BOOK — PARTHAJIT GANGOPADHAYA — MANIK BANDHOPADHAYA — MUKTADHARA — 28 OCTOBER 2025, 3rd YEAR

বই — পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় — কলমপেষা মজুরের এক আশ্চর্য জীবনকথা — মুক্তধারা — ২৮ অক্টোবর ২০২৫, বর্ষ ৩

সাহিত্যের পাতা

BOOK  PARTHAJIT GANGOPADHAYA  MANIK BANDHOPADHAYA  MUKTADHARA  28 OCTOBER 2025 3rd YEAR

বইমুক্তধারা 

 

কলমপেষা মজুরের এক আশ্চর্য জীবনকথা

পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

১৪ অক্টোবর ২০২৫, বর্ষ ৩
 


গল্পের মতোই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের‌ জীবন। ঘটনাবহুল, সংগ্রামময়। অভাব-অনটনে জর্জরিত।  দারিদ্রের কষাঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও  আদর্শচ্যুত, পথভ্রষ্ট হননি তিনি। লেখাই ছিল তাঁর জীবিকা, সর্বক্ষণের লেখক। যে লেখা বিকোয় ভালো, না, পরিকল্পিতভাবে তেমন  লেখা লেখেননি কখনো। ফ্রয়েডের থেকে মুখ ফিরিয়ে পৌঁছেছেন জীবনের আরও কাছাকাছি । মার্কস হয়ে উঠেছেন তাঁর আশ্রয়, পথপ্রদর্শক। মানিকের লেখায় ঘুরেফিরেই এসেছে জীবনের কথা, মানুষের কথা।  নিজেই বলেছেন তিনি, 'জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি, অন্যকে তার অতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেবার তাগিদে আমি লিখি।'
মানিকের অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি আমাদের সত্যিই বিস্মিত করে! বানিয়ে আর যাই হোক, 'পদ্মানদীর মাঝি' বা 'পুতুলনাচের ইতিকথা' লেখা যায় না। যিনি জীবনকে নিবিড়ভাবে দেখেছেন, জীবনের কথা লিখেছেন, তাঁর দৈনন্দিন জীবন কেমন ছিল, সে কৌতূহল তো রয়েই যায়!  বিক্ষিপ্তভাবে নানা স্মৃতিচর্চায় মানিকের জীবনের বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা লেখা হলেও  তাঁর যথার্থ জীবনী রচনার প্রয়াস মালিনী ভট্টাচার্যের আগে কেউ করেননি। 
মানিকের জীবনসংগ্রাম,  প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও চারিত্রিক দৃঢ়তা, গভীর প্রত্যয় নিশ্চিতভাবে আমাদের প্রাণিত করতে পারে।‌ এমন যাঁর জীবন, সে- জীবনের কথা ঘটনা পরম্পরা, ধারাবাহিকতা মেনে  কেন আরও আগে লেখা হয়নি, তা ভেবে অবাক হতে হয় বৈকি‌ !
সমসাময়িক বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্করকেও দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল, সে-লড়াই ছিল মূলত প্রথম জীবনে। পরে অবস্থা-পরিস্থিতি আংশিক হলেও পরিবর্তিত হয়েছে। মানিকের জীবনে দারিদ্র ছিল নিত্যসঙ্গী। সীমাহীন অর্থকষ্ট। চিন্তায় দুশ্চিন্তায় প্রতিনিয়ত পরিবারজীবন বিঘ্নিত ও বিপন্ন হয়েছে। যাঁর কলমে মহৎ সাহিত্য অনবরত সৃষ্টি হয়েছে, বাংলা সাহিত্যোর ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁর কী দুর্গতিময়  জীবন ছিল, তা ভাবলেই হতবাক হতে হয়! দারিদ্রের যন্ত্রণা বুঝি মৃত্যুর পরও ধাওয়া করেছিল তাঁকে। 
   মানিক তখন গুরুতর অসুস্থ। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যথেষ্ট দেরি,পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে‌ ওঠে।  সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন, এ যাত্রায়  আর তাঁকে বাঁচানো যাবে না। মৃত্যু অনিবার্য। হাসপাতলে নিয়ে যাওয়ার সময় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় মানিকের পত্নী কমলাকে বলেছিলেন,'এমন অবস্থা  আগে টেলিফোন করেননি কেন? কমলা দেবী মলিন হেসে অস্ফুটস্বরে সুভাষকে বলেছিলেন, 'তাতে যে পাঁচআনা পয়সা লাগে ভাই!' 
ঘটনাটির কথা মানিকের হাসপাতালযাত্রার আরেক সঙ্গী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচর্চায় আছে।
সেদিন হাসপাতলে যাঁরা নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের সকলেরই মনে হয়েছিল, আরও কয়েকদিন আগে  হাসপাতালে  আনলে মানিককে  বাঁচানো যেত। তাদের আশঙ্কা ভর্তি করার পরের দিনই সত্যি হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে মানিকের।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বড়ো লেখককে জীবদ্দশায় এত কষ্ট পেতে হয়েছিল, তা ভাবতেও খারাপ লাগে। ব্যক্তিগত সঙ্কট-বিপর্যয় নিয়ে মানিক যে খুব ভাবিত ছিলেন, তা নয়। বৃহত্তর মানুষের দুঃখযন্ত্রণাই তাঁকে সারাক্ষণ ভাবিয়েছে। 
