে।
লড়াই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে:
আমাদের পার্টি গড়ে ওঠার প্রথম থেকে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আমাদের সমাজে এই বিপজ্জনক শক্তির উপাদান ছিল। তার বিরুদ্ধে লড়াই করেই আমাদের পার্টিকে এগতে হয়েছে। ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি দৃঢ় ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৩৮-এ কারাগারের থাকাকালীন মানবেন্দ্রনাথ রায় লেখেন,‘‘সনাতনী জাতীয়তাবাদের গেরুয়া পতাকার নিচে স্বরাজ, রামরাজ্য নয় বরং হিটলাররাজে পরিণত হবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল।’’ দক্ষিণপন্থী, সাম্প্রদায়িক শক্তি বরাবর দেশে কমিউনিস্ট, বামপন্থী, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে নিকেশ করার চেষ্টা করেছে। তা শুধু আমাদের দেশের দক্ষিণপন্থী শক্তির চরিত্র তা নয়। এই শক্তির পিছনে পূর্ণ মদত দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ। আমরা দেখেছি মুজাহিদিন, তালিবানি, আইসিস-এর মতো শক্তির পিছনেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদত ছিল। তারাই তৈরি করেছিল সন্ত্রাসবাদী শক্তিকে। সেই শক্তিগুলি নিজের এবং অন্য দেশে কমিউনিস্ট, বামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল শক্তিকেই তাদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে, তাদের আক্রমণ করে। যে ধর্ম কিংবা জাতের নামে তারা সমাজকে ভাগ করতে চায়, শাসন করতে চায়, সেই ধর্ম কিংবা জাতের অন্তর্ভুক্তির মধ্যেও যারা প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ তাঁদেরও আক্রমণ করে তারা। আসলে ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক শক্তিকে দুর্বল না করতে পারলে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তি সমাজকে, দেশকে কলুষিত করতে পারে না। আর যেহেতু সেই ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক মানুষ কিংবা সংগঠনগুলির মধ্যে কমিউনিস্টরা অগ্রগণ্য এবং সবচেয়ে সোচ্চার তাদের দর্শনের কারণে, তাই কমিউনিস্টরা এই ধর্মোন্মাদ শক্তির আক্রমণের লক্ষ্য হয় আগে। নাৎসি-শাসিত জার্মানি থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর উদাহরণ আমরা দেখেছি। আমাদের দেশেও অভিজ্ঞতা তাই। আমাদের দেশে নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান দেখা গেছে। এই সময়েও দেখা গেছে তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য আমরাই। আসলে এই দ্বন্দ্ব মতাদর্শগত। তাই সব ধরনের মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে হবে আমাদের।
আমাদের দেশে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র তৈরির প্রোজেক্ট চলছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যা একসময় ছিল ছিদ্র আজ বড় বড় গহ্বরে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন প্রতীক, চিহ্নকে ব্যবহার করে মাথা তুলছে উগ্র দক্ষিণপন্থী এই শক্তিগুলি। এমন সময়ে প্রবল মন্দায় আক্রান্ত দেশ। মানুষের রুটিরুজি সঙ্কটে। কাজের হাহাকার, কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছেন না। খেতমজুরের মজুরি বাড়ছে না, কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকরা। তাই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার প্রথম দিকেই শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রদের সংগঠন তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীকালে যুবদের সংগঠন গড়ে ওঠে। গড়ে তোলা হয়েছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন। সব ধরনের মাধ্যমকে ব্যবহার করে সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। আইপিটিএ গড়ে তোলার কয়েক বছরের মধ্যে এল ’৪৩-এর মন্বন্তর। তখন যেমন ‘নবান্ন’ নাটক হয়েছে, কালজয়ী গান লেখা হয়েছে, তেমনই আইপিটিএ’র সিদ্ধান্ত অনুসারে খাজা আহ্মেদ আব্বাসকে দিয়ে ‘ধরতিকে লাল’ চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। এটি একটি উদাহরণ। তখন তা ছিল নতুন মাধ্যম। কমিউনিস্ট পার্টি তা ব্যবহার করেছে। আবার প্রায় সেই সময়েই মহিলা আন্দোলন গড়ে উঠেছে। তৈরি হয়েছে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। একদিকে তা সেবামূলক কাজ করেছে। আবার মহিলাদের নির্যাতন, পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। একদিকে সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন, সমাজে ঐক্য সংহতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। আবার সেই সময়েই মহিলাদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করা, উপার্জনের বিভিন্ন প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করেছে।
