Post Editorial

চাপে থাকা কৃষক এবার ট্রাম্পের মুখোমুখি

উত্তর সম্পাদকীয়​

শুদ্ধসত্ব গুপ্ত


আশির দশকে যখন রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের বাড়িতে যেতেন প্রায় সর্বত্র গরম দুধ দিয়ে অতিথিকে আপ্যায়ন করা হতো। অন্ধ্র উপকূলে কৃষকরা কোথাও কোথাও রুপোর গ্লাসে অতিথিকে দুধ দিতেন। তামিলনাডুতে খাঁটি পিতলের বাটিতে দুধ দেওয়া হতো অতিথিকে। কখনও আবার সেইসঙ্গে দেওয়া হতো কফিও। 
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক পরিবারের এই আপ্যায়ন বদলে যেতে দেখেছেন তিনি। দুধের বদলে দেওয়া হচ্ছে চা। এমনকি কোথাও কোথাও দুধ ছাড়াই চা দেওয়া হচ্ছে। তা-ও প্লাস্টিক বা কাগজের কাপে। 
নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে ভারতের গ্রামাঞ্চলে কৃষক পরিবারে অতিথি আপ্যায়নের এই পরিবর্তন জানিয়েছেন সাংবাদিক পি সাইনাথ। ‘দ্যা ওয়্যা র’ পোর্টালে সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে মনে করিয়েছেন উদারনীতির পর্বে কৃষি অর্থনীতি বদলে যাওয়াই কৃষকের এমন সঙ্কটের কারণ। সাইনাথ বলছেন, মহারাষ্ট্রের তুলো উৎপাদন এলাকা বিদর্ভে ১৯৭০ নাগাদ একজন কৃষক দুই কুইন্টাল তুলো বিক্রি করে দশ বারো গ্রাম সোনা ভবিষ্যতের জন্য কিনে রাখতে পারতেন। আজকে এক কুইন্টাল বিক্রি করতে হচ্ছে ৬৫০০ টাকায় যেখানে তুলোর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ৭১২২ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে হাতে যা থাকছে তা দিয়ে আজকের সময় সোনা কেনার আর উপায় নেই। চাষের সময়ে খরচ, ধার শোধ করতেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে কৃষকদের। 
গ্রামাঞ্চলে এবং কৃষকের সঙ্কট চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যকেও। 
২০২৪-এ ফোর্স এর তালিকা অনুযায়ী ২১৭ জন ডলার বিলিয়নেয়ারের মোট সম্পদ ১ হাজার ৪১ বিলিয়ন ডলার। সেই অর্থবর্ষেই কৃষির জন্য দেশের সরকারের বরাদ্দ ছিল ১৭.৯১ বিলিয়ন ডলার। মানে দাঁড়াচ্ছে ভারতের কৃষি বাজেটে মোট বরাদ্দ যা তার তুলনায় অতিধনী এই ২১৭ জনের সম্পদ ৫৮ গুণ! 
দেশের বাজেটে মোট যা ব্যয় করা হয় এই কয়েকজনের সম্পদ তারও প্রায় দ্বিগুণ, ঠিক ঠিক হিসাবে, ১.৮ গুণ। 
কেমন আছেন দেশের কৃষকরা? 
জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ৭৭ তম রাউন্ডের প্রতিবেদন দেখে নেওয়া যেতে পারে। এই হিসাব বলছে গড়ে প্রতি কৃষক পরিবার মাসে ১০, ২১৮ টাকা আয় করে। পরিবারের চার বা পাঁচ জনের জন্য আয় এতটুকুই। এই অঙ্ক নিয়েও বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। সব খরচ আদৌ এই হিসাবে ধরা আছে কিনা প্রশ্ন আছে তা নিয়ে। তাছাড়া ধারের টাকাও আয়ের হিসাবে ঢুকে পড়েছে কিনা সে সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। 
