সুদীপ দত্ত
যখন এই প্রবন্ধটি লেখা হচ্ছে, তখন গাজায় ইজরায়েল সিজ ফায়ার ঘোষণা করেছে এবং মানুষ ধীরে ধীরে ঘরে ফিরছেন। যদিও এর মধ্যে ৬৭,০০০-এরও বেশি প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করা হয়েছে (বাস্তব সংখ্যা অনেক বেশি)। কিন্তু এই প্রবন্ধ ইজরায়েলের দানবীয় আচরণ— যা এই শতাব্দীর, সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সর্ববৃহৎ এক গণহত্যার পরিসংখ্যান– তার বিবরণের জন্য নয়।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব তিনটি বিষয় নিয়ে। প্রথমত, কিভাবে দখলদারির অর্থনীতিকে গণহত্যার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী কর্পোরেশনগুলো প্যালেস্তাইনে পরিকল্পনা করেছে এবং গাজাকে অস্ত্র পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদন মূল্য শৃঙ্খলে (production value chain) আঘাত করে কিভাবে শ্রমজীবী শ্রেণি বর্তমান পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, বিশেষ করে অস্ত্র পরিবহণের পথে অবরোধ সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতিকে শ্রেণিসংগ্রামে পরিণত করার ক্ষেত্রে বিশ্ব শ্রমজীবী আন্দোলনের ভূমিকাই বা কিরকম হতে পারে, যা আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রকৃত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হবে।
প্যালেস্তাইন ও গণহত্যার অর্থনীতি
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদের ‘দখল অর্থনীতি থেকে গণহত্যার অর্থনীতি’ প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে, অস্ত্র, প্রযুক্তি, নির্মাণ, কৃষি, বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং শিক্ষা ব্যবসায়ে যুক্ত ১,০০০-এরও বেশি কর্পোরেশন সরাসরি বা পরোক্ষভাবে প্যালেস্তাইনে গণহত্যা থেকে লাভবান হচ্ছে। এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে ইজরায়েলের সামরিক শিল্প কমপ্লেক্স। এলবিট সিস্টেমস এবং ইজরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (IAI) এই সামরিক ক্ষেত্রের দখলদারি নিজেদের হাতে রেখেছে এবং এরা ইজরায়েলের ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে। বিশ্বের শীর্ষ ৫০টি অস্ত্র উৎপাদকের মধ্যে স্থান পাওয়া IAI এই আগ্রাসনের সময়ে লকহিড মার্টিন এবং লিওনার্ডো এসপিএ (ইতালি)-র সঙ্গে মিলিতভাবে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমানের উপাদান সরবরাহ করে। এফ-৩৫ এবং এফ-১৬-এর মতো জেট ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ওপর প্রায় ৮৫,০০০ টন বোমা ফেলেছে যার ফলে ১,৭৯,০০০-এরও বেশি প্যালেস্তিনীয় নাগরিক নিহত বা আহত হয়েছে। অন্যান্য কোম্পানি, যেমন রাইনমেটাল এজি, এপি মোলার–মার্স্ক, এবং ফ্যানুক (FANUC), এই অঞ্চলে বিস্ফোরক, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা (Logistics) এবং রোবোটিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং পরীক্ষা করে এবং এদের সব অস্ত্র তারপরে আন্তর্জাতিকভাবে ‘গাজায় প্রমাণিত হত্যাযন্ত্র’ হিসাবে বিক্রি হয়। মনে করা যেতে পারে আইজি ফার্বেন, সিমেন্স, ক্রুপ এবং ভল্কসওয়াগেন ইত্যাদি কোম্পানির ভূমিকা হিটলারের যুদ্ধ অর্থনীতিতে কেমন ছিল, অথবা ডাউ কেমিক্যাল, মনসান্টো এবং ডায়মন্ড শ্যামরক কীভাবে ভিয়েতনামে মার্কিনদের দ্বারা ব্যবহৃত মারাত্মক ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ উৎপাদন করত।
