editorial

শাসকের দ্বিচারিতা

সম্পাদকীয় বিভাগ

হরিয়ানার অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলি খান এবং বিজেপি শাসিত মধ্য প্রদেশ সরকারের মন্ত্রী বিজয় শাহ যেন এই মুহূর্তের ভারতের শাসকদের দ্বিচারিতার এক নিদর্শন। বুধবার অধ্যাপক মাহমুদাবাদকে জামিনের নির্দেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট শুধু তাঁকে নয়, দেশবাসীকেও একধরনের স্বস্তি দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশে অধ্যাপক মাহমুদাবাদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার বিশিষ্ট নাগরিকরাও নিঃসন্দেহে স্বস্তি পেয়েছেন। অন্যদিকে ভারত যে নাগরিকদের শ্বাসরোধ করে মুখবন্ধ করে রাখা দেশ নয়, সেকথাও পরোক্ষে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে শাসকদের। বিষয়টি উল্লেখযোগ্য, কারণ বুধবার সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের মাত্র একদিন আগেই হরিয়ানার সোনিপতের নিম্ন আদালত হরিয়ানা পুলিশের আবেদন মাফিক আরও সাত দিনের জন্য জেল হেপাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিল ধৃত অধ্যাপককে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ফলে শেষপর্যন্ত তা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে মধ্য প্রদেশ হাইকোর্ট নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও বিজেপি শাসিত মধ্য প্রদেশ সরকারের মন্ত্রী বিজয় শাহের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থাগ্রহণই করা হয়নি। এমনকি দেশজুড়ে নিন্দা সত্ত্বেও তাঁকে মন্ত্রীপদ থেকে সরানোর কোনও লক্ষ্মণও দেখাচ্ছে না বিজেপি সরকার।  
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশন সিঁদুরের পরে সোশাল মিডিয়াতে যুদ্ধোন্মাদনার বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ। অপারেশন সিঁদুরের পরে প্রেস ব্রিফিং করা কর্নেল সোফিয়া কুরেশির উল্লেখ করে তিনি বিজেপি ও আরএসএস’র সংখ্যালঘু ঘৃণা প্রচারকারীদের বিদ্রুপ করেছিলেন এবং দেশের ভিতরে মুসলিম নাগরিকদের ওপরে আক্রমণ ও নির্যাতনের বিরোধিতা করেছিলেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে এক বিজেপি নেতা তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ, ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত ও সাম্প্রদায়িক প্রচারের অভিযোগে দায়ের করেন। এছাড়াও দেশের সেনাবাহিনীতে মহিলা অফিসারদের প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করায় তাঁর বিরুদ্ধে নোটিস জারি করে, স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এফআইআর দায়ের করে হরিয়ানার মহিলা কমিশন। এরপরে গত রবিবারেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে হরিয়ানার সোনিপতের এক নিম্ন আদালতে পেশ করে দু’দিনের জেল হেপাজতে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার জেল হেপাজতের মেয়াদ শেষ হলে ফের তাঁকে নিম্ন আদালতে তুলে আগামী ২৭ মে পর্যন্ত তাঁর জেল হেপাজতের নির্দেশ আদায় করে নেয় হরিয়ানা পুলিশ। কিন্তু বুধবার মাহমুদাবাদের আবেদন শুনে সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে জামিনের নির্দেশ দিয়ে তদন্ত চালিয়ে যেতে বলেছে। 
মাহমুদাবাদের গ্রেপ্তারিতে দেশজুড়েই শিক্ষক অধ্যাপক ছাত্র ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। বিজেপি যে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধোন্মাদনা জাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে তারই কৌশল হিসাবে অধ্যাপক মাহমুদাবাদকে গ্রেপ্তার করা, তা না বোঝার কোনও কারণ নেই। সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারায় বাক্‌ স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে এবং ১৯(২) ধারায় যুক্তিসম্মত বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। সেই যুক্তিসম্মত বিধিনিষেধগুলি ভঙ্গ না করলে মত প্রকাশের জন্য কাউকেই গ্রেপ্তার করা যায় না, শাস্তি দেওয়া যায় না। অধ্যাপক মাহমুদাবাদকে তা সত্ত্বেও হেনস্তা করা হচ্ছে। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগেও শারজিল ইমাম ও উমর খালিদকে স্বাধীন মতপ্রকাশের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে তাঁরা বিনা দোষে জেল খাটছেন। অথচ এই সময়েই মধ্য প্রদেশের মন্ত্রী বিজয় শাহকে তাঁর কুৎসিত, অবমাননাকর এবং সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক মন্তব্য সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেনাবাহিনীর অফিসার সোফিয়া কুরেশির ধর্ম পরিচয়কে ইঙ্গিত করে তাঁকে সন্ত্রাসবাদীদের বোন হিসাবে উল্লেখ করে বিজয় শাহ একই সঙ্গে কৃতিত্বের পরিচয় দেওয়া সামরিক বাহিনীকে অবমাননা করেছেন, সোফিয়া কুরেশি’কে অবমাননা করেছেন এবং একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে দেশের ভিতরের ঐক্য ও অখণ্ডতায় আঘাত করেছেন। এর সবগুলিই সংবিধানের ১৯(২) ধারার বিরোধী। সেই জন্যই মধ্য প্রদেশ হাইকোর্ট তার বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেয়। এসত্ত্বেও বিজয় শাহের বিরুদ্ধে এখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর চেয়ে নির্লজ্জ দ্বিচারিতা আর কি হতে পারে!

Comments :0

Login to leave a comment