রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে, বিভাগে প্রচুর টাকা পড়ে আছে দীর্ঘদিন। যে অ্যাকাউন্টে সরকারের কোষাগারের টাকা রাখা উচিত নয়, টাকা পড়ে আছে সেই পিএল অ্যাকাউন্টেও। এই আর্থিক বিশৃঙ্খলা পরোক্ষে স্বীকার করে নিয়ে কাজ না করে ফেলে রাখা সব টাকা ফেরত চাইল অর্থ দপ্তর।
রাজ্য সরকার একটি মেমোরেন্ডামে বিভিন্ন দপ্তরের সচিব, বিভাগীয় প্রধান, জেলা পরিষদের আধিকারিক, জেলা শাসক, এসডিও, বিডিও-দের নির্দেশ দিয়েছে যে, অন্তত ৫ বছর যে টাকা পড়ে আছে সেই টাকা এখনই ফেরত দিতে হবে। তার আগেরও টাকা পড়ে থাকলে তাও ফেরাতে হবে। ফেরত দিতে হবে আগামী ৩১ মে’র মধ্যে। খরচ না করে এইভাবে ফেলে রাখা টাকার পরিমাণ কত? তার নির্দিষ্ট অঙ্ক বলতে পারেননি রাজ্যের অর্থ দপ্তরের আধিকারিকরা। তবে আশঙ্কা অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকা পড়ে আছে।
এই টাকা হঠাৎ এখন ফেরত চাওয়া হলো কেন? এর আগে সরকারি নির্দেশ জারি করে তিন বার পড়ে থাকা টাকা ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল মমতা ব্যানার্জির সরকার। ২০১৭-র সেপ্টেম্বরে, ২০১৮-র জানুয়ারিতে এবং ২০১৯-র মে’তে। কোনওবারই বিশেষ কার্যকরী হয়নি সেই নির্দেশ। এবার আবার ফেরত চাওয়া হয়েছে ফেলে রাখা টাকা। এবার ফেরত চাওয়া হয়েছে ২০২০-র ১এপ্রিল থেকে কাজ না করে ফেলে রাখা টাকা। অর্থাৎ গত পাঁচ বছর কীভাবে, কত টাকা কোন কোন কাজে খরচ করেছে দপ্তর, বিভাগ, জেলা পরিষদ সহ অন্যান্য সংস্থা, তার কোনও পর্যালোচনাই করেনি নবান্ন। সামনে বাজেট নেই। নির্বাচনও বছর খানেক দেরি আছে। তাহলে এখন হঠাৎ জেগে বসল কেন সরকার? এর জবাবে রাজ্যের অর্থ দপ্তরের এক আধিকারিক বলেছেন,‘‘এর সঙ্গে ডিএ-র জন্য প্রয়োজনীয় টাকার সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া এখনই ঠিক হবে না। তবে অনেক টাকাই পড়ে আছে বলে আমাদের ধারণা। ১০-১২ হাজার কোটির বেশিই হবে।’’
কতগুলি ক্ষেত্রকে এই নির্দেশের বাইরে রাখা হয়েছে। যেমন কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন, চতুর্থ এবং পঞ্চম রাজ্য অর্থ কমিশন, সাংসদ, বিধায়ক তহবিলের টাকা, গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন তহবিল প্রভৃতি। এই ক্ষেত্রগুলির পড়ে থাকা টাকার হিসাব দিতে হবে না আপাতত। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এই ক্ষেত্রে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য অর্থ কমিশনের দেদার টাকা পড়ে আছে, যা খরচ হয়নি।
রাজ্য সরকার বারবার টাকার অভাবের দাবি করে। বাজার থেকে ধার করায় ওস্তাদ মমতা ব্যানার্জির সরকার। রাজ্যের ঋণের পরিমাণ ২০২৬-এর মার্চে মোট ধারের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭,৭১,৬৭০ কোটি ৪১ লক্ষ টাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে বাজেট পেশ করার সময় রাজ্য সরকার জানিয়েছে, ধার শোধ করতেই সরকারের খরচ হবে ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি। একদিকে রাজ্যের মানুষকে এই বিরাট ধারের মুখে ফেলেছে তৃণমূল, অন্যদিকে তারা সরকার চালিয়েছে বেপরোয়াভাবে। যথেচ্ছ, অপরিকল্পিত টাকা খরচ করা হয়েছে গত ১৪ বছরে সরকারি কোষাগার থেকে। তারই প্রমাণ হাজির করেছে রাজ্যের অর্থ দপ্তর তার গত ৬ মে প্রকাশিত মেমোরেন্ডামে (নং-১৬২৯-এফ-ওয়াই)। সেখানে স্পষ্ট যে, বিভিন্ন দপ্তর, বিভাগ, জেলা পরিষদ সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় দেওয়া টাকায় আদৌ কাজ হয়েছে কিনা, কত টাকা খরচ হয়েছে, তার কোনও পর্যালোচনাই রাজ্য সরকার করেনি। এতে সরকারি টাকা নয়ছয়ের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
নয়ছয়ের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে কীভাবে?