দখলকৃত অঞ্চলগুলোর নজরদারিও পুঁজিবাদের জন্য একটি ল্যাবরেটরি। এনএসও গ্রুপের পেগাসাস স্পাইওয়্যা র - এক্টিভিস্ট, সাংবাদিক এবং বিরোধীদের ওপর নজর রাখার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। আইবিএম, এইচপি এবং মাইক্রোসফট বায়োমেট্রিক এবং কারাগার সুরক্ষার আইটি সিস্টেম পরিচালনা করে এবং সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ক্লাউড সেবা সরবরাহ করে। গুগল এবং অ্যামাজন মিলিতভাবে পরিচালনা করে প্রজেক্ট নিম্বাস, যা আসলে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের AI-ক্লাউড টেকনোলজির চুক্তি। একই সঙ্গে প্যালান্টির টেকনোলজিস সরবরাহ করে প্রেডিক্টিভ ওয়ারফেয়ার সফটওয়্যা র, যার বিজ্ঞাপনে গণহত্যায় প্রয়োগের কথা খোলাখুলিভাবে স্বীকার করা হয়েছে। নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণকে এখানে পণ্যায়িত করা হয়েছে। এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যেখানে প্যালেস্তাইনের ওপরে শোষণ ও বিরোধ দমন করার প্রযুক্তি সফল পরীক্ষার পরে দুনিয়ার বাজারের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে।
বিশ্বব্যাপী ফাইন্যান্স কোম্পানি ও শিক্ষা ব্যবসার সাথে যুক্ত সংস্থাগুলোও এই প্রক্রিয়ার দ্বারা সরাসরি লাভ করছে। বিএনপি পারিবাস এবং বার্কলের মতো ব্যাঙ্ক ইজরায়েলি যুদ্ধ বন্ডকে সহযোগিতা করে, ব্ল্যাকরক, ভ্যানগার্ড এবং অ্যালিয়াঞ্জের মতো এসেট ম্যানেজাররা অস্ত্র উৎপাদকদের ব্যবসায়ে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। এমআইটি, বেন-গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিউনিখের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ইইউ হরাইজেন তহবিলের মাধ্যমে ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে। প্যালেস্তিনীয়দের ওপর পরীক্ষিত ড্রোন এবং নজরদারি করার প্রযুক্তি নির্মাণে সাহায্য করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো, উদ্ভাবনের ছদ্মবেশে গণহত্যার পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করে গবেষণাকে মৃত্যু এবং দখলের ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রেখেছে।
‘নাগরিক প্রযুক্তি’কেও প্যালেস্তাইনে অস্ত্রায়িত করা হয়েছে। কেটারপিলার, এইচডি হুন্ডাই, দুসান, ভলভো ও হেইডেলবার্গ ম্যাটারিয়ালস এমন ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে যেগুলো গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের সমস্ত নির্মাণ কাঠামো ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়। অক্টোবর ২০২৩ থেকে গাজার আবাসন ও কাঠামোর প্রায় ৭০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং কেটারপিলারের ডি-৯ বুলডোজার নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক ধ্বংসের জন্য দূরনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। হেইডেলবার্গ দখলকৃত জমিতে খনন কাজ করে; কেলার উইলিয়ামস দখল করা, চুরি করা বাড়ি বাজারজাত ও বিক্রি করে; এবং শেভ্রন, বিপি, ড্রুমোন্ড ও গ্লেনকোরের মতো এনার্জি কোম্পানিগুলো ইজরায়েলের ট্যাঙ্ক, ড্রোন ও অন্যান্য দখলদারির যন্ত্রপাতিতে জ্বালানি ও সরঞ্জাম সরবরাহ করে।
কৃষি ব্যবসা ও খাদ্য-রপ্তানি সংস্থাগুলোও প্যালেস্তাইনের জল ও জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ থেকে লাভবান হয়। ইজরায়েলি কৃষি-প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো দখল করা জমিতে রপ্তানির জন্য চাষ করে। উল্টোদিকে প্যালেস্তাইনের কৃষকদের সেচের জল বন্ধ করে দেওয়া হয়। নেটাফিম-এর মতো কৃষি-বাণিজ্য সংস্থা, যা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের দখল করা বসতি এলাকায় কাজ করে, তারা এমনকি ভারত থেকেও অনুদান পায়। পর্যটন ও রিয়েল-এস্টেট কোম্পানিগুলো নির্জন গ্রামগুলোর দখল নিয়ে সেখানে ট্যুরিজমের ব্যবসা চালায়; Booking.com এবং Airbnb-এর মতো সংস্থা দখলকৃত সম্পত্তি থেকে কমিশন আদায় করে। রপ্তানি নেটওয়ার্কগুলো কৃষি পণ্য, ওয়াইন, খনিজ এবং বস্ত্রকে কলোনি থেকে বিশ্ববাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে ।