বাস্তব হিসাবে দেখাচ্ছে কৃষি থেকে আয় ২০১২-১৩ থেকে ২০১৮-১৯ এর মধ্যে ১০% কমেছে। কিন্তু কেবল এই পর্বই নয়, উদারীকরণের গোটা তিন দশকের অন্যতম চিহ্ন ফলক হয়ে রয়েছে কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়া বিপুল মানুষ। তিন দশকে কৃষিকাজ ছেড়েছেন প্রায় দেড় কোটি কোটি কৃষিজীবী। হিসাব কষলে দাঁড়ায় প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ২০০০ পূর্ণ সময়ের কৃষক পেশা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। 
দেশের সরকার বা রাজ্যের, যে তথ্য আড়ালে মরিয়া তা হচ্ছে কত কৃষক আত্মঘাতী হচ্ছেন। জাতীয় অপরাধ নথিভুক্তি ব্যুরো বা এনসিআরবি নির্দিষ্ট করে সেই তথ্য প্রকাশ করছে না। রাজ্য সরকার তো পরিষ্কার বলছে সংখ্যাটা শূন্য। সারা ভারত কৃষকসভা এবং কৃষক আন্দোলন যদিও বারবারই নামের তালিকা দিচ্ছেন কত কৃষক ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মঘাতী হচ্ছেন, কোথায় ক্ষুদ্রঋণের সংস্থার তাগাদায় নিজেকে শেষ করে দিচ্ছেন কৃষি পরিবারের সদস্যরা। 
প্রভূত চাপাচাপির মধ্যেও হিসাব বিশ্লেষণ করে ধরা পড়ছে ২০২২ এ কৃষি কাজে যুক্ত ১১,২৯০ জন আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তার মানে হয় সে বছরে প্রতিদিন অন্তত ত্রিশ কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন দেশে। 
গত জুলাইয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কৃষকদের আয় এবং ব্যয় নিয়ে। নেওয়া হয়েছে কৃষির খরচ এবং দাম সংক্রান্ত কমিশন বা সিএসিপি’র হিসাব। এই কমিশনের দেওয়া কৃষকের খরচের হিসাব ধরে সরকার ঠিক করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য। প্রতি ঘোষণাতেই দেখা যায় স্বামীনাথান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কৃষকের যা প্রাপ্য তা থেকে কম ঘোষণা করা হয়েছে এমএসপি। কেননা খরচই ধরা হয়েছে কমিয়ে। 
এই প্রতিবেদনটি দেখিয়েছে প্রধান শস্যগুলির প্রায় সব ক্ষেত্রে কৃষকের আয় যতটা বেড়েছে গত এক দশকে তার চেয়ে বেড়েছে গ্রামীণ মূল্য বৃদ্ধির হার। দেখা গিয়েছে খরচ বাদ দিয়ে কৃষকের আয় প্রতিটি শস্যের ক্ষেত্রে প্রায় কমেছে। 
২০১৩-১৪ তে ধানের গড় উপকরণ খরচ ছিল প্রতি হেক্টরে ২৫ হাজার ১৮৯ টাকা। গড়ে প্রতি হেক্টরের ধান বেচে কৃষক পেয়েছিলেন ৫৩ হাজার ২৪২ টাকা। সেই হিসেবে অনুযায়ী খরচ বাদ দিলে কৃষকের ঘরে এসেছিল ১৯,৬১১ টাকা। ২০২৩-২৪ এর সরকারি হিসাব দাবি করছে কৃষকের ঘরে সেই কৃষি বর্ষে প্রতি হেক্টরের ধান বিক্রি করে এসেছে ৩০,২১৬ টাকা। সেই বিচারে আয় বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। কিন্তু এই একই সময়ে গ্রামাঞ্চলে ধানের দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। 
মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষির ভাগ ১৬ শতাংশ। কিন্তু এই ক্ষেত্রটিতে দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমজীবী যুক্ত। ফলে দামের তুলনায় আয় বৃদ্ধি কম মানে গ্রামাঞ্চলে কৃষক পরিবারের খরচ করার মতো অর্থ বা প্রকৃত আয় কমে যাওয়া। 
সরকারি হিসাবেও ধরা পড়ছে কৃষকের আয় এ রাজ্যে জাতীয় স্তরের তুলনায় কম। দেশ হোক বা রাজ্য, সরকারি সমীক্ষায় যে হিসাব দেওয়া হয় তার কতটা সত্যিই কৃষকের আয় তা নিয়ে সন্দেহ থেকেছে বারবার। 
