শ্যামল কুমার মিত্র
প্রতি বছর এপ্রিল/মে মাসে দিল্লিতে সমগ্র শিক্ষা মিশনে রাজ্যগুলিকে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে একটি করে বৈঠক হয়। বৈঠকের পোশাকি নাম প্রজেক্ট অ্যাপ্রুভ্যাল বোর্ড মিটিং (কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক, প্যাব)। এই বছরে এই প্যাব মিটিং-এ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে হাজির ছিলেন রাজ্য সমগ্র শিক্ষা মিশনের ডিরেক্টর শুভ্র চক্রবর্তী, এসসিআরটি’র ডিরেক্টর ছন্দা রায় এবং স্কুল শিক্ষা দপ্তরের সচিব বিনোদ কুমার। এই বৈঠকে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের সম্মতিতে যে তথ্যগুলি উঠে এসেছে তা হলো - (১)পশ্চিমবঙ্গের ৬৬,৭৪৪টি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে ৫,১৪৯টিতে ১ জন করে শিক্ষক। (২) ৬,৪২৬টি আপার প্রাইমারি স্কুলের ৮৯১টিতে ১ জন করে শিক্ষক। (৩) প্রাথমিকে ১১,৫১৫টি স্কুলে পড়ুয়া ৩০ এর কম। (৪) ৩,৬৬৯টি প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়া ১৫ জনের কম। (৫) ৭৪৭টি প্রাথমিক স্কুলে ১ জনও পড়ুয়া নেই। (৬) আপার প্রাইমারিতে ১,৪৭৫টি স্কুলে পড়ুয়া ৩০ জনের কম। (৭ ) ৭২০টি স্কুলে ১৫ জনের কম পড়ুয়া। (৮) ২৫৯টি স্কুলে ১ জনও পড়ুয়া নেই। (৯) স্কুলছুটের হার ৮.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭.৮ শতাংশ। (১০) সমগ্র শিক্ষা মিশনে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের সিংহভাগ দেওয়ার পরেও এ রাজ্যে মাত্র ৬৪ শতাংশ স্কুলে খেলার মাঠ তৈরি হয়েছে, ইন্টারনেট সংযোগ হয়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ স্কুলে, স্মার্ট ক্লাসরুমের ব্যবস্থা হয়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ স্কুলে, বাউন্ডারি ওয়াল তৈরি হয়েছে মাত্র ৪৬ শতাংশ স্কুলে, সোলার প্যানেল বসেছে মাত্র ৪.৬ শতাংশ স্কুলে, বেশিরভাগ স্কুলে শৌচাগার এতটাই অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন যে সেগুলি ব্যবহারের অযোগ্য।
রাজ্যের বিধানসভার শিক্ষা সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি (নেতৃত্বে শ্যামপুরের তৃণমূল বিধায়ক কালিপদ মণ্ডল) বিধানসভায় ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়কালের জন্য যে রিপোর্ট পেশ করেছেন তা এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক। (১) গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়গুলিতে যথেষ্ট শিক্ষক/শিক্ষিকার অভাব রয়েছে। বিশেষত নিউ সেট আপ বিদ্যালয়গুলিতে শূন্যপদ পূরণে বিভাগকে সচেষ্ট হতে হবে। (২) জেলায় অনেক প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে স্থায়ী প্রধানশিক্ষক নেই, ফলে স্কুলের প্রশাসনিক কাজ ও পঠন-পাঠনের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। (৩) রাজ্যের অনেক স্কুলে ছাত্রীদের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। উক্ত ক্রমহ্রাসমানতা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিটি বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। (৪) ২০১০-১১ অর্থবর্ষে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে (শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষকদের ধরে) শিক্ষক ছিলেন ৪,১৪,৪৭৪ জন। এখন এই ক্ষেত্রে শিক্ষক আছেন ২,৭২,৪৪৩ জন। এসএসকে, এমএসকে-গুলির ৭৫,০০০ শিক্ষক ধরলে শিক্ষক সংখ্যা ৩,৭২,৪৪৩। ২০১০-১১ অর্থবর্ষের তুলনায় শূন্যপদ ৬৯,০০০৷ এই রিপোর্ট কোনও বিরোধী বিধায়কের নয়, শাসকদলের বিধায়কের নেতৃত্বাধীন স্ট্যান্ডিং কমিটির।