ভারতীয় কর্পোরেটগুলোও নানাভাবে এর সাথে যুক্ত। বহু বড় ভারতীয় কর্পোরেশন, বেসরকারি শিল্পগোষ্ঠী ও সরকারি সংস্থা (PSU) সবাই ইজরায়েলের সঙ্গে যৌথ সামরিক–শিল্প, নজরদারি এবং জ্বালানি প্রকল্পের মাধ্যমে চলমান এই গণহত্যামূলক যুদ্ধ থেকে সরাসরি লাভবান হচ্ছে।
সবার আগে রয়েছে আদানি গ্রুপ, যা আদানি ডিফেন্স সিস্টেমস অ্যা ন্ড টেকনোলজিস লিমিটেডের মাধ্যমে এলবিট সিস্টেমস এবং ইজরায়েল ওয়েপন ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা করছে। এই কোম্পানি ইজরায়েলের হাইফা বন্দর ১.১৮ বিলিয়ন ডলারে অধিগ্রহণ করেছে এবং গ্রিসের ৩টি বন্দর অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করছে। একাজ করতে পারলে ইজরায়েল ও জর্ডনকে কৌশলগত অংশীদার বানিয়ে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর (IMEC)-এর দখলদারি আদানির হাতে চলে যাবে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জুনিয়র পার্টনার হিসাবে মোদী সরকার এই কারণেই স্বাধীন, সার্বভৌম এবং ঐক্যবদ্ধ প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়াতে কার্যত অস্বীকার করছে। এমনকি গাজায় আক্রমণ স্থগিত করার দাবিতে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকেও প্রাথমিকভাবে ভারত সরকার বিরত থেকেছিল।
ভারতের রিলায়েন্স ডিফেন্স, লারসেন অ্যা ন্ড টুব্রো এবং এনআইবিই লিমিটেড বিভিন্ন ইজরায়েলি কোম্পানি যেমন রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস এবং এলবিটের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে কাজ করে এবং ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাঙ্ক সুরক্ষা এবং রকেট লঞ্চার সিস্টেম তৈরি করে। এই সমস্ত অস্ত্র ‘গাজায় যুদ্ধ-পরীক্ষিত’ হিসাবে বাজারজাত করা হয়। বিইএল, একটি ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, যারা IAI-এর সঙ্গে বারাক ও LRSAM ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম তৈরির জন্য বহু বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং হ্যাল আরেকটি ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, যারা IAI-এর সঙ্গে রিফুয়েলিং ও ড্রোন প্রকল্পে সহযোগিতা করছে। টিসিএস ইজরায়েলি ডিজিটাল গভর্ন্যান্স প্রক্রিয়াতে সাপোর্ট দিয়ে ক্লাউড ও AI প্রকল্পে অংশগ্রহণ করেছে; ইনফোসিস, উইপ্রো, টেক মাহিন্দ্রা এবং রিলায়েন্স জিও ইজরায়েলি সাইবার সিকিউরিটি ও AI স্টার্টআপের সঙ্গে অংশীদারিত্ব স্থাপন করেছে, যারা সামরিক-গ্রেডের নজরদারি কাজের সঙ্গে যুক্ত। কৃষি-বাণিজ্যের বড় প্রতিষ্ঠান যেমন জৈন ইরিগেশন এবং ত্রিবেণি ইঞ্জিনিয়ারিং ইজরায়েল নিয়ন্ত্রণাধীন প্যালেস্তাইনের কৃষি জমিতে ব্যবসা করছে। আর্থিক ও ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান, যেমন স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, সান ফার্মা এবং ডঃ রেড্ডিজ ল্যাবোরেটরিজ— ইজরায়েলি ব্যাঙ্ক, বায়োটেক এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে। এদের লাভ সরাসরি দখলদারির অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত।
গাজার গণহত্যায় এই বিভিন্ন কর্পোরেশন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং একাডেমিক সংস্থার নেটওয়ার্কের সরাসরি যুক্ত থাকা প্রমাণ করে যে দখল, নজরদারি এবং ধ্বংস কোনও বিচ্ছিন্ন, অপরিকল্পিত ঘটনা নয়। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান একে অপরকে মদত করে প্যালেস্তাইনকে সামরিকীকৃত পুঁজিবাদের পরীক্ষাক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
