post editorial

হেথায় সবারে হবে মিলিবারে

উত্তর সম্পাদকীয়​

বনবাণী ভট্টাচার্য
ধর্মতন্ত্রের ভণ্ডামি-চাতুর্য-নিষ্ঠুরতায় উদ্বিগ্ন—ক্ষিপ্ত কবি, যেন নাস্তিকতার চূড়ায় উঠে কালাপাহাড় হয়ে জড়-অচেতন জাতিকে নির্দেশ দিলেন —
‘‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।’’
জ্ঞানই তো প্রমিথিউসের সেই স্বর্গ থেকে চুরি করে আনা আগুন, যা পোড়ায়, যা আলো দেয়। যুদ্ধ যখন বে‍‌জেই গেল, তখন চাই আলো এবং আরও আলো। অন্ধকার থেকে আলোয় যাওয়ার পথ মানুষের চির আশ্রয় সেই রবীন্দ্রনাথেই, যিনি বারবার বলেছেন, ‘‘মনুষ্যত্বই মানুষের ধর্ম, যেমন জলের ধর্ম জলত্ব।’’ বলেছেন— ‘‘আমার ভগবান মানুষের যা শ্রেষ্ঠ তাই নিয়ে।’’ তাই, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রীর ভাগ্যবিধতা বা চিরসারথি যেমন পঞ্চম জর্জরা‍ কেউ নন, তেমনি তাঁর মহামানবও, কোনও অবয়বহীন ব্রহ্ম বা বুদ্ধ-যিশুখ্রিষ্ট-হজরত মহম্মদও নন। কবির স্বর্গও মানবভূমি। মানব-অভ্যূদয়ের মহামানবই তাঁর উপাস্য— মাটি মাখা মানুষের নৈতিক উত্তরণেই তাঁর চির আকাঙ্ক্ষা। কত শতাব্দী হয়ে গেল, মানুষ তবু তো মানুষ হলোনার আক্ষেপের অবসান করতে হবে আজ— নৈতিক শক্তির জাগরণ আর সাহসে বিস্তৃত বক্ষপটে অধিকারই আজ মানুষের ধর্ম। ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়ক গোরার মতো উচ্চারণ হোক আজ ঘরে ঘরে — ‘‘আজ আমি ভারতবর্ষীয় ... ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্ন আমার অন্ন।’’ যে দীক্ষিত হতে চায় সেই দেবতার মন্ত্রে, ‘‘ যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান সকলেরই। যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।’’ আজ এই যুদ্ধের দিনে, দেশ রক্ষা, তার ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার পথ— 
‘‘ঠেলে দে আড়াল ঘুচিবে আঁধার আপনার ‍‌ফেল দূরে,
সহজে তখনই জীবন্ত তোমার অমৃতে উঠিবে পুরে।’’
আর সেই দেশের সঙ্কটের উন্মত্ত দুর্দিনেও জনগণ ঐক্য বিধায়কের কবির উদ্দেশ্যে সমস্ত ভারত আজ নতমস্তক—
‘‘মুক্ত কর হে সবার সঙ্গে, মুক্ত কর হে বন্ধ,
সঞ্চার কর সকল কর্মে, শান্ত তোমার ছন্দ।’’
‘‘দেশের অসংযত রচনা চিরদিন শুধু আমার উদ্দেশ্যে শুধু বিষই উদ্‌গার করে চলেছে। ... কোনও একটা বিষয়ে যদি মনের মতো চলতে না পারলাম, তাহলেই সারা জীবনে যা কিছু করেছি, সঙ্গে সঙ্গে তা ধূলিসাৎ করে দিতে বাঁধে না।’’ এক বুক যন্ত্রণা আর অভিমান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, যিনি স্বদেশের মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে গেয়েছেন— ‘‘চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’’, সেই বিশ্বকবি লিখলেন— ‘‘যৌবনে লিখেছিলাম, সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে— যাওয়ার আগে এই পঙ্‌তিটি কেটে দিয়ে যাব আমার রচনা থেকে।’’