জাতীয় পরিসংখ্যান সংগঠন বা এনএসও’র সিচুয়েশন অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ পরিবারের মাসিক গড় আয় ৬,৭৬২ টাকা। জাতীয় গড় ১০ হাজার ২১৮ টাকা। মহারাষ্ট্রে ১১ হাজার ৪৯২ টাকা রাজস্থানে ১২৫২০ টাকা, ত্রিপুরায় সে সময়ে ৯৯১৮ টাকা। আর কেরালায় ১৭ হাজার ৯১৫ টাকা। ‌
কিন্তু কৃষকের আয় নিয়ে সরকারি হিসাব ঘিরে সন্দেহ থাকে কেন?
আমরা বাঁকুড়ার সোনামুখীর কামারগোড়ে গ্রামের কথা শুনে নেব। এ গ্রামে সম্পূর্ণ কৃষকও আড়তদারের ঋণের ভরসা ছাড়া চলতে পারছেন না। কৃষককে হার বীজ কিনতে হচ্ছে খোলা বাজারে বেশি দামে। কালোবাজারি শিকার হচ্ছেন কৃষিজীবীরা। ঘরের মহিলাদের নামে ঋণ নিচ্ছেন মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার থেকে। ১৮ থেকে ২৫ শতাংশ সুদে। সমবায় প্রয়োজন মতো ঋণ দেয় না। ফলে কৃষকের ভরসা আড়তদার। তার বিনিময়ে আড়তদাদের সঙ্গে আগাম বোঝাপড়া করে বেচে দিতে হচ্ছে ফসল। ১৬৬০ টাকা কুইন্টাল সরকারি দর হলেও কৃষক ফসল বেচছেন ৯০০ টাকা দরে। 
এখন অনলাইনে নাম নথিভুক্ত করতে হচ্ছে রাজ্যের ওয়েবসাইটে। কৃষক বন্ধু কার্ড রয়েছে রাজ্যের। কিন্তু নিজের নামে জমি না থাকলে কৃষক বন্ধু কার্ড পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি মান্ডিতে কৃষক বন্ধু কার্ড না থাকলে ফসল বেচাও যাচ্ছে না। অনলাইনে নাম ঠিক করে দিচ্ছে আড়তদারই। সরকারি খাতায় কৃষক ১৬৬০ টাকা পাচ্ছেন কুইন্টালে। আর বাস্তবে অনেক আগেই ৯০০ টাকা দরে সেই ধান কিনে রেখেছে আড়তদার।
কেবল চাষের খরচ নয়। বিয়ে বাড়িতে উপহার কেনার সময়ও কৃষিজীবীকে দেখা যাচ্ছে আড়তদারের থেকে টাকা নিতে।
এমন তথ্য নিয়েও নাড়াচাড়া হয়েছে যে ২০২৩-২৪ কৃষিবর্ষে রাজ্যে কৃষকবন্ধু কার্ড রয়েছে এমন ২৫ লক্ষ কৃষকের থেকে ধান কেনার জরুরি লক্ষ্যমাত্রা নিতে হয়েছিল। কেনা ধান কেনার লক্ষ্য মাত্রা থেকে পিছিয়ে ছিল রাজ্য। ১৭ লক্ষ নাম নথিভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ধান বিক্রি করেছিলেন মাত্র ১ লক্ষ ৩৭ হাজার। 
কৃষকের কৃষিকে বদলে কর্পোরেট কৃষি করতে তিন কৃষি আইন পাশ করিয়েছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। দুর্মর লড়াইয়ে ঠেকিয়েছিলেন কৃষকরা। এবার শুল্কের ভয় দেখিয়ে কৃষি বাজার দখলে সরাসরি নেমেছে আমেরিকা। মোদী কিন্তু এখনও পালটা পদক্ষেপ নেননি। বিপুল বিক্ষোভের আশঙ্কায় বলছেন যে ভারতের কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় শেষ পর্যন্ত সজাগ তিনি। আরেকদিকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা জারি রয়েছে পুরোদমে। কেমন সজাগ মোদী?
কেন্দ্রের পরোক্ষ কর এবং বৈদেশিক শুল্ক বোর্ড বা সিবিআইসি তুলো আমদানির ওপর ১১ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে। মানে বিদেশের থেকে তুলো আসবে কম দামে। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে দেশের কৃষকদের যাঁরা মার খেয়ে বসে রয়েছেন ভরতুকিতে, সার-কীটনাশকের খরচে। 
এমনই তো চাইছেন ট্রাম্প!

 

 

Comments :0

Login to leave a comment