২০২২ সালে ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মণের প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু যে তথ্য বিধানসভায় দিয়েছিলেন তাতে রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে শূন্যপদের সংখ্যা নিম্নরূপ। মাদ্রাসা শিক্ষক ১০০০০, প্রাথমিক শিক্ষক ১৯০০৮৫, মাধ্যমিক শিক্ষক ১৩৯২৯৫, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক ২৩৭১১, প্রধান শিক্ষক ৫৮২৪ এবং শিক্ষাকর্মীদের শূন্যপদ যথাক্রমে ২৯২৩৫। অর্থাৎ বিদ্যালয় শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বমোট শূন্যপদের সংখ্যা ৩,৯৮,১৫০৷
উচ্চমাধ্যমিক পরবর্তী স্তরে অনুমোদিত পদের কমবেশি ৬০ শতাংশ পদ শূন্য। এই বিপুল সংখ্যায় শূন্যপদ গোটা সরকারি শিক্ষা পরিকাঠামোয় পঠন-পাঠন কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে। ২০০৮ সালে এই রাজ্যে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ছিল ১:৩৫, শিক্ষার অধিকার আইন অনুসারে প্রয়োজন ১:৩০, বর্তমানে তা ১:৭৩৷ 'সেন্টার অব এক্সেলেন্স' হিসাবে পূর্বতন সরকারগুলি ৩৯টি সম্পূর্ণ সরকারি (সরকার পোষিত নয়) বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন। এই ৩৯টি স্কুলে শিক্ষকদের অনুমোদিত পদ ১৮০০, কর্মরত শিক্ষক ৯০০ এবং শূন্যপদ ৯০০৷ মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
গত ১৪ বছরে অতীতের মতো প্রতিবছর নতুন নিয়োগের কোনও ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। ২০১৬ সালে মাত্র ১ বার এসএসসি’র মাধ্যমে ২৫,৭৫৩ জন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ হয়েছিল। সেই ২৫,৭৫৩ জনের চাকরিও আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়ে গেছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারনে। ২০১২ এবং ২০১৪ সালে টেটের মাধ্যমে যথাক্রমে ১৮,৭৯৩ এবং ৪২,০০০ প্রাথমিক শিক্ষক অর্থাৎ সর্বমোট ৬০,৭৯৩ জনকে নিয়োগ করা হয়। ২০১২ সালে টেটে তবু নাম-কা-ওয়াস্তে হলেও, একটা মেধা তালিকা প্রকাশ হয়েছিল। ২০১৪ সালের টেটে তাও হয়নি। তথাকথিত সফল প্রার্থীদের এসএমএস’র মাধ্যমে খবর পাঠানো হয়।
এই গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তর অভিযোগ আছে৷ গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতিমূলক। সরকারি আইজীবীরা কলকাতা হাইকোর্টে শুনানির সময় স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে টেটের প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে ২৫,৭৫৩ জনের প্যানেল বাতিল হয়েছে, একই কারণে এই ৬০,৭৯৩ জন প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি প্রশ্নের মুখে। ইতিমধ্যে ৩২,০০০ প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ উচ্চতর বেঞ্চে বিচারাধীন। এই গোটা প্যানেলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এর পরে আরও ২টি টেট হলেও কোনও নিয়োগ হয়নি। সরকার নিয়োগ করতেই চাইছে না। ফলে বিপুল শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
এই শিক্ষক ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার প্রাথমিকে ২১,২৪৬ জন যাদের বেতন মাসে ১২,৩৪০ টাকা এবং উচ্চপ্রাথমিকে ২৪,৪১৮ জন যাদের বেতন মাসে ১৬,০৫৩ টাকা, পার্শ্ব শিক্ষক ৩,০০০ জন যাদের বেতন মাসে ৮,০০০ টাকা নিয়োগ করেছে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ঘাটতির মোকাবিলায় এই নগন্য সংখ্যায় চুক্তিতে নিয়োগ সিন্ধুতে বিন্দুসম। একই স্কুলে একই কাজ করে এরা স্থায়ী কর্মীর থেকে অনেক কম বেতন পাচ্ছেন, কার্যত কোনও সামাজিক সুরক্ষা পাচ্ছেন না। এই বৈষম্য নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা চলতে পারে?