এ এক সীমাহীন দুঃখের অভিব্যক্তি অভিমানী কবির। প্রেক্ষিত হলো তাঁরই রচিত একটি গান, যে গানের কথা এই উপমহাদে‍‌শের জাতীয়‌ সঙ্গীতের গৌরব মুকুট পরবর্তীকালে শোভা পেয়েছে। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ পদানত ভারতে পঞ্চম জর্জের ভারতে আগমন উপলক্ষে রাজ্য সরকারের প্রতিষ্ঠাবান কবির বন্ধু (সম্ভবত পাথুরিয়াঘাটার স্যার ও মহারাজা উপাধিতে ভূষিত প্রদ্যোৎ ঠাকুর ) কবিকে সম্রাটের জয়গান করে একটি গীত রচনার অনুরোধ করেন। কবি জনগণমন অধিনায়ক গানটি রচনা করেন। য‍‌দিও গানটি যথেষ্ট রাজবন্দনা না থাকায়, রাজা-রানির সংবর্ধনা সভায় গাওয়া হয়নি। প্রদ্যোৎ ঠাকুর, বি‍শিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ দক্ষিণা সেনকে দিয়ে অন্য একটি গান রচনা ক‍‌রিয়ে, তারা তা পরি‍‌বেশন করেন।’’ বন্ধুর অনুরোধ কবি উপেক্ষা করতে পারেননি— কিন্তু তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। আর ‘‘এই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপের সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ গানে সেই ভারত ভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি, পতন-অভ্যুদয় বন্ধুরপন্থা যুগ যুগ ধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসাথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানব-ভাগ্য-রথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনও জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন। কেন না তার ভক্তি যতই প্রবল থাক, বুদ্ধির অভাব ছিল না।’’
সেদিন ব্রিটিশের বুটের তলায় পিষে যাওয়া নিদ্রিত ভারতের জেগে ওঠাই ছিল বিশ্বকবির একান্ত প্রার্থনা। ঘরে-বাইরে বিপন্ন ভারতকে রক্ষা করতে, ভারত-সন্তানকে এক হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে — জাগতে হবে সমস্ত জড়তা হতে, মুক্ত হতে হবে সমস্ত অন্ধ কুসংস্কার থে‍‌কে, বিদ্বেষ থেকে, ধর্ম মোহের জাঁতাকলের থেকে, সমস্ত মিথ্যা ও ভ্রান্তির মরণ থেকে, এই প্রার্থনা, আজ জাতির বিপন্নতায়, রবীন্দ্রনাথকে, কিছু বুঝে, কিছু না বুঝেও, ‘‘তাঁর অতিবিস্তৃত ডানার নিচের নিশ্চিন্তে ঘরকন্না’’ করা আবাহমান বাঙালির সংস্কৃতি তো অবশ্যই, ভারতবাসীর সম্প্রীতির সংস্কৃ‍‌তিরও। তারই তো শিক্ষা, হূণ-শক-হূন -পাঠান-মোঘলদের ভারত—আগমন উল্লেখ করে যে, তারা বিভেদ ভুলে, ভারত সত্তায় একীভূত হয়েছে —
‘‘তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে
কেহ নহে নহে দূর,
আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে
তার বিচিত্র সুর।’’
আর তাই, ধর্মীয় মৌলবাদ যখন বিভেদের বিষ ছড়ায় গণতান্ত্রিক ধর্মনির‍‌পেক্ষ শক্তি তখন সম্প্রীতি আর দেশ‍‌প্রেমের দিনমজুরি করে। 
ভূস্বর্গ কাশ্মীর আবার রক্তস্নাত। ভারতের সুইজারল্যান্ড অপরূপ পাহেলগাম যে পাকিস্তানী সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণে ২৬ জন নিহত হয়েছে— রক্তে ভাসছে বৈসরন। সন্ত্রাসবাদীদের বর্বরতার বলি হলো নব দম্পত্তির মধুচন্দ্রিমা-যাপন, যার হাত ধরে নব পরিণীতার নতুন পথ চলা শুরু, সেই হাত, সেই প্রাণ, স্পন্দনহীন করল সন্ত্রাসীরা কেবল হিন্দু বলে। ওদের কাছে খুব জরুরি ছিল পর্যটকদের ধর্ম জানা? কারণ ইসলামী সন্ত্রাসবাদীরা হিন্দু নিকেশ করতেই বদ্ধপরিকর। আর তা সফল করার জন্যই, পর্যটকদের রক্ষা করতে যাওয়া মুসলিম আদিল হুসেন শাহকে গুলি করল ইসলামগত প্রাণ ঐ সন্ত্রাসবাদীরা।