বর্তমানে রাজ্যে এবং দেশে মহিলারা আক্রান্ত। একদিকে স্কুলে কলেজে ড্রপ আউট বাড়ছে, নাবালিকা বিয়ে বাড়ছে, নারী পাচার বাড়ছে। অন্যদিকে কাজের অনিশ্চয়তায় ভুগছে নারী সমাজ। সমাজে এখন নারীদের বিরাট অংশ কাজের সন্ধানে আছেন। কিন্তু কাজ পাচ্ছেন না। আমাদের রাজ্যে রামমোহন, বিদ্যাসাগরের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে পিছিয়ে যাওয়ার মানসিকতা, দর্শন উৎসাহিত করছে দুই শাসক দল। মহিলাদের সাহস বাড়ানো, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বদলে মুখ্যমন্ত্রী এমন কথা বলছেন যাতে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠার দুঃসাহস পাচ্ছে। যে সংস্কৃতি, জীবনচর্চার জন্য আমাদের রাজ্য ছিল দেশের প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ভরসাস্থল, সেই রাজ্যে তৃণমূল এমন পরিবেশ সৃষ্টি করছে যাতে সাম্প্রদায়িক এবং পিছিয়ে থাকা সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা উৎসাহিত হচ্ছে। যার সুযোগ ব্যবহার করছে নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তি। রাজ্যে উগ্র দক্ষিণপন্থার পরিসর বাড়িয়ে তোলায় ভূমিকা পালন করছে রাজ্যের শাসক দল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মহিলাদের রাতে বাইরে বেরোনো উচিত নয় বলে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন দুর্গাপুরে এক ছাত্রী ধর্ষিতা হওয়ার পর। অন্যদিকে, সেই একই সময়ে বিজেপি-শাসিত গুজরাটে আহমেদাবাদ পুলিশ রাস্তায় ‘ধর্ষণ এড়ানোর জন্য বেশি রাতের পার্টি এড়িয়ে চলুন’ লেখা পোস্টার সাঁটিয়েছে রাস্তাগুলিতে। এরা ইতিহাসের চাকাকে পিছন দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাস বলছে স্বাধীনতাকামী, মুক্তিকামী মানুষের অগ্রগতি দমিয়ে রাখা যায় না।
আন্দোলনই পথ:
এই পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে আমাদের পার্টি। প্রগতিশীল ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কমিউনিস্ট পার্টিকেই পালন করতে হবে। রাজ্যে শাসক দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই করছে পার্টি। দুর্নীতি যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে, তাই দুর্নীতি-বিরোধী এই লড়াই তাই গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। আবার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিটি ক্ষেত্রে সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে আমাদের পার্টিকে। শুধু প্রতিবাদ নয়, এই ক্ষেত্রে নারীদের আত্মরক্ষা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্ষম করে তোলার জন্যও পার্টি কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন জায়গায় ইতিমধ্যেই গড়ে তোলা হচ্ছে মহিলা ব্রিগেড। অন্যদিকে করোনার সময় আমরা দেখেছি, আবার রাজ্যের উত্তরদিকের জেলাগুলিতে সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের সময়ে, দক্ষিণের কয়েকটি জেলায় বন্যার সময়ে দেখা গেল পার্টির কর্মীরা, বিভিন্ন গণসংগঠনগুলির কর্মীরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমার দেখেছি মানুষ সাড়া দিয়েছেন আমাদের উদ্যোগে। পাশাপাশি আমাদের পত্রপত্রিকা, বিভিন্ন পুস্তিকা, বইকে ঘিরে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু এখানে থেমে থাকলে হবে না। এই সবই আমাদের তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া একটি রূপোলি রেখা।
গত বেশ কয়েক বছরে আমাদের পার্টিকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছে। শহীদ হয়েছেন অনেকে। অনেককে ঘরছাড়া করা হয়েছে। হাজারও পার্টিকর্মীর বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। সবই করা হয়েছে আমাদের নিকেশ করার লক্ষ্যে। কিন্তু এত বাধার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও মানুষের পাশে সঙ্কটের সময়ে পার্টিকর্মীরা সবার আগে ছুটে যাচ্ছেন, সবার আগে পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করার উপযোগী হিসাবে নিজেদের গড়ে তুলছেন। আমরা আমাদের পার্টির রাজ্য সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আন্দোলনমুখী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ভোটে কারচুপি হোক কিংবা মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত, অথবা ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর)-এর নামে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রই হোক, তার জন্য বুথস্তর থেকে দৃঢ়, আন্দোলনমুখী সংগঠন গড়ে তোলাই আজকের প্রধান কাজ। তার জন্য ‘গ্রাসরুট লেবেল স্ট্র্যাটেজি’ নিতে হবে। অর্থাৎ মানুষের প্রতিদিনকার সমস্যা, বিভিন্ন এলাকায় সেখানকার মানুষের ভিন্ন সঙ্কট নিয়ে আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে সেই কাজ হচ্ছে সেসব এলাকায় সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে বিপুল। তাকে আরও ব্যাপকভাবে সর্বগামী করে তুলতে হবে। প্রচলিত আন্দোলনের পাশপাশি দলিত, তফসিলি জাতি, আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাও আজকের দাবি।
পার্টির আজকের প্রতিষ্ঠা দিবসে আমরা শপথ নেবো আন্দোলনই পথ পরিস্থিতি পরিবর্তনের। প্রতিদিন পথে থাকবো আমরা; পথে নেমেই ভবিষ্যতের পাথেয় জোগাড় করবো। আরও অনেক মানুষকে সংগঠিত করবো, মানুষের চাহিদাকে বুঝে সেই অনুসারে দাবি নির্দিষ্ট করবো এবং তাঁদের সমস্যা, আশা আকাঙ্ক্ষাকে আন্দোলনে রূপায়িত করবো। শুধু সেখানেই দায়িত্ব শেষ হয় না, সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবো।
সামনে বিধানসভা নির্বাচন। আমরা চাই আন্দোলনমুখী, দৃঢ় সংগঠন এবং আন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষে জয় ছিনিয়ে আনতে।
Comments :0