সরকারের ওই মেমোরেন্ডাম বলছে যে, বছরের পর বছর টাকা পড়ে আছে সরকারি দপ্তর, সংস্থাগুলির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে, ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট, এলএফ অ্যাকাউন্টে। অর্থ দপ্তর স্বীকার করেছে যে, পিএল অ্যাকাউন্টেও পড়ে আছে। সরকারের টাকা এইভাবে পার্সোনাল লেজার অ্যাকাউন্ট (পিএল অ্যাকাউন্টে) ফেলে রাখা যায় না। এই টাকা অনেক সময় একজন অফিসারের নামেও থাকতে পারে। টাকার অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে এই ক্ষেত্রে। বিভিন্ন দপ্তর, নিগম, সংস্থার পিএল অ্যাকাউন্টে টাকা রেখেছে। পুরোটাই বেআইনি। অনেক ক্ষেত্রে জানা যাচ্ছে সরকারি টাকা সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে ব্যাঙ্কে। এই ক্ষেত্রেও অনেক অফিসারের ব্যক্তিগত সেভিংস অ্যাকাউন্টেও এই টাকা থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এটিও বিপজ্জনক। দ্বিতীয়ত, যে কাজ হয়নি, সেই কাজ হয়েছে কিংবা চলছে বলে দেখানো হয়েছে। এটি কী করে সম্ভব?
মমতা-শাসনে এই আর্থিক বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা আগেও প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৭-র ৩১ মে-তে রাজ্যের অর্থ দপ্তর প্রথম এই সংক্রান্ত আশঙ্কা স্বীকার করে দপ্তর, সংস্থা, নিগমগুলিকে চিঠি দেয়। সেবারও খরচ না করা টাকা ফেরত চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিশেষ কোনও কাজ হয়নি। তারপর ওই বছরেরই সেপ্টেম্বরে দুটি নির্দেশ জারি হয়। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর। আবার নির্দেশ নির্দেশ জারি হয় সে বছরের ডিসেম্বরে। ২০১৮-র ১৬ জানুয়ারি রাজ্যের সবকটি দপ্তরকে ২০১৮-১৯-এ বরাদ্দ উন্নয়ন খাতের কত টাকা পড়ে আছে, তা জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশও নির্দিষ্ট সময়ে সব দপ্তর, বিভাগগুলি পালন করেনি বলে অভিযোগ ওঠে।
এই টাকা ফেলে রাখার অভিযোগ রয়েছে জেলা পরিষদ, পৌরসভাগুলির বিরুদ্ধেও। রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলা পরিষদ এবং সিংহভাগ পৌরসভা তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জোর করে অথবা ভোটে ভয় দেখিয়ে, দেদার ছাপ্পা ভোট দিয়ে জেলা পরিষদ, পৌরসভা দখল করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। কোনও ধান্দা ছাড়া উন্নয়ন খাতের টাকা এইভাবে ফেলে রেখেছেন তৃণমূলের নেতারা অর্থ দপ্তরের আধিকারিকরা তাও মনে করেন না।
West Bengal Government
উন্নয়নে বরাদ্দ দেদার টাকা খরচ হয়নি, পড়ে আছে!

×
Comments :0