PM Pracharak

আরএসএস'র প্রচারক নয়, প্রধানমন্ত্রী চাই

উত্তর সম্পাদকীয়​

বৃন্দা কারাত
দেশের স্বাধীনতা উদ্‌যাপনের সময় যাদের প্রতি স্বাধীন ভারত চিরকাল ঋণী সেই সকল শহীদদের স্মরণ, অগণিত পুরুষ ও মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার বিরাট সুযোগ হয় স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায়।
স্বাধীন ভারতের অর্জিত সাফল্যসমূহ সম্পর্কে গর্ব করার এবং আমাদের সামনে যে সকল চ্যালেঞ্জগুলি আজও রয়েছে সেগুলি চিহ্নিত করার জন্যও এই বক্তৃতা এক সুযোগ। ঐ বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে আত্মপ্রচার করা, দলীয় রাজনীতি প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে বক্তব্য পেশ ও দেশের জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তিগুলির পক্ষে প্রচার করা উচিত নয়। দেশের স্বাধীনতার ৭৯তম বছরের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের 'প্রচারক'-এর ভূমিকা পালন করেছেন। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তকে কলঙ্কিত করেছেন এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে দেশের শহীদদের অপমান করেছেন।

দেশের উন্নয়ন সম্পর্কিত ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত দাবিগুলিকে যে কেউ চাইলেই চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। গ্রামীণ  দরিদ্র মানুষ ক্রমশ জমির অধিকার হারাচ্ছেন, কাজের মজুরি বাড়ছে না, এমএনরেগা বা 'বন অধিকার আইন'-এর মতো আইনানুগ অধিকারগুলি সঙ্কুচিত করা হচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও উল্লেখ রয়েছে, তফসিলি জাতি-উপজাতি (এসসি/এসটি) তালিকাভুক্ত মানুষের জন্য সংরক্ষিত পদগুলিতে কোনও পদোন্নতি হচ্ছে না, বিপুল সংখ্যক শূন্যপদ রয়ে গেছে। 
তবে এ সকল বিতর্ক ও বিরুদ্ধ যুক্তিগুলির কোনটিই নতুন কিছু নয়, সবটাই জনমানসে জীবন্ত রয়েছে। একজন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার নিজের দাবি যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন সে সবকে বারংবার তুলে ধরা খুব একটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে ঐ সমস্ত দাবি নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটাই স্বাভাবিক। 
এবারের বক্তৃতার মধ্যে যা বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের অনুপস্থিতি। গত বছর প্রধানমন্ত্রী ‘দুর্নীতির উইপোকা’ নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন অথচ এ বছর গোটা বক্তব্যে ‘দুর্নীতি’ শব্দটির প্রায় উল্লেখই করা হলো না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধ কি শেষ হয়ে গেছে? মাত্র কয়েকদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নিউইয়র্কের ইস্টার্ন জেলা আদালতকে জানিয়েছে, তারা ২০০০ কোটি টাকার ঘুষের মামলায় আদানি কর্মকর্তাদের কাছে সমন ও অভিযোগপত্র পৌঁছে দিতে ভারতের আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের কাছে সাহায্য চেয়েছিল। ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছ-মাস পরেও জরুরি নথিসমূহ দেয়নি। এই প্রসঙ্গে সংসদের আলোচনায় উত্থাপিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাবে সরকার বলেছে, গত দশ বছরে ব্ল্যাক মানি অ্যাক্ট (২০১৫)-র অধীনে কর ও জরিমানা বাবদ ৩৫,০০০ কোটি টাকার মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৩৩৮ কোটি টাকা পুনরুদ্ধার হয়েছে। এটা ঠিক সেই সময়েই ঘটছে যখন সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের অর্থ সঞ্চিত রাখার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তৃতায় জরুরি অবস্থার অবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। যারা জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন তাদের ‘পাপী’ বলে আখ্যাও দিয়েছেন। এধরনের শব্দচয়ন অবশ্যই তার নিজের পছন্দের মধ্যে পড়ে। তিনি এমন সময় গণতন্ত্র রক্ষার দাবি করছেন যখন সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি অর্থাৎ সার্বজনীন ভোটাধিকারই হুমকির মুখে পড়েছে, এমন সমাপতন সত্যিই হাস্যকর। সারা দেশ আশা করেছিল প্রধানমন্ত্রী দেশের সকল মানুষেরই ভোটাধিকার রক্ষার প্রতি নিজের দায়বদ্ধতাটুকু অন্তত স্বীকার করবেন। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার রক্ষা করার প্রশ্নে গত ১৪ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিহারে এসআইআর’ পরিচালনা সম্পর্কে বিরোধী দলগুলির উত্থাপিত অনেক বিষয়কেই সর্বোচ্চ আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশে সমর্থন জানানো হয়েছে। 
দেশের সংবিধানিক 
প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বায়ত্তশাসন এখন গুরুতর হুমকির মুখোমুখি। এটা খুবই উদ্বেগের যে এই জরুরি বিষয়গুলিই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে অনুপস্থিত রইল। ‘দুর্নীতি’ এবং ‘ভোটাধিকার’-এর মতো বিষয়গুলির  অনুপস্থিতিই বুঝিয়ে দেয় মোদী সরকারের কাছে এই সকল বিষয় কতটা গুরুত্বহীন।
তবে এবারের ভাষণের দুটি নির্দিষ্ট দিক রয়েছে যা সকল ভারতবাসীর কাছেই গভীর উদ্বেগের বিষয় হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
প্রথমটি ‘ঘুষপেটিয়া’ অর্থাৎ বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভারতের জনসংখ্যার পরিবর্তন ঘটানোর ‘ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে তিনি চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তুলেছেন। এর আগে ঝাড়খণ্ড রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের সময় তার প্রচারের প্রধান বিষবস্তু ছিল ‘মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা’ আদিবাসীদের জমি দখল করছে, আদিবাসী নারীদের শোষণ করছে। ভিত্তিহীন, প্রমাণহীন এমন অভিযোগটিকে তিনি এবারের স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় আবারও তুলে ধরলেন। ঐ নির্বাচনের ফলাফলে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর দল শোচনীয়ভাবেই পরাজিত হয়ছিল, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে এর থেকে তিনি কোনও শিক্ষাই নেননি। 
যদি এমন কোনও ষড়যন্ত্র থেকেও থাকে তবে এত বছর ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভূমিকা কী ছিল? 
কীভাবে দেশের মধ্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো?  
এমন ‘ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে সংসদের কোনও আলোচনায় কখনও কোনও বক্তব্য উঠে আসেনি কেন?
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এখন ‘বিদেশি’ চিহ্নিত করার নামে বাংলাভাষী দরিদ্র শ্রমিকদের উপর বিশেষত বিভিন্ন রাজ্যে কর্মরত মুসলমান শ্রমিকদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের মোকাবিলার জন্য নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও নীতিমালা রয়েছে, তা সত্ত্বেও ভারতে সেই ব্যবস্থাকে কার্যকর করার প্রশ্নে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পক্ষপাতদুষ্ট ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকে পরিচালনা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি সংসদের আলোচনায় এক প্রশ্নের জবাবে সরকারের তরফে বলা হয়েছে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে তফসিলি উপজাতি তালিকাভুক্ত মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতনের ৬৭৭৯টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। অথচ কোথাও এমন অপরাধে অনুপ্রবেশকারীদের জড়িত থাকার উল্লেখ নেই। একই সময়ে দেখা যাচ্ছে আদিবাসীদের জমি সবচেয়ে বেশি পরিমাণটাই চলে গেছে কর্পোরেট মালিকানার দখলে। এহেন দখলদারী কায়েম করতে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাও স্পষ্ট।
এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তব্যে যেভাবে ধর্মীয় বিভাজনের ইঙ্গিত দিলেন তা অত্যন্ত দুঃখজনক।

