Post Editorial

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের ৮০ বছর

উত্তর সম্পাদকীয়​

সংগ্রাম চ্যাটার্জি 
"এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে..." (রবীন্দ্রনাথ: সভ্যতার সংকট; পয়লা বৈশাখ, ১৩৪৮) 
সেই ঐতিহাসিক দিন
তখন বার্লিনে ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেরিয়েছে, ফলে ক্যালেন্ডারে ৯ মে। সালটা ১৯৪৫। মিত্রশক্তির চার প্রতিনিধির সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করল জার্মান সেনা। অবশেষে পরাজিত হলো একদা অপরাজেয় নাৎসি বাহিনী, আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলো পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে অভিঘাতময় পর্ব— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর প্রায় ৫ কোটি জীবনের বিনিময়ে (যার সিংহভাগই সোভিয়েত ইউনিয়নের) বিশ্ব মানবতা তার সবচেয়ে বড় বিপদকে মোকাবিলা করে ইতিহাসের ভয়ংকরতম অধ্যায় পেরিয়ে পা রাখল নতুন এক পর্বে।
বার্লিনের সংসদ ভবন রাইখস্ট্যাগের মাথায় তখন লাল ঝান্ডা হিল্লোলিত হচ্ছে। সেই রাইখস্ট্যাগ, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তৃতীয় রাইখের নামে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর জয়যাত্রা। সেই রাইখস্ট্যাগ— যা পুড়িয়ে দেওয়ার মিথ্যে মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নেতা কমরেড দিমিত্রভের ঘাড়ে! সেই রাইখস্ট্যাগ— যা ছিল ফ্যাসিবাদের জয়ের প্রতীক তার চূড়োয় তখন লাল ঝান্ডা! আজ থেকে ঠিক ৮০ বছর আগে।
"যুদ্ধ আর আশার মধ্যে এ'এক দৌড় চলছে বটে! একরকম মৃত্যুর সাথে আরেকরকম মৃত্যুর প্রতিযোগিতা। কে আগে? ফ্যাসিজমের মৃত্যু? না আমার? হাজার হাজার মানুষ মরবে! তারপর যারা বেঁচে থাকবে তারা বলবে— ফ্যাসিজমের অধ্যায় আমি পার হয়ে এলাম!" (জুলিয়াস ফুচিক: ফাঁসির মঞ্চ থেকে)
আগের কিছু কথা
সালটা ১৯১৭, নভেম্বর মাস। মানব সভ্যতার অন্যতম যুগান্তকারী অধ্যায়ের সাক্ষী থাকল গোটা বিশ্ব— কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির হাত ধরে সমাজ বিকাশ এক অন্য ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করল, বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই প্রথমবার শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রব্যবস্থা পথ চলা শুরু করেই পাল্লা দিল তাবড় তাবড় পুঁজিবাদী দেশগুলোর সাথে। গোটা মানবসভ্যতার সামনে হাজির করল প্রকৃত বিকল্প, প্রকৃত স্বাধীনতা এবং তখনও পর্যন্ত সবথেকে প্রসারিত এবং আক্ষরিক অর্থেই সবচেয়ে গভীরে প্রোথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে।
শুরুতেই এই বিকল্পকে শেষ করার লক্ষ্যে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইউরোপের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি! কিন্তু পারেনি। পরাজিত পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ যে পথে চলা শুরু করল, তারই এক পর্যায়ে সামনে এল বিশ্ব মানবতার ঘৃণ্যতম শত্রু—সবচেয়ে বড় বিপদ: ফ্যাসিবাদ!
ফ্যাসিবাদ কী?
ব্রিটিশ কমিউনিস্ট নেতা রজনী পাম দত্তের মতে, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে চরম অবক্ষয়ের এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে আধুনিক পুঁজিবাদের পূর্ণাঙ্গ ও সবচেয়ে 'স্বাভাবিক' রূপ। তাঁর মতে, ফ্যাসিবাদের বিকাশের জন্য একদিকে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপট, প্রচলিত সংসদীয় ব্যবস্থার সম্পর্কে ব্যাপক মোহভঙ্গ, সমাজের বড় অংশের ওপরে পুঁজিপতি শ্রেণির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের পাশাপাশি শ্রমিকশ্রেণির দুর্বলতাও দায়ী।
কমরেড স্তালিনের কথায়, শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণির না, বরং পুঁজিপতি শ্রেণির দুর্বলতার অন্যতম লক্ষণ ফ্যাসিবাদ, যখন আর পুঁজিপতি শ্রেণি একদিকে নিজ নিজ দেশের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং অন্যদিকে অন্যান্য দেশের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলা করতে পারে না, তখনই উদ্ভব হয় ফ্যাসিবাদের!