মালিনী ভট্টাচার্যের পাণ্ডিত্য প্রশ্নাতীত। বিশ্ববিদ্যালয়ে‌ সুদীর্ঘকাল সুনামের সঙ্গে পড়িয়েছেন। যখন যেটুকু কাজ করেছেন, তা প্রবন্ধ-রচনা বা বই-লেখা যাই হোক না কেন, গভীর অধ্যবসায়, নিষ্ঠায় করেছেন। 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি জীবনী' নামাঙ্কিত বইটিতেও সে-চিহ্ন ছড়ানো রয়েছে। কোথাও অতিরঞ্জন নেই। আপন মনের মাধুরী মেশানোর  অপচেষ্টা নেই। যেখানে যেটুকু তথ্য ছড়ানো ছিল, তা একত্রিত করেছেন। অনুসন্ধানে ও অনুসন্ধিৎসা নতুনতর তথ্যেরও সন্ধান পেয়েছেন তিনি।  চেনা-অচেনা তথ্যের আলোকে মালিনীর হাতে মানিকের একটি প্রামাণ্য জীবনী রচিত হয়েছে।
অনেক সময় জীবনী রচনা করতে গিয়ে কেউ কেউ গল্প-উপন্যাসের মেজাজ আরোপিত করে থাকেন। কল্পনার প্রলেপ দেওয়া হয়। এর ফলে জীবনী প্রামাণ্যতা হারায়। জীবনীকারের মধ্যে গবেষকের অনুসন্ধিৎসা জরুরি। মালিনী ভট্টাচার্যের মধ্যে তার যে অভাব ঘটেনি, তা বলা-ই বাহুল্য! 
মানিকের জীবনে ঘটনার ঘনঘটা। শৈশব- বাল্যেই কত বিপর্যয়-সঙ্কট‌! ছ’বছর বয়সে তাঁকে পাগলা কুকুরে কামড়েছিল। শৈশব-বাল্যের স্মৃতি মিশিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘আমার কান্না’ ও ‘বড়ো হওয়ার দায়’ নামে দুটি রচনা। অচিরেই মানিক কান্না মুছে বড়ো হওয়ার পথে যাত্রা করেছেন। সে-পথটি  নিষ্কণ্টক ছিল না। সব বাধা পেরিয়ে, সব বাধা মাড়িয়ে যাত্রা করেছেন লক্ষ্য পূরণের পথে। তরুণ বয়সে প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় কীভাবে  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখকসত্তা জেগে উঠেছিল, তা আমাদের কম-বেশি জানা ! বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে‌ তিনি যে গল্পটি লিখেছিলেন, সে গল্পের নাম 'অতসীমামী'। ‘অতসীমামী’-ই  মানিকের প্রথম ছাপা  গল্প, এমন এক ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। বাস্তবে তা নয়, ‘অতসীমামী’ জমা দেওয়ার পরে পরেই  ‘ম্যাজিক’ নামে একটি গল্প মানিক জমা দিয়েছিলেন 'গল্পগুচ্ছ' পত্রিকায়। ‘অতসীমামী’ ছাপা হয় ‘বিচিত্রা'’র পৌষ সংখ্যায়। ‘ম্যাজিক'’ গল্পটি ছাপা হয়েছিল বেশ কয়েক মাস আগে, ‘গল্পগুচ্ছ’-র আশ্বিন সংখ্যায়। এ কথা সত্য, নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘অতসীমামী’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম গল্প নয়।' অতসীমামী'  ছাপা হওয়ার পর ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মানিকের বাড়িতে পত্রিকা পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। শুধু লেখক কপি নয়, সম্মানদক্ষিণাও দিয়ে এসেছিলেন। সেই স্ফুরণের কাল থেকে কীভাবে মানিক ‘কলমপেষা মজুর’ হয়ে উঠেছিলেন, রয়েছে তথ্যনিষ্ঠ সে-বর্ণনা। ‘কলমপেষা’ এই ‘মজুর'’কত না চমকিত হওয়ার মতো লেখা লিখেছেন, যা আমাদের সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ, অথচ তাঁকে বিনা চিকিৎসায় বেঘোরে মরতে হয়েছে। সেই রূঢ় সত্য মালিনী ভট্টাচার্যের কলমে বড়ো জীবন্ত, মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে।
মানিকের জন্মশতবর্ষে এ বইটি ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ নামে বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। দীর্ঘদিন নিঃশেষিত থাকা ‌বইটি সরকারি উদ্যোগে কেন দ্রুত পুনরায় প্রকাশিত হয়নি, সে প্রশ্ন তো রয়েই যায়! মালিনী ভট্টাচার্য বইটির নামে শুধু দুটি শব্দ সংযোজন করেননি, ভেতরেও‌ অনেক নতুন তথ্য সংযোজিত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে নথি, প্রয়োজনীয় চিত্রমালা। ভালো কাগজে ছাপা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেট্রিকুলেশনের শংসাপত্র থেকে শুরু করে বহু নথি, অনেক পারিবারিক ছবি। আগের সংস্করণে নির্ঘণ্ট  ছিল না। এবার সেটিও যুক্ত হয়েছে। বলা যায়, কলমপেষা মজুরের জীবনকথা সম্পূর্ণতা পেয়েছে।
 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি জীবনী
মালিনী ভট্টাচার্য। আর বি এন্টারপ্রাইসেস। কলকাতা--৭০০০৩২। ৩০০ টাকা।

Comments :0

Login to leave a comment