কাশ্মীর এখন সব অর্থেই মৃত্যু উপত্যকা। যে বসন্তে কাশ্মীর তারা নানা রঙের টিউলিপ হালকা গোলাপি চেরি, হলদে সরষে খেত নিয়ে, আপেল-বাদাম-ন্যাশপাতির ফলভারে নত হয়েও শ্বেত-শুভ্র তুষার আর প্রস্ফুটিত ফুলের বর্ণের ছটায় অতুল ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে, সেই কাশ্মীর আজ ব্যথায় নীল, লজ্জায় ম্লান অতিথিদের রক্ষা করতে, স্বস্তি দিতে পারেনি বলে। ভ্রমণবিলাসী সৌন্দর্যপিয়াসীদের পাদস্পর্শে যে কাশ্মীর ফুলের মতো হেসে ওঠে, সারা শরীরজুড়ে হোটেল-গেস্টহাউস-হোম স্টে-হাউসবোট, শিকারা, টাঙা, ঘোড়া-খচ্চর-স্লেজ, দোকান-পশার নিয়ে তার সীমাহীন কর্মচঞ্চলতা, সেই কাশ্মীর আজ বিবর্ণ-মূকস্থবির। আতঙ্কের প্রহর গুনে তার সূর্য ওঠে, সূর্য অস্ত যায়— রাত্রি নামে। খিদের পেট জ্বলে অনাহার-অর্ধাহারে। হোটেল-দোকান স্তব্ধ। সর্বত্র যুদ্ধ প্রস্তুতি— পাকিস্তান মোকাবিলার শৌর্যের তীব্র আওয়াজ। শ্রীহীন শ্রীনগর। আতঙ্কের শীতল স্রোতে কাশ্মীর এখন যেন মৃত নগরী। কোন অপরাধে কাশ্মীরের এই দণ্ড? কাশ্মীর তো নিরাপত্তা বাহিনীর ঘেরাটোপে থাকা। 
কোন অপরাধে মুর্শিদাবাদের একটি শান্ত নিরীহ গ্রামে হঠাৎই বাড়ি-ঘর ভাঙচুর, লুটপাট এবং খুন-খারাবি? ২/৩ মিনিট নয়, ৩ ঘণ্টা ধরে চলেছে এই ধ্বংসকাণ্ড। প্রশাসন নামে ‘ভগবান’ কি নিদ্রায় ছিলেন? কিন্তু শব্দ তো বড় কম ছিল না। মানুষ, ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে শুধু ১২নং জাতীয় সড়কেই বিভিন্ন জায়গায় অবরোধ করে তাদের ক্ষোভ জানায়নি— এই বিক্ষোভ হয়েছে সারা দেশজুড়ে, কারণ মানুষ আহত হয়েছে এই ওয়াকফ আইন-বিড়ম্বনায়, যা অস্বীকার করেছে দেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, কেড়ে নিয়েছে ন্যায্য ও আইনসঙ্গত অধিকার যা হিন্দুরও, যা মুসলমানেরও, ফলে হিন্দুও শামিল ঐ বিক্ষোভে। তাহলেও রাজ্য প্রশাসনের ঘুম ভাঙল না কেন? তাহলে কেন ৭০ বছরের পিতা ও তার পুত্রের একই সাথে স্থান হলো শ্মশান-শয্যায়, কি প্রয়োজন ছিল এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের? আসলে, ধর্ম ক্ষমতার রাজনৈতিক প্রয়োজন।
পাহেলগামের হত্যালীলা আর জাফরাবাদের হত্যাকাণ্ড একই প্রয়োজন মেটায়— সে প্রয়োজন হলো ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে ভারতবাসীর ঐক্যের বন্ধন ছিঁড়ে ফেলা— সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তোলা— ধর্মীয় বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে এই উপমহাদেশকে হীনবল করা। ঘরে বাইরে যে শত্রুদের, মানুষের সম্প্রীতির বন্ধনকে নিজেদের গলার ফাঁসের মতো মনে হয়, সেই দৈত্যরাই ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষ ছড়ায় ও ছড়িয়েছে। 
যুদ্ধ লাগার বাকি নেই। ভারত, ১৫ দিনের মধ্যেই পাহেলগাম কাণ্ডের সমুচিত জবাব দিয়ে বদলা নিয়েছে। ভারতের পাশে অনেক দেশ। বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে দেশপ্রেমিক সমস্ত ভারতবাসী রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের সবটুকু দিয়ে শত্রুকে পরাস্ত করতে উদ্যত। সারা ভারতের রক্ত টগবগ করে ফুটছে।
রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, আধুনিক মহাজনী যুগের সমস্ত রাষ্ট্রশক্তি সোভিয়েত রাশিয়া সহ নিপীড়িতের অধিকারের প্রতিষ্ঠার যুদ্ধের বিরোধিতায় প্রচুর রক্ত খরচ করবে। রক্ত নদী পার হয়েই পদানত-অত্যাচারিতের আত্মপ্রতিষ্ঠা যখন, তখন কবি নিজেই ঘোষণা করলেন, ‘‘শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’’ শুধু নয়, নিজেও যেন রণক্ষেত্রে যাবার জন্যে প্রস্তুত, বললেন — ‘‘এবার সকল অঙ্গ ছেয়ে/ পরাও রণসজ্জা’’। বুঝেছিলেন তরোয়ালের সাথে তরোয়ালেই কথা চলতে পারে। তাহলে কি বিশ্বকবি দু’পক্ষের যুদ্ধকেই স্বাগত জানিয়েছেন? উৎসাহ দিয়েছেন?
