অবশেষে দুই পারমানবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতি ঠেকানো গেছে। দু’দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র সংবরণে একমত হয়েছে। অনেক মৃত্যু, অনেক রক্তপাত, অনেক ধ্বংস থেকে দু’দেশেরই সাধারণ মানুষ আপাতত মুক্তি পেয়েছেন। তবে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গোলা বারুদের ঘনঘটা এখনো বন্ধ হয়নি। সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা মুসলিম মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান এবং হিন্দু মৌলবাদ তথা হিন্দুত্ববাদ চালিত ভারত-কেউই মন থেকে যুদ্ধ বিরতি চায়নি অন্তত ভারত যুদ্ধোন্মাদনাকে কার্যত গণহিস্টিরিয়াতে পরিণত করেছিল। আর একাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে মোদীভক্ত গোদি মিডিয়া এবং আইটি সেল আলোড়িত সমাজমাধ্যম। যুদ্ধ করে রাতারাতি গোটা পাকিস্তানকে ধূলিসাৎ করে ভারতের আনার জন্য একটা বড় অংশে অন্ধ ভক্ত কার্যত হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। যুদ্ধ চাওয়াকেই তারা দেশপ্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ বলে গণ্য করতে থাকে। তাই কেউ যদি কোনোভাবে যুদ্ধ এড়িয়ে আলোচনার পথের পক্ষে কথা বলেছে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যুদ্ধোন্মাদ ভক্তবাহিনী। সেকু-মাকু বলে শুধু গাল পাড়েনি, কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছে। নিকৃষ্টমানের কদর্যতায় তাদের অপমান করেছে। এমনকি পাকিস্তানের দালাল বলে দেশ থেকে তাড়ানোর হুমকিও দিয়েছে। এরাই রাত জেগে গোদি মিডিয়ায় পাকিস্তান দখলের মিথ্যা যুদ্ধ দেখে আত্মতৃপ্তিতে আটখানা হয়েছে।
ধর্মান্ধ অতি উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যুদ্ধোন্মাদ হলেও দেশের শান্তিপ্রিয় উদার মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক মানুষ যুদ্ধ চাননি। প্রগতির পথিকরা যুদ্ধ চাইতে পারেন না। এর অর্থ এই নয় যে এরা দেশকে কম ভালবাসেন। বরং বলা যায় এরাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক। হঠকারী পথে দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে চান না। চান না যুদ্ধের পরিণতি হিসাবে সাধারণ মানুষকে মূল্য চোকাতে বাধ্য করতে। ইতিহাস সচেতন মানুষ জানেন যুদ্ধে কেউ জেতে না, কিন্তু হেরে যায় শুধু সাধারণ মানুষের জীবন, বেঁচে থাকার স্বপ্ন। তাই সমস্যা সমাধানে এমন এক পথ খুঁজে বার করতে হয় যেখানে ক্ষয়ক্ষতি, মৃত্যু কম। আলোচনাই যে সেই পথ বারে বারে ইতিহাসে তা প্রমাণিত হয়েছে। তাই ভারতের বামপন্থীরা, শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক মানুষ যুদ্ধ এড়িয়ে বিকল্প পথে সমাধানের রাস্তা খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই তাদের দেশদ্রোহী, পাকিস্তানের দালাল বলে গালাগাল শুনতে হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত মোদী সরকারকে ঘাড় নিচু করে যুদ্ধ বিরতিকে মেনে নিতে হয়েছে। দেশের মানুষের কথায় নয়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চোখ রাঙানিতে। যে ট্রাম্পকে মোদী তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে জাহির করেন সেই ট্রাম্পই কার্যত জোর করে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খাইয়ে ছেড়েছেন। মোদী যত বড় লৌহ পুরুষ হোন বা ৫৬ ইঞ্চির বিশ্বগুরু হোন ট্রাম্পের কাছে চুনোপুঁটি। স্বাধীন সার্বভৌম ভারতে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়ে আমেরিকার কাছে মাথা নত করে দেশের মান মর্যাদা বিকিয়ে দিয়েছেন। মোদী যদি যুদ্ধের বিরুদ্ধেই থাকতেন তাহলে বারবার রণহুঙ্কার ছেড়ে যুদ্ধে গেলেন কেন? গিয়ে ট্রাম্পের কথায় ফিরলেনই বা কেন? কেন যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা আগে ট্রাম্পের মুখ থেকে ভারতবাসী শুনবে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কেন শুনবে না। মোদী কি ভারতের দায় দায়িত্ব ট্রাম্পের হাতে সঁপে দিয়েছেন? আমেরিকায় ভারতের পণ্য রপ্তানির ওপর একতরফা বিপুল শুল্ক চাপানো হয়েছে। মোদীরা চুপ। এখন গোপনে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির নামে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিতে চলেছেন। দেশটা কি শেষে ট্রাম্পের মরজিমাফিক চলবে? মোদী-শাহরা জবাব দেবেন না?
Editorial
আমেরিকার গাঢ় ছায়া

×
Comments :0