এমন একটি দিনে জাতীয় ঐক্যের বার্তা দেওয়ার পরিবর্তে বিভেদমূলক মনোভাবকেই তুলে ধরা হয়েছে।
এমন একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়ককে আজ ভারতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, যার শাসনকালে এই সকল তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশকারী’-দের আমাদের দেশে ঢোকার অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এই দ্বিচারী অবস্থান গ্রহণ কি পরস্পরবিরোধী নয়?

স্বাধীনতা দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে আরএসএস’র ভূয়সী প্রশংসা করলেন তা শুধু সবাইকে অবাক করেনি বরং বলা যায় এহেন আচরণে দেশের ব্যবস্থায় জনসাধারণের যে আস্থা রয়েছে তাকে গুরুতররূপে লঙ্ঘন করা হয়েছে। যে আরএসএস’এর বিরুদ্ধে বারংবার হিংসা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে তাদের এভাবে মহিমান্বিত করা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। এমন ভাষণ নিয়ে প্রশ্ন তো উঠবেই।

ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল যাঁকে আজকের শাসকদল শ্রদ্ধার সঙ্গে ‘লৌহপুরুষ’ বলে অভিহিত করে, তিনিই একসময় আরএসএস সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আরএসএস’কে নিষিদ্ধ ঘোষণার সময় তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন— ‘ দেশের মধ্যে ঘৃণা ও হিংসাকে নির্মূল করতেই ঐ পদক্ষেপ নিতে হয়। আরএসএস’র সদস্যরা এমন সব ভয়ানক ও অবাঞ্ছিত কাজকর্মে জড়িয়েছিল যা দেশের স্বাধীনতা ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির পক্ষে বিপজ্জনক ছিল। আগুন লাগানো, লুটপাট, ডাকাতি সহ হিংসামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আরএসএস’এর সদস্যরা যুক্ত ছিল।’
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ঘটে যাওয়া বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তদন্তে গঠিত সরকারি কমিশনগুলিও নিজেদের তদন্তে আরএসএস’এর ভূমিকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে, তাদের কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সেই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতা দেওয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে তাদের প্রশংসা করলে তাতে শুধু অতীতকে ধামাচাপা দেওয়া হয় না। গণতান্ত্রিক কাঠামো ও সংবিধান স্বীকৃত আইনের শাসনকে সুরক্ষিত রাখতে দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের উপর ন্যায় ও নৈতিকতার যে দায় বর্তায় এমন আচরণ সেই মূল্যবোধেরও পরিপন্থী হয়।
তাই একথা বলা চলে যে, প্রধানমন্ত্রী নিজের সীমারেখা অতিক্রম করেছেন এবং নিজেকে একজন প্রচারকে পর্যবসিত করেছেন। 
তার এমন আচরণ সারা দেশে ও গোটা দুনিয়াই দেখেছে।

ইন্ডিয়া, যার আরেক নাম ভারত সেই দেশের জন্য এবারের স্বাধীনতা দিবস এক শোকদিবসে রূপান্তরিত হলো।
 

Comments :0

Login to leave a comment