কমরেড দিমিত্রভের ব্যাখ্যা, "ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদ হচ্ছে লগ্নিপুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী অংশের সর্বোচ্চ প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব"। 
ফ্যাসিবাদের সূচনা: ইতালি
আধুনিক পুঁজিবাদের উত্থানভূমি ইউরোপেই ফ্যাসিবাদের জন্ম! ইউরোপীয় রেনেসাঁর অন্যতম কেন্দ্র ইতালিতেই সৃষ্টি এই মতবাদ, মুসোলিনী আর তার রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ত পার্টির হাত ধরে।
১ম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত, জর্জরিত এবং ভার্সেই চুক্তির ফলে চরম অপমানিত একটা দেশে তখন এই অবস্থার বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়ছে। প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হচ্ছে সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯২২'র নির্বাচনে ২৭৩টি আসনের মধ্যে সোসাল ডেমোক্র্যাটরা পেল ১২২টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি ১১৬টি। এই প্রেক্ষাপটে ইতালি আরেকটা রাশিয়া যাতে না হয়ে যায়, সেই লক্ষ্যে হাত মেলালো কমিউনিস্ট বিরোধী সব শক্তি, সামনে ইতালির ফ্যাসিস্ত পার্টি ও তার নেতা বেনিটো মুসোলিনী!
১৯২২ সালেই কুখ্যাত 'ব্ল্যাকশার্ট বাহিনী' নিয়ে মুসোলিনীর রোম অভিযান এবং ক্ষমতা দখল। প্রাচীন রোমের আধা কাল্পনিক কীর্তিকলাপকে আধুনিক মোড়কে সামনে এনে সেইমতো দেশ গড়ার স্লোগানে গোটা দেশ জুড়ে সৃষ্টি করা উগ্র দেশপ্রেমের গণ হিস্টিরিয়ার মাঝেই চলল নির্মম কমিউনিস্ট নিধন যজ্ঞ। ১৯২৬ সালে ইতালির একনায়ক (ডুস্যে) হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেন মুসোলিনী, পথ চলা শুরু করল পুঁজিবাদের বিকৃততম রূপ ফ্যাসিবাদ!
জার্মানি: হিটলার ও নাৎসিবাদ 
মুসোলিনীর 'অনুপ্রেরণা'য় জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ কায়েম হলো হিটলারের নেতৃত্বে, তার নাৎসি বাহিনীর চরম আগ্রাসনের মাধ্যমে, জার্মানির আধা কাল্পনিক অতীত-গৌরবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্লোগান, উগ্র অন্ধ কমিউনিস্ট বিরোধিতায়। এতে শামিল হলো চার্চ, শিল্পপতি, বড় পুঁজিপতি, মিলিটারি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বৃহত্তর জার্মানি গড়ার আওয়াজ উঠল। সাথে চরম উগ্র ইহুদি বিরোধিতা। ‘খাঁটি আর্য’ জার্মান রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষায় 'বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্ব'-র স্লোগান তুলে বিদ্বেষের বাতাবরণ নির্মিত হলো।
ইহুদিদের এবং এদের একমাত্র মদতদাতা, জার্মানির উন্নতির পথে একমাত্র শত্রু ‘দেশদ্রোহী’ কমিউনিস্টদের শেষ করা না গেলে ‘জার্মান শ্রেষ্ঠত্ব’ অর্জন করা সম্ভব নয়, এই ছিল হিটলারের প্রচার! যার মাধ্যমে সংসদীয় নির্বাচনে বড় অংশের মানুষের সমর্থনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন হিটলার!
এই সবকটা প্রবণতার এখনকার আমাদের দেশের পরিস্থিতির কিছুটা হলেও মিল খুঁজে পাচ্ছেন না?
এই সব কিছুর সাথে হিটলারের ছিল অভূতপূর্ব অসত্য প্রচারের ঝড়। তার প্রচার সচিব গোয়েবলসের নেতৃত্বে অর্ধসত্য ভাষণ বারেবারে প্রচার করে সেটাকেই জনমানসে সত্যি কথা হিসাবে গেঁথে দেওয়া হলো। এর সাথে 'গোদী মিডিয়া'র মিল খুঁজে পাচ্ছেন!
