মীর আফরোজ জামান : ঢাকা
বাংলাদেশে সাহিত্যিক উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর পৈতৃক বাড়িটি ভেঙে ফেলা হলো। ভেঙে ফেলার কাজ করল মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তিকালীন সরকার। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় শশী লজের ঠিক পিছনে অবস্থিত বাড়িটি ওই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বছরের পর বছর অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল স্মৃতি বিজরিত বাড়িটি। বাড়িটি পূর্বে ময়মনসিংহ শিশু একাডেমি হিসেবে ব্যবহৃত হত, সেটি ভেঙে নতুন আধা-কংক্রিটের কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে।
উপেন্দ্র কিশোর ছিলেন প্রখ্যাত কবি সুকুমার রায়ের পিতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের দাদা। শহরের হরিকিশোর রায় চৌধুরী রোডে অবস্থিত, শতাব্দী প্রাচীন এই বাড়িটি বিখ্যাত রায় পরিবারের উত্তরাধিকারের সাথে জড়িত, যাদের বাংলা সাহিত্য ও শিল্পে অবদানকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হরিকিশোর রায় চৌধুরী নিজে উপেন্দ্র কিশোর, সুকুমার এবং সত্যজিতের পূর্বপুরুষ ছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন যে এই ভাঙনের ফলে ময়মনসিংহ শহরে রায় রাজবংশের উত্তরাধিকার মুছে যাবে। ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসুয়ার একজন বিখ্যাত জমিদার উপেন্দ্র কিশোর এক শতাব্দীরও বেশি আগে এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর, সম্পত্তিটি সরকারি মালিকানায় আসে এবং ১৯৮৯ সালে ময়মনসিংহ শিশু একাডেমি হিসেবে পুন:র্ব্যবহৃত হয়। জেলা শিশু বিষয়ক আধিকারিক মহম্মদ. মেহেদী জামান বলেন, বাড়িটি ১০ বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। শিশু একাডেমির কাজ একটি ভাড়া করা জায়গা থেকে পরিচালিত হচ্ছে পরবর্তীতে এটিই হবে শিশু একাডেমি ভবন। তিনি আরও বলেন, যথাযথ পদ্ধতি এবং প্রয়োজনীয় অনুমোদন অনুসারে ভাঙা হচেছ ভবনটি। তিনি বলেন, একাডেমির কাজ শুরু করার জন্য বেশ কয়েকটি কক্ষ বিশিষ্ট একটি আধা-কংক্রিটের ভবন তৈরি করা হবে। ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভবনটি কেন ভেঙে ফেলা হচ্ছে জানতে চাইলে আধিকারিক বলেন, ভবনটি শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
দুঃখ প্রকাশ করে কবি শামীম আশরাফ বলেন, ‘‘বাড়িটি বছরের পর বছর ধরে করুণ অবস্থায় ছিল, ছাদে ফাটল ধরেছিল কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কখনও ইতিহাসের দিকে নজর দেয়নি। তিনি আরও বলেন, স্থানীয়রা বিভিন্ন সময়ে ভবনটি রক্ষার জন্য দাবি জানিয়েছিলেন কিন্তু কোনও ফল হয়নি।’’
শশী লজের সাথে সংযুক্ত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের (ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগ) ফিল্ড অফিসার সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, বাড়িটি এখনও বিভাগের তালিকাভুক্ত হয়নি, তবে ম্যাপ অনুসারে এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য। তিনি বিষয়টি নিয়ে শিশু একাডেমির আধিকারিক এবং প্রশাসনের সাথে কথা বলেছেন ভবনটি রক্ষার অনুরোধ জানিয়ে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
পরিসংখানে জানা যায়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১৩ বছর পর অর্থাৎ ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৮.৫ শতাংশ। তখন থেকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত হিন্দু জনসংখ্যা কমবেশি একই রকম ছিল। যুদ্ধের সময় যেসব হিন্দু ভারতে চলে গিয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। বিপর্যয় আসে এর পর। আওয়ামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে হিন্দু জনসংখ্যা নেমে আসে ১৩.৫ শতাংশে। ওই সময় দেশ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং তখন সকল ইসলামি ও মুসলিম দল ছিল নিষিদ্ধ। হিন্দুদের ওপর সামান্য নিগ্রহ হলেও এসব কাজ উগ্রপন্থী, মৌলবাদী, জামায়াত-শিবিরের বলে নিজেদের অপরাধ অন্যের ওপর চাপানো হতো।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর ১৯৮১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস ছিল কম, তখন সংখ্যা ছিল ১২.১ শতাংশ। সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতা নিয়ে ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করলে সঙ্গত কারণেই হিন্দুদের মধ্যে শঙ