ট্রাম্পের গাজা প্ল্যান এবং কর্পোরেট স্বার্থ
ডোনাল্ড ট্রাম্পের তথাকথিত ‘গাজা পরিকল্পনা’ শান্তির প্রস্তাবনার চেয়ে বেশি গাজার পুনর্নির্মাণে কর্পোরেট দখল স্থাপনের একটি নীল নকশা। ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ‘বোর্ড অব পিস’, যার সভাপতিত্ব করবেন ট্রাম্প স্বয়ং এবং যেখানে টনি ব্লেয়ারের মতো লোকও থাকবেন, তা একটি ‘ট্রাস্টশিপ’ হিসাবে কাজ করবে, যা গাজাকে বিদেশি ব্যবসা ও সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করবে এবং প্যালেস্তিনীয়দের নিজেদের জমি ফেরত ও পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণ থেকে সম্পুর্ণভাবে বঞ্চিত করবে।
বহুজাতীয় কর্পোরেশন, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার এবং আর্থিক বিনিয়োগকারীদের জন্য এ যেন এক খোলা চুক্তি, যা গাজার জমির বেসরকারিকরণ করে নিয়ন্ত্রণহীন পুনর্নির্মাণ থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। বড় বড় নির্মাণ, কনসাল্টেন্সি ও শক্তি কোম্পানি — যেমন বেচটেল, হলিবার্টন, ব্ল্যাকরক এবং চেভরন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইত্যাদিরা লজিস্টিক্স এবং ‘স্মার্ট সিটি’ প্রকল্প বানিয়ে দেদার টাকা কামাবে। কনসাল্টেন্সি জায়ান্ট যেমন বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ, ম্যাককিনজি এবং ডেলয়েট গাজার পর্যটন ভবিষ্যৎ গঠনের রোডম্যাপ বানাবে।
একই সঙ্গে, এলবিট সিস্টেমস, লকহিড মার্টিন এবং প্যালান্টির মতো সংস্থারা ‘ট্রাম্পের নিউ গাজা’-তে AI পুলিশিং এবং বায়োমেট্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করবে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা আসলে গাজাতে পুনরায় উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনা, পুনর্নির্মাণের আড়ালে, প্যালেস্তিনীয়দের হাত থেকে ক্ষমতা স্থানান্তর করে বহুজাতীয় কর্পোরেশন এবং ইজরায়েলের হাতে গাজাকে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা।
প্রতিরোধ যখন বিশ্বজোড়া – স্লোগান তখন ‘ব্লক এভরিথিং’
গাজায় চলমান মানবিক সঙ্কটের প্রতিক্রিয়ায়, বিশ্বের শ্রমিকরা প্যালেস্তাইনে গণহত্যা থেকে লাভবান হওয়া কর্পোরেশন ও সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শক্তি প্রদর্শন করেছে। বন্দর শ্রমিক, ধাতু শ্রমিক এবং অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়নগুলো একযোগে পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক কাঠামোয় আঘাত করেছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখিয়ে দিয়েছে।
বন্দরের শ্রমিকরা এই লড়াইতে নেতৃত্ব দিয়েছে। ইতালির জেনোয়া শহরের শ্রমিকরা ঐতিহাসিক ধর্মঘট শুরু করে, যা ইউরোপের সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দরের একটিকে কার্যত বন্ধ করে ইজরায়েলে অস্ত্র পরিবহণ আটকে দিয়েছিল। বহু ইউরোপীয় বন্দরের শ্রমিকরা এরপর গাজার পক্ষে একটি সমন্বিত সাধারণ ধর্মঘট করে, যা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতির এক শক্তিশালী প্রতিফলন। ‘ব্লক এভরিথিং’ স্লোগানটি ইউরোপ জুড়ে প্রায় আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, বাধ্য করেছে ইউরোপের বিভিন্ন সরকারকে প্যালেস্তাইনের পক্ষে দাঁড়াতে।
