Ssc scam

নিয়োগ দুর্নীতিতে মুখ্যমন্ত্রীর নাম টেনে আনলেন পার্থ

কলকাতা

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে এবার সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে টেনে আনলেন একদা তাঁরই ঘনিষ্ঠ, প্রাক্তন মন্ত্রী, দলের প্রাক্তন মহাসচিব পার্থ চ্যাটার্জি।
এই প্রথম শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে আদালতের সওয়ালেও চলে এল মমতা ব্যানার্জির প্রসঙ্গ। নিজের জামিন চেয়ে সওয়ালে সোমবার পার্থ চ্যাটার্জি এজলাসে দাঁড়িয়ে বিচারকের উদ্দেশে বলন, নিয়োগ দুর্নীতিতে তাঁর কোনও ভূমিকা নেই, নিয়োগ সংক্রান্ত রিপোর্ট যেত মুখ্যমন্ত্রীর কাছেই। মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরের দিকেই সরাসরি এসএসসি’র নিয়োগ দুর্নীতির দায় ঠেলে দেন পার্থ চ্যাটার্জি।
এর আগে আদালতে প্রায় প্রতি সওয়ালেই অন্যান্য অভিযুক্তদের মত নিজেকে ‘নির্দোষ’ বলে দাবি করতেন পার্থ চ্যাটার্জি। এদিনও তাই করেছেন। তবে এদিন আরো একধাপ এগিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দিকেই আঙুল তুলেছেন। পার্থ চ্যাটার্জির বক্তব্যে স্পষ্ট, মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া নিয়োগ হয়নি। তাহলে কি মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশেই হয়েছে বেআইনি নিয়োগ? মমতা ব্যানার্জির মন্ত্রীসভার প্রাক্তন সদস্যের কথায় মিলছে সেই ইঙ্গিতই। 
এদিন আলিপুরে সিবিআই-এর বিশেষ আদালতে যে কোনও শর্তে নিজের জামিনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই পার্থ চ্যাটার্জি বলেন, নিয়োগে মন্ত্রী হিসেবে আমার কোনও ভূমিকা নেই। মন্ত্রী নিয়োগকর্তা নয়। এরপরেই বিচারকের উদ্দেশে বলেন, গোটা বিষয়টা আপনার কাছে ব্যাখ্যা করতে চাইছি। শিক্ষা দপ্তরের কার্যক্রম দুটি ভাগে হয়। একটা অংশ হলো নীতি নির্ধারণ করা মানে পলিসি তৈরি করে, আরেকটা  হলো এক্সিটিউভ ফাংশন, নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখা। পার্থ চ্যাটার্জি সওয়ালে বলেন, মন্ত্রী তাঁর দপ্তরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলেন। প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রিপোর্ট করেন মুখ্যসচিবের কাছে, যা আসলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করারই শামিল। মুখ্যসচিব মুখ্যমন্ত্রীকে জানান। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি রিপোর্ট করেন মুখ্যমন্ত্রীকে। এসএসসি আলাদা একটি বোর্ড, মন্ত্রী এসএসসি-কে নিয়ন্ত্রণ করত না। নিয়োগের রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে যেতো। কার্যত আদালতে তাঁর সওয়ালেই পার্থ চ্যাটার্জি দাবি করেন, মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশেই নিয়োগ। 
স্বাভাবিকভাবেই পার্থ চ্যাটার্জির এমন সওয়ালে তাঁর আইনজীবীরাও এদিন হতবাক হয়ে পড়েন। শাসক তৃণমূল রীতিমত অস্বস্তিতেই। 
পার্থ চ্যাটার্জি গোটা নিয়োগ দুর্নীতিতে নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন এটা যেমন স্পষ্ট, তেমনই নিয়োগের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর ও মুখ্যমন্ত্রী নিজেও যে অবহিত ছিলেন তাও স্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে এই সরকারের কোনও মন্ত্রীর কোনও ভূমিকা নেই তা গত এক দশকে বারেবারে স্পষ্ট হয়েছে। কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়রের যে মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া কলকাতার রাস্তায় পার্কিং ফি দশ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর ক্ষমতা নেই তাও সাম্প্রতিক ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে। সেখানে গত এক দশকে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের গোটা বিষয়, এই ভয়াবহ দুর্নীতির চক্র চলল সম্পূর্ণ ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর অগোচরে- তা যুক্তির নিরিখে দাবি করাও কষ্টসাধ্য। যদিও আদালতের সওয়ালে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা এর আগে সামনে আসেনি। কেউটের ঝাঁপি কি তবে পরিকল্পিতভাবেই খুলে দিলেন নিয়োগ দুর্নীতির অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ পার্থ চ্যাটার্জি?
শুধু মুখ্যমন্ত্রী নয়, দলের একটা প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধেও ‘ষড়যন্ত্র’র অভিযোগ তোলেন  পার্থ চ্যাটার্জি। তিনি বলেন, আমার অনেক শত্রু আছে। তাঁরা অনেক প্রভাবশালী। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। ইঙ্গিত কি দলেরই দ্বিতীয় ক্ষমতাবান প্রভাবশালী সাংসদের দিকে? উঠছে প্রশ্ন। পার্থ চ্যাটার্জি বলেন, অন্য কারো দায়ে কেন আমি শাস্তি পাব? আমি দায়ী নই। মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়োগের রিপোর্ট যেত। 
তবে সিবিআই ও ইডি দুই তদন্তকারী সংস্থারই দাবি পার্থ চ্যাটার্জি শিক্ষা দপ্তরের গোটা এই দুর্নীতিতে সরাসরি যুক্ত শুধু নন অন্যতম মাথাও বটে। 
আসলে স্বাধীনতার পরবর্তীতে এরাজ্যে বুকে সবথেকে বড় নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিটি পরতে রয়েছে শাসক দলের ভূমিকা। কার্যত প্রশাসনের একটা বড় অংশকে যুক্ত করা হয়েছে এই বেনজির দুর্নীতির প্রতিটি ধাপে। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের অনশন মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সেদিন আন্দোলনকারীদের সামনেই মমতা ব্যানার্জি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আধিকারিক পর্যায়ে পাঁচজনকে নিয়ে যেমন নিয়োগ নজরদারি কমিটি (বিচারপতি বাগ কমিটি আদালতে জমা দেওয়া রিপোর্টে ঐ কমিটিকেই অবৈধ বলে জানিয়েছিলেন) গঠন করা হয়েছে তেমনি ওখানে থাকা চাকরিপ্রার্থীদের থেকেও পাঁচজনকে নিয়ে কমিটি করতে হবে।
কিন্তু ২০১৯-এর শেষ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হল এই স্কুলে নিয়োগকে সামনে রেখে। এই নিয়োগ সিন্ডিকেটের মাথা রাজ্যের মন্ত্রীসভা। কলকাতা হাইকোর্টের তৈরি করা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগের নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি খুঁজে বের করেছে এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা কীভাবে মেয়াদ উত্তীর্ণ প্যানেল থেকে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করেছে। অনুসন্ধান কমিটি খুব স্পষ্ট করে তাদের দেওয়া দুটি রিপোর্টে হাইকোর্টকে জানিয়েছিল, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে যে নিয়োগ সংক্রান্ত নজরদারি কমিটি তৈরি করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অবৈধ। গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি পদে যাঁদের চাকরি দেওয়া হয়েছে সেটাও বেআইনি কাজ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ হয়েছে।
অন্যদিকে, নিজের জামিনের জন্য সওয়ালে অসুস্থতার কথা বলে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গও তোলেন পার্থ চ্যাটার্জি। নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর সওয়াল ‘আমার বস’ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু উডল্যান্ডসে ভর্তি, উনি অসুস্থ, আমিও অসুস্থ। আমাকে জামিন দিন যে কোনও শর্তে।
 

Comments :0

Login to leave a comment