অন্যদিকে বাস্তবে কোনও নিয়োগ প্রক্রিয়া ছাড়াই শাসক দলের সুপারিশে এই সব নিয়োগ হচ্ছে। ফলে শাসক দল শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। যে সংখ্যায় শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী কর্মরত আছেন, তাদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন স্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। ফলে জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা পঠন-পাঠনের মতো 'তুচ্ছ' বিষয়ে সময় দিতে পারেন না৷ ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পড়ুয়ারা।
উচ্চশিক্ষায় অবস্থা আরও ভয়াবহ। কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন ওয়েবকুটার সদ্য প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক কেশব ভট্টাচার্য সঠিকভাবেই বলেছেন, "৯০ শতাংশ কলেজেই কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি হয়েছেন এমন মানুষরা, যাদের শিক্ষা জগতের সঙ্গে অতিদূর কোনও সম্পর্কই নেই।" কলেজগুলির গভর্নিংবডিতে শাসকদল ও তার ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে কলেজ প্রশাসনকে রাজনীতির আখড়া বানিয়ে ছাত্রস্বার্থের বিরোধী পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ২০১৭ সাল থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ। কোনও গণতান্ত্রিক মুক্ত পরিবেশ নেই। টিএমসিপি’র নামে প্রায় সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মনোজিৎ মিশ্র' মডেল চালু হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা, বিশেষত: ছাত্রীরা এক চূড়ান্ত আতঙ্কের পরিবেশে রয়েছে। খোলা মনে পড়াশুনার কাজটাই করতে পারছে না। পুলিশ-প্রশাসন মনোজিৎ মিশ্রদের সুরক্ষা দিতে দায়বদ্ধ, ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও সম্ভ্রম রক্ষা ঈশ্বর-আল্লার হাতে।
অভিভাবকরা সরকারি বা সরকারপোষিত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তি করেন এই ভরসায় যে সরকারের ব্যবস্থাপনায় তারা শিক্ষার সঙ্গে সুরক্ষাও পাবে। কিন্তু সরকারি মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত মহিলা চিকিৎসক হাসপাতালের ভিতরে ধর্ষিতা হয়ে খুন হন। একটা সিভিক ভলান্টিয়ারকে 'বলির পাঁঠা' করে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারি তদন্তকারী সংস্থা প্রভাবশালী মূল অপরাধীদের সুরক্ষা দেওয়ায় মুনশিয়ানা দেখায়। কসবার ঘটনায় প্রমাণিত যে তৃণমূল পরিবারের টিএমসিপি করা ছাত্রীও টিএমসিপি নেতাদের হাতে দলবদ্ধধর্ষণ ও নারকীয় অত্যাচারের শিকার হন। কত অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী টিএমসিপি ও সরকার পোষিত দুষ্কৃতীদের অত্যাচারে মানসিক অবসাদে ভুগছেন, কত অসংখ্য ছাত্রী এদের যৌনদাসীর ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়েছেন তার হিসাব কে রাখে? বেশিরভাগই সামাজিক অসম্মানের আতঙ্কে এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আনেন না। ভুক্তভোগীরা এটাও জেনে গেছেন, পুলিশ বা কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়ে কোনও লাভ নেই, কারণ তারাও দুষ্কৃতীদের পক্ষে।
১৬৫ বছরের পুরানো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৫০টি কলেজ, ৭টি ক্যাম্পাস৷ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৮টি বিভাগের মধ্যে ৫৩টি বিভাগের তথ্য আমার সংগ্রহে আছে। এই ৫৩টি বিভাগে অধ্যাপকদের অনুমোদিত পদ ৭৯৩, কর্মরত অধ্যাপক ৩৯৮ এবং শূন্যপদ ৩৯৫। অর্থাৎ অনুমোদিত পদের ৪৯.৮১ শতাংশই অধ্যাপকহীন। পড়াশোনা কিভাবে হবে? এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম নয়। সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এই একই অবস্থা। এর উপরে আছে বছরে ৬/৭ মাসের ছুটি। এই বছর এখনও সরকারি বা সরকার পোষিত কলেজগুলিতে ভর্তির প্রক্রিয়াই শুরু হয়নি ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে আদালতের জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে। উদ্বিগ্ন অধৈর্য হয়ে যাতে শিক্ষাবর্ষ নষ্ট না হয়, তার জন্য অভিভাবকরা ঘটিবাটি বেচেও নিজেদের সন্তাদের লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বেসরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকার, আক্ষরিক অর্থে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যাতে পড়ুয়ারা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেছে নিতে বাধ্য হয়। বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ তৃণমূল নেতা-মন্ত্রী অথবা তাদের সঙ্গে তৃণমূলের লেনদেনের সম্পর্ক। সব মিলিয়ে গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তদের সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সরকার ঠিক সেটাই চায়।
‘যত কম জানে, তত বেশি মানে।’ যুবসমাজকে অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে পারলে, কেউ প্রশ্ন করবে না, "রাজা তোর কাপড় কোথায়?"
Post editorial
সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে তুলে দেওয়া হচ্ছে

×
Comments :0