মাদ্রিদের ধাতু শ্রমিকরাও যোগ দিয়েছে এই আন্দোলনে। ফ্রান্সের সিজিটি’র ধাতু শ্রমিক ইউনিয়ন অক্টোবর ৬ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ঘোষণা করেছিল। ইতালিতে, ৩ অক্টোবর ২০২৫-এ USB এবং CGIL দ্বারা সংগঠিত জাতীয় সাধারণ ধর্মঘটে ১০০টিরও বেশি শহরে ২০ লক্ষেরও বেশি ধর্মঘটী অংশগ্রহণ করে। গ্রিসে, ১ অক্টোবর ২০২৫-এ শ্রম আইন বিরোধী ধর্মঘটে প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতি প্রদর্শন করা হয়, যেখানে হাজার হাজার মানুষের গলায় ‘ফ্রি প্যালেস্তাইন’ স্লোগান গর্জে ওঠে। এই সমস্ত লড়াই আসলে পুঁজিবাদ-বিরোধী সংগ্রামকে প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে, লেবার ফর প্যালেস্তাইন ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক বিডিএস-সম্মত নীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে (BDS—বয়কট, অর্থ প্রত্যাহার, ও নিষেধাজ্ঞা একটি বিশ্বজোড়া প্রচার প্রকল্প, যা ২০০৫ সালে প্যালেস্তিনীয় নাগরিক সমাজ দ্বারা শুরু করা হয়)। ৫ অক্টোবর অ্যামস্টারডামে ‘রেড লাইন’ প্রতিবাদে প্রায় ২,৫০,০০০ মানুষ অংশগ্রহণ করেছে, ইজরায়েলে ডাচ অস্ত্র রপ্তানি বন্ধের দাবি জানিয়ে।
প্যালেস্তিনীয় শ্রমিক ফেডারেশন জেরুজালেম জুড়ে একটি সাধারণ ধর্মঘট সংগঠিত করেছে, যেখানে ব্যাপক বেকারত্ব, বেতন চুরি এবং জীবিকার ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশের শ্রমিকরাও এই গণহত্যার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে। বিভিন্ন মহাদেশ জুড়ে শ্রমিকরা এখন বুঝতে পারছে যে প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতি আসলে তাদের ওপরে হওয়া শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত।
প্যালেস্তাইন - বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধের এক নতুন যুগ
এই বিরাট প্রতিরোধ কর্মসূচি কেবল সংহতির প্রতীক নয়। বিশ্বায়ন উদ্বৃত্ত উৎপাদন, দখল এবং বিতরণের প্রক্রিয়াগুলোকে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। প্যালেস্তাইনের পক্ষে বিশ্বজোড়া সংহতি ধর্মঘটগুলো ইজরায়েলের অস্ত্র সরবরাহ শৃঙ্খলকে আঘাত করেছে এবং শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংগ্রামকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। গণহত্যা থেকে লাভবান হওয়া কর্পোরেশনগুলোর বিরূদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির সমন্বিত কর্মকাণ্ড আধুনিক, কৌশলগত শ্রমিক প্রতিরোধের একটি নতুন রূপ হিসাবে আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে।
এই অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দেয়, গ্লোবাল সাউথের শ্রমিকদের (যার মধ্যে ভারতও রয়েছে) সংগ্রামকে গ্লোবাল নর্থের শ্রমিকদের সাথে যুক্ত করতে হবে। ভারতীয় শ্রমিকদের বিশ্বব্যাপী উৎপাদন শৃঙ্খলের কৌশলগত স্থানগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে, আন্তর্জাতিক সমমনষ্ক শ্রমিক সংগঠনগুলোর সাথে সমন্বয় করতে হবে। বিশ্বজোড়া সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে গণহত্যামূলক পুঁজির সমস্ত স্তরে আঘাত করতে হবে।
যুদ্ধ অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাদের সঙ্কট এড়ানোর বিশ্বস্ত হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে। কিন্তু প্যালেস্তাইনের জনগণের আত্মত্যাগ আজ হয়তো এই বর্বর কর্পোরেশনগুলোর আসল রূপ দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছে। এই গণহত্যা-বিরোধী আন্দোলন জনগণের বিস্তৃত অংশকে সমগ্র সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একত্রিত করতে পারে। প্যালেস্তাইনকে মুক্ত করার সংগ্রাম বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের প্রতিরোধের নতুন যুগের শুরু করতে পারে– তার জন্য প্রয়োজন এই গণহত্যা বিরোধী গণআন্দোলনকে গণহত্যার কারিগর বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শ্রেণি আন্দোলনে পরিণত করে সাম্রাজ্যবাদ ও কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালনা করা।
Comments :0