কবি সমস্ত অন্তর দিয়ে যুদ্ধকে-যুদ্ধবাজদের ঘৃণা করেছেন। যুদ্ধোন্মত্ত বিশ্বের ‘প্রলয়ের সৃষ্টি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘‘উদ্দাম নিষ্ঠুরতা আজ ভীষণাকার মৃত্যুকে জাগিয়ে তুলেছে সমুদ্রের তীরে তীরে, দৈত্যরা জেগে উঠেছে মানুষের সমাজে, মানুষের প্রাণ যেন তাদের খেলার জিনিস। মানুষের ইতিহাসে এই দানবিকতাই কি শেষ কথা?’’ অত্যন্ত ব্যথিত মনে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘‘মানুষের মধ্যে এই যে অসুর এই কি সত্য?’’ কবি, ১৯৩৭ সালে ফ্যাসিবাদের বর্বরতায় ক্রুব্ধ ঘৃণা উগড়ে দিয়েছেন, কিন্তু দেখে যেতে পারেননি অসুরদের পরাজয়, আর অপরাজিত মানুষের বিজয় পতাকার ‘সত্য’কে।
ভারতে চলছে এখন, ইসলামী সন্ত্রাসবাদী এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের তুমুল তৎপরতা। ভারতবাসী মাত্রেই চাইবে ভারতের জয়। পাকিস্তানের থেকে ভারত শক্তিশালী হলেও, যুদ্ধজনিত বিপন্নতা থেকে সে মুক্ত নয়। ভারতীয় জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিই এই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের রামধনু রাঙা ভারতের আসল শৌর্য এই চ্যালেঞ্জ জেতার জন্যে। শ্রুতিকটূ হলেও বর্তমান শাসনে ভারতবাসীর সেই ঐক্য এখন প্রশ্নের মুখে। ভারত আজ বিচ্ছেদের ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত— ধর্ম-বর্ণ-জাতের ভিত্তিতে ভারতকে এমনভাবে ভাগ করা হয়েছে যে পাহেলগামে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে কোনও মানুষ মারা যায়নি, ভারতবাসীও না, নিহত হয়েছে ২৪/২৫ জন ‘হিন্দু’। একজন ভারতবাসীর এখন একমাত্র পরিচয় সে হিন্দু না মুসলমান। খেদের সাথে বলতে হয়, আজকের ভারতের কান্ডারিরা চিৎকার করে বলতে পারে না, মরছে মানুষ, ‘‘ডুবিছে সন্তান মোর মার।’’ শাসকেরা যুগে যুগে নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করেছে ধর্মকে; ব্রিটিশই প্রথম ডিভাইড অ্যান্ড রুলের প্রয়োগ করে। পরাজিত হলেও ১৮৫৭ সালের অতবড় সিপাহী বিদ্রোহের রসদ ছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলিত শক্তি। মুসলিম বাহাদুর শাহ্‌-ই কিন্তু হিন্দু লক্ষ্মীবাঈকে প্রথম এই স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনাপ্রধান মনোনীত করেছিলেন। সে এক ঐক্যবদ্ধ ভারত আর সম্প্রীতির সংস্কৃতির কথা।
অপারেশন সিন্দুর, স্বামীহারাদের খানিকটা সান্ত্বনা দিয়েছে— সন্ত্রাসবাদী হামলার স্পর্ধার উপযুক্ত জবাবে দেশবাসী স্বস্তি পেয়েছে। হিন্দুত্বের গন্ধমাখা সিন্দুর না হয়ে, অন্য নামের এই অপারেশনের সাফল্যেও ভারত গর্ববোধ করত নিশ্চয়ই, কারণ ভারতের এই আক্রমণ বর্বর সন্ত্রাসবাদও তার পৃষ্ঠপোষকদের ধ্বংস করার এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। কিন্তু বিপদ তো থেকেই গেছে বহির্শত্রু পাকিস্তান আর অভ্যন্তরীণ শত্রু উগ্রজাতীয়বাদও ধর্মান্ধতা যখন অখণ্ড অবিভাজ্য ভারতীয় সত্তা— ঐক্যবদ্ধ ভারতবাসীর সব থেকে বেশি প্রয়োজন। 