'ব্ল্যাকশার্ট'র মতো এখানেও তৈরি হলো ততোধিক ভয়ংকর 'ব্রাউন শার্ট' বাহিনী। এই ব্ল্যাক শার্ট, ব্রাউন শার্ট ইত্যাদির সাথে কোথাও সাদা জামা আর খাঁকি প্যান্ট পরা চেনা লোকজনের মিল পাচ্ছেন কি?
আরও যে দুটো শব্দ বাদ দিয়ে হিটলার অসম্পূর্ণ, তা হলো 'SA' (ঝটিকা বাহিনী), এবং অবশ্যই গেস্টাপো (নাজিদের গোপন পুলিশ)! 
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্রের সবকটি স্তম্ভ একে একে করায়ত্ত করে তারপর একদিকে তৎকালীন জার্মান পুঁজিপতিদের থেকে পাওয়া অফুরন্ত ফান্ড, আরেকদিকে গোয়েবলসীয় প্রচার এবং সর্বোপরি  'SA', ব্রাউন শার্ট বাহিনী আর গেস্টাপো বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধীদের বিশেষ করে কমিউনিস্ট ও ইহুদিদের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে সীমাহীন অত্যাচার চালিয়ে, খুন করে, আইনস্টাইন সহ হাজারো প্রথিতযশা ইহুদিকে দেশ থেকে তাড়ানো হলো। বার্লিনের রাস্তায় প্রকাশ্যে লাখো লাখো বই জ্বালিয়ে (১০মে, ১৯৩৩) গোটা দেশজুড়ে লাগাতার খুন-সন্ত্রাসের নারকীয় পরিবেশ তৈরি, উগ্র জাতীয়তাবাদী গণ হিস্টিরিয়া নির্মাণ করে দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে ১৯৩৪ সালে ডিক্টেটরশিপ চালু করে হিটলার হলেন জার্মানির সর্বময় কর্তা, ফ্যুয়েরার!
Final Solution! 
১৯৩৫ সালে জার্মানির পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন করে ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে এক ধর্মের মানুষকে ২য় শ্রেণির নাগরিক করা হলো, এরই কোড নেম হচ্ছে ঐ "Final Solution"। বসতি চিহ্নিত করে তাদের একটা ছোট্ট অংশে ঘিরে ফেলে (ঘেটো), সবাইকে তুলে নিয়ে রেলগাড়ি চাপিয়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হলো। (মোদী জমানায় ডিটেনশন ক্যাম্প) ১৯৪২'র মে মাসে তৈরি হলো সবচেয়ে বড় ক্যাম্পগুচ্ছ আউৎসউইচ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। 
এবার স্পেন
১৯৩০'র দশকের গোড়াতে স্পেনে ধারাবাহিকভাবে গণআন্দোলন-গণসংগ্রামের তীব্রতা বাড়ার প্রেক্ষাপটে একে মোকাবিলায় ফ্যাসিস্তদের বাড়াবাড়িও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই বিপদের মুখে ওখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পপুলার ফ্রন্ট ১৯৩৬'র নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এই সরকারকে ফেলার লক্ষ্যে ফ্যাসিস্ত ফ্যাঙ্কোর উদ্যোগে হাত মেলায় সে দেশের সব প্রতিক্রিয়ার শক্তি। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ! ফ্যাসিস্ত ফ্যাঙ্কোর পক্ষে সরাসরি নেমে পড়ে ইতালি ও জার্মানি। উলটোদিকে পপুলার ফ্রন্টের সরকারকে সমর্থন করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত এবং ফ্যাসিবিরোধী এই সংগ্রামে সরাসরি যুক্ত হন সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কমিউনিস্টরা, এমনকি লেখক-শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মীরাও! এই লড়াইকে সংহতি জানায় আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোও। স্পেনে গড়ে ওঠে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড। লড়াইয়ে শহীদ হন ক্রিস্টোফার কডওয়েল, র্যা লফ্ ফক্সের মতো বুদ্ধিজীবীরা। এই লড়াইয়ের ময়দানেই উঠল স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী কমরেড ইবারুরির সেই স্লোগান, "নো পাসারন"!
