চন্দন দাস ও রণদীপ মিত্র
আপনার এলাকায় কাজ শুরু হয়েছে। ক’জনের কাজ হয়েছে?
‘আমি জানি না। আমাদের সঙ্গে কোনও কথা প্রশাসন বলছে না।’ সাফ জানালেন অনিল হাঁসদা।
অনিল হাঁসদা তৃণমূলের নেতা। অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ট। যে ১২একর জমিতে ব্যাসল্ট পাথরের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে পাঁচামীতে সেই এলাকা ভাড়কাটা পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে। মৌজা মথুরাপাহাড়ি। এলাকার নাম চাঁদা। সেখানকার পঞ্চায়েত সদস্য অনিল হাঁসদা। প্রভাবশালী নেতা। পঞ্চায়েতের প্রধান হাসনেহানা বিবি পর্যন্ত বলেছেন, ‘‘সব জানেন অনিলদা। ওনার কাছে যান।’’
সেই ‘অনিলদা’ বলছেন তিনি কিচ্ছু জানেন না। তাঁকে পাত্তাই দিচ্ছে না প্রশাসন।
অনিল হাঁসদার কথায়,‘‘প্রশাসন, সরকারের কী প্রতিশ্রুতি ছিল আমি জানি। কিন্তু প্রশাসন পঞ্চায়েতের সঙ্গে কোনও আলোচনা করছে না। আমার এলাকায় বড়জোর ৭-৮জন কাজ পেয়েছে লেবারের। কারা পেয়েছে জানতে পারছি না। মানুষ এসে ক্ষোভ জানাচ্ছেন। জবাব দিতে পারছি না।’’
আর ?
অনিল হাঁসদার অভিযোগ,‘‘স্থানীয়রা চাকরি পাচ্ছেন না। আমাদের এলাকায় একটা জায়গা আছে কেন্দ্রপাহাড়ি। আট-দশ বছর আগে সেখানে এসে পাথর ভাঙার কাজ করছিল ওডিশার কিছু মানুষ। তাঁদের জমির পাট্টা দিয়েছে। তাঁরা এবার খনির জন্য জমি দিয়ে চাকরি পেয়ে গেছে। স্যুট বুট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁরা চাকরি পেয়েছে, তা নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু স্থানীয় মানুষ, বিশেষত আদিবাসীরা চাকরি পায়নি। প্রশাসন নানাভাবে জমি জোগাড় করছে।’’ ‘নানা ভাবে’ মানে কী? অনিল হাঁসদা খোলসা করলেন না তা। কিন্তু ইঙ্গিত— কৌশলে জমি হাসিল করছে প্রশাসন।
কেন আদিবাসীরা জমি দিতে চাইছেন না?
অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ট অনিল হাঁসদার যুক্তি, ‘‘আদিবাসীরা এখানে অনেক বছর ধরে আছেন। জমি তাঁদের। কিন্তু তাঁদের পরিবার বেড়েছে। তাঁরা এবার সমস্যায় পড়েছেন। প্রশাসন বলছে জমি দিলে একজনের চাকরি হবে। কিন্তু পরিবারের কোনও একজনকে চাকরির জন্য বাছতে গেলেই পরিবারে গোলমাল লাগবে। কোথায় যাবো আমরা?’’
অন্য কারণটির ধারেকাছে তৃণমূল যেতে চাইছে না। আদিবাসীরা জল জঙ্গল জমি ছাড়তে চাইছেন না। তৃণমূল-শাসনে সম্পন্ন হয়ে ওঠা অনিল হাঁসদার মতো মানুষ আদিবাসী সমাজ, মনন থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁদের কাছে বিষয়টি পুরোপুরি পাওনাগন্ডার।
তৃণমূলের এই নেতার দাবি এর মধ্যেও মারাত্মক, ‘‘প্রশাসন জমি দখল করছে। নিচ্ছে না। কাউকে বলছে তোমার পুরো জমি নেব না। অল্প নেব। কোন জমি নেবে, বাকিটা কেন নেবে না, প্রকল্পের ম্যাপে কী আছে, কিছুই জানা যাচ্ছে না। নেতাদের কিছু বলার উপায় নেই। কাকে বলব ? কেউ জানতে চাইছে না আমাদের কথা। যা করছে প্রশাসন নিজের মতো করে করছে। আদিবাসীরা তাই জমি দিতে চাইছে না।’’
পাঁচামীতে খনির কাজ শুরু করেছে রাজ্য সরকার। তবে মাত্র ১২ একর জমিতে। মূলত পরিবেশ সংক্রান্ত আইনকে ফাঁকি দিতেই ১২ একর জমিতে কাজ শুরু। ৫০ একর জমি হলে তা পরিবেশ ছাড়পত্রর দাবি রাখে। এই ফাঁকটি ব্যবহার করে চাঁদায় খনন শুরু হয়েছে। কিন্তু তৃণমূলের মধ্যেই অনেকে ক্ষুব্ধ। আবার গ্রামবাসীরা আরও বেশি ক্ষুব্ধ। বিশেষত যে গরিব মানুষের সঙ্গে প্রশাসন কোনও কথা বলেনি, যাঁদের উপায় নেই সম্পন্ন গ্রামবাসীদের মতো বিডিও, ডিএম পর্যন্ত যাওয়ার, সেই বিরাট অংশের গ্রামবাসীরা ক্ষুব্ধ। দিশাহারা। অনিল হাঁসদার মতো অনেকেরই প্রশ্ন—‘কটা লোকাল কাজ পেয়েছে?’
খনির কাজ যেখানে হওয়ার কথা সেটি মহম্মদবাজার ব্লকের মধ্যে। পঞ্চায়েত সমিতির একজন সদস্য মাকু মাড্ডি। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘পঞ্চায়েত সমিতির কোনও বৈঠকে এই প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা হয়নি। কিছু জিজ্ঞেস করলে সভাপতি বলেন,‘ডিএম সাহেব’ জানেন। মানুষ জানতে চাইছে, কিছুই যখন জানো না তবে তোমরা আছো কী করতে?’’
পাঁচামীর খোঁড়াখুঁড়ির পাহারাদার ২২ বছরের পারভেজ আজিজ। বাড়ি পাঁচামীতে নয়। মল্লারপুরে। পারভেজের ‘রিলিভার’ শুভ পাল।
মথুরাপাহাড়ির চাঁদায় শুরু হয়েছে ব্যাসল্ট পাথরের সন্ধানে মাটি খোঁড়ার কাজ। মাত্র ১২ একর জমিতে সেই কাজ শুরু হয়েছে। যদিও রাজ্য সরকারের দাবি ছিল ৪৩১.৭৪ একর জমিতে হবে খাদান। পাথর তোলা হবে। তারপর তোলা হবে কয়লা। মমতা ব্যানার্জির দাবি, ‘আগামী একশো বছর কয়লার কোনও অভাব থাকবে না। কাজ হবে ১লক্ষ মানুষের।’
আপাতত চাঁদায় কাজ হয়েছে স্থানীয় পঁচিশ জনের, মোট জনা পঞ্চাশের।
সেই প্রকল্প এলাকাতেই দেখা পারভেজ আজিজের সঙ্গে। চাঁদায় নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করা যুবকের কথায়, ‘‘আমি ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিপ্লোমার ছাত্র। বারাসতে কিছুদিন একটি এটিএম কাউন্টারে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করেছি। তারপর এখানে লোক নেবে শুনে অ্যাপ্লাই করি।’’ পড়াশোনা, কাজ একসঙ্গে চলে কী করে ? পারভেজের জবাব, ‘‘এখানকার ডিউটি দিনরাত খেটে পুষিয়ে দিই। আমার এক রিলিভার আছে। শুভ পাল। ও আমি না থাকলে এখানে থাকে।’’
pachami
কী বলছে পাঁচামী-২ : ‘জমি দখল করছে প্রশাসন, কাজ পাচ্ছে না স্থানীয়রা’, মানছে ক্ষুব্ধ তৃণমূলীরাও

×
Comments :0