ক্ষমতার দক্ষিণপন্থা মানুষের সভ্যতার কখনও সহায়ক হয়নি, ‘আমার জাতি’ ‘আমার ধর্ম’ অর্থাৎ আমিই শ্রেষ্ঠ এই ধ্বনিতে। বর্মে চর্মে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তলোয়ারে শান দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টায় পৃথিবীর মঙ্গল নয়, সর্বনাশ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধের হিংস্রতায় এত মৃত্যু এত দুঃখ এত ক্ষতিতে উচ্চারণ করেছেন— মা মা হিংসীঃ; লিখলেন রক্তমেঘ-মাঝে — ‘‘লজ্জা শরম তেয়াগি/ জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়/ ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।’’
ধর্মীয় বিদ্বেষ-ধর্মন্ধতা ছিল, মানবতার কবি রবীন্দ্রনাথের কাছে চরমতম এক সর্বনাশা গরল, যা বাতাস বিষিয়ে দেয়, সভ্যতার আলো দেয় নিভিয়ে। কবির জীবনে দুঃখজনক অভিজ্ঞতার অন্যতম ভারতীয় সমাজের হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ। এক সুখ-দুঃখের মধ্যে, একই অপমান, একই অসম্মানের মধ্যে বাস করেও হিন্দু-মুসলমান পরস্পর বিরুদ্ধ। এই সম্প্রদায়গত বিদ্বেষকে ইংরেজ কাজে লাগিয়েছে বলে কবির বিশ্বাস। তিনি মনে করেননি যে কোনও শাস্ত্রেই হিন্দু বা মুসলমান, কেউ কাউকে ঘৃণা করবে এমন বিধান আছে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন— ‘‘মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশের ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয় মনুষ্যতর হিসাবে তাহাদিগকে দুর্বল হইতেই হইবে।’’ তিনি বিশ্বাস করেছেন এই যে বিদ্বেষ, এই যে বাধা— ‘‘ধর্মের নয়, সে বাধা আমাদের স্বভাবের ক্ষুদ্রতার বাধা— তাকেই আমরা ধর্মের উপর আরোপ করে সামাজিক বা সাম্প্রদায়িক করে তুলি।’’ তাই ‘ঘরের বাইরে’র নিখিলেশ অনায়াসে বলে উঠতে পারলেন, ‘‘গোরু-মোষ দুই-ই দুধ দেয়, চাষে লাগে, কেবল গোরুই যদি অবধ্য হয়, আর মোষ যদি অবধ্য না হয়, তবে ওটা ধর্ম নয়, ওটা অন্ধ সংস্কার।’’ কবি এক চিঠিতে লিখেছেন — ‘‘আমরাই ভগবানের নাম করে পরস্পরকে ঘৃণা করেছি— এমন সকল নিরর্থকতা সৃষ্টি করেছি যাতে মানুষকে মূঢ় করে ফেলে।’’ এই মূঢ়তাই ধর্মতন্ত্রের পুঁজি। ধর্ম আর ধর্মতন্ত্র এক নয়, যেমন হিন্দু আর হিন্দুত্ব এক নয়। ‘বিসর্জন’ থেকে ‘প্রথম পূজা’র মতো কাহিনিতে ধর্মীয় প্রথা ও কুসংস্কারের চরম অমানবিক রূপ প্রকাশ করেছেন। নিজে মাদুরাই মন্দিরের রাশিকৃত গহনা দেখে লজ্জিত হয়ে মনে করেছেন, ঐ গহনায় লক্ষ লক্ষ লোকের দৈন্য-অজ্ঞানতা-স্বাস্থ্য ক্ষুধিতের অন্নের মূল্য পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। যুক্তি-বুদ্ধির ধারণা ধারলে জাতি সজীব থাকে না। কবির উপলব্ধি —
যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার (কিন্তু চলাচলের পথে লতাগুল্মও জন্মায় না)
যে জাতি চলে না কভু তারি পথ ’পরে
তন্ত্র-মন্ত্র-সংহিতায় চরণ না সরে।

Comments :0

Login to leave a comment