এই লড়াইয়ে ফ্যাসিস্ত ফ্রাঙ্কোর জয় স্পেনের মাটিতে বেশ কিছু বছরের জন্য ফ্যাসিবাদকে স্থায়িত্ব দিলেও ফ্যাসিবিরোধী শক্তির অসামান্য লড়াই প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উৎসাহিত করে চলেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: কারণ ও প্রেক্ষাপট
বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দায় জর্জরিত পুঁজিবাদী দেশগুলি এই ভয়াবহ সংকট থেকে বেরনোর লক্ষ্যে যেমন বিশ্ব বাজারকে ভাগবাটোয়ারা করার প্রয়াস নিল যার আবশ্যিক পরিণতি আরও একটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, এবং চূড়ান্ত পরিণতি অবশ্যই ফ্যাসিবাদের উদ্ভব। 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গোটা চারেক যুদ্ধ বা আগ্রাসনের ফল। ইতালির আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) আক্রমণ, জাপানের চীন ও মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ, স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং জার্মানির অস্ট্রিয়া পরে চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ। তবে ১৯৩৯'র ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের পোলান্ড আক্রমণের দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার দিন বলা হয়। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে ইতালি, জার্মানি, স্পেন এবং জাপানকে নিয়ে গঠিত অক্ষশক্তি’র বিরুদ্ধে ছিল মিত্রশক্তি - গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সর্বোত্তম বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল ২য় বিশ্বযুদ্ধে।
কমিউনিস্টরা যে চারটি মৌলিক সামাজিক দ্বন্দ্বের কথা বলে, তার সবকটাই প্রকটভাবে প্রতিফলিত হয়েছে ২য় বিশ্বযুদ্ধে। স্পেনের গৃহযুদ্ধ ছিল শ্রমিক বনাম পুঁজিপতিদের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন, জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ ও ইতালির আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) আক্রমণ ছিল তৃতীয় দুনিয়ার দেশের সাথে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশের দ্বন্দ্ব। চতুর্থ কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব সামনে এল ১৯৪১'র ২২ জুন 'অপারেশন বারবারোসা'র হাত ধরে। অনাক্রমণ চুক্তি ভেঙে সেদিনই হিটলার সোভিয়েত আক্রমণ করে। যুদ্ধের চরিত্র পালটে গেল এক লহমায়, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রূপ নিল সাম্রাজ্যবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্বে। যে দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি ঠিক করে দেবে বিশ্ব মানবতার ভবিষ্যৎ— হয় সমাজতন্ত্র অথবা চরম বর্বরতা!!!
শেষ যুদ্ধ
সোভিয়েত সীমানায় নাজি বাহিনী একযোগে চালালো ত্রিমুখী আক্রমণ—উত্তরে লেলিনগ্রাদ, মাঝে রাজধানী মস্কো এবং দক্ষিণে স্তালিনগ্রাদের দখল নেবার লক্ষ্যে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে একদিকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে গুছিয়ে নেওয়া, অবিশ্বাস্য তৎপরতার সাথে কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী কারখানাগুলিকে যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত করা, পালটা আঘাতের প্রস্তুতি নেওয়া এবং সর্বোপরি গোটা সোভিয়েতের জনগণকে বিশ্ব মানবতার স্বার্থে নিজ পিতৃভূমি রক্ষার যুদ্ধে শামিল করার কাজটিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিলেন কমরেড স্তালিন।
ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের একের পর এক দেশের সেনা নাজি সেনা বাহিনীর সামনে কার্যত ফুৎকারে উড়ে গিয়েছিল। শুরুতে প্রতিদিন একের পর এক গ্রাম, শহরের দখল করেছে নাজিরা। এবার সর্বোচ্চ প্রতিরোধ গড়ে তুলল লাল ফৌজ আর সোভিয়েতের জনগণ। 
এই প্রতিরোধ পর্বে স্তালিন মিত্রশক্তির অন্য শরিকদের কাছে সরাসরি দাবি করেছিলেন ইউরোপের অন্য কোথাও দ্বিতীয় ওয়ার ফ্রন্ট খুলুক তারা, কারণ গোটা বাহিনীর সবটাই সোভিয়েতে মোতায়েন করার সুযোগ পাচ্ছে নাৎসিরা। তবে মিত্রশক্তির অন্য শরিকদের কাছে হিটলারের জার্মানির মত স্তালিনের রাশিয়াও তো শত্রু ছিল। যখন লড়াই হচ্ছে সোভিয়েত-জার্মানির বর্ডার জুড়ে, তখন ব্রিটেন-ফ্রান্স-মার্কিনীরা নিরাপদ দূরত্বে বসে অপেক্ষা করেছে যুদ্ধে উভয়েই দুর্বল হবে কখন, সেই সময়ের জন্য।
যখন ওরা বুঝতে পারল সোভিয়েত লালফৌজের জয় প্রায় নিশ্চিত, তখন বাধ্য হয়েই দ্বিতীয় ওয়ার ফ্রন্ট খোলে। ১৯৪৪'র ৬ জুন ফ্রান্সের নর্ম্যান্ডিতে অবশেষে নামে ব্রিটিশ-মার্কিন সেনা! ততক্ষণে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিয়েছে সোভিয়েতের লালফৌজ এবং রুশ জনতার অসামান্য বীরত্বপূর্ণ লড়াই। মস্কো, লেলিনগ্রাদ এবং সর্বোপরি স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ জিতে মার্শাল ঝুকভের নেতৃত্বে লালফৌজ এগলো বার্লিনের দিকে। রোমের রাস্তায় মুসোলিনী ততক্ষণে প্রকাশ্যে ফাঁসিকাঠে ঝুলছে, আর বাঙ্কারের মধ্যে সদলবলে আত্মহত্যা করেছে অ্যাডলফ হিটলার। নাৎসি বাহিনীকে পরাস্ত করে পশ্চিম দিকে ধাওয়া করেছে তখন লাল ফৌজ। ২৭ জানুয়রি আউৎসউইচ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প মুক্ত করে মানবতার কলঙ্কতম এক অধ্যায় শেষ করল লাল ফৌজ! এই দিনটিই পালিত হয় 'Holocaust Remembrance Day' হিসাবে।
২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে পূর্ব ইউরোপ জুড়ে এইরকম অসংখ্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের হদিশ পাওয়া যায়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড়, ঘৃণ্যতম, বিকৃততম অপরাধসমূহ সংগঠিত হয়েছিল এগুলিতে। এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে এনে মেরে ফেলার আগে সর্বস্ব তো নিয়েই নিত এরপর চুল কামিয়ে তা দিয়ে কুশন বানাতো ফ্যাসিস্তরা। গ্যাস চেম্বারে মেরে ফেলা মানুষের চামড়া দিয়ে নানান শৌখিন জিনিসপত্রে ঘর উপচে পড়ত নাৎসি অফিসারদের! এর চেয়েও নৃশংস অপরাধ ছিল — জীবন্ত মানুষকে গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করা হতো এখানে!
মহাযুদ্ধ শেষের পরে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লালফৌজের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের বিজয় পরবর্তী বিশ্ব-পরিস্থিতির গতিমুখকেই পালটে দেয়। পূর্ব ইউরোপের বহু দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয়। শক্তিশালী হয় এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকা জুড়ে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, পরিণতিতে উপনিবেশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং স্বাধীনতা অর্জন করে আমাদের দেশের মতো বহু দেশ। একইসাথে বিশ্ব পুঁজিবাদ বাধ্য হয়েই আশ্রয় নেয় কল্যাণমূলক অর্থনীতির। গণতন্ত্র, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র, সামাজিক নিরাপত্তা, বেকার ভাতা ইত্যাদি সবই এই ঐতিহাসিক বিজয়ের ফলশ্রুতি। 
এক কথায় গোটা দুনিয়ার সামাজিক ভারসাম্য পালটে যায়। বিশ্বে অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে উঠে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন, এশিয়া ভূখণ্ডে নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে উঠে আসে চীন, পরে ভিয়েতনাম। বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করত সমাজতান্ত্রিক ব্লক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির জয় না হলে পৃথিবীর ইতিহাসটাই পালটে যেত, মানবতা ঢেকে যেত গভীরতম অন্ধকারে। এই বিশ্বযুদ্ধের শেষটা ছিল মানবতা বনাম বর্বরতার মহাযুদ্ধে। এটাও অনস্বীকার্য, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয়ের মূল কারিগর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ এবং অবশ্যই তার রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড স্তালিন। স্তালিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত লাল ফৌজের অসামান্য ভূমিকায় রক্ষা পেয়েছিল বিশ্ব মানবতা। 
ঐতিহাসিক বিজয়ের ৮০ বছর পূর্তিতে রবীন্দ্রনাথের শুরুতেই উল্লিখিত অঙ্গীকারটুকুই হোক সবার শপথ, আজ নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থানের সময়।

Comments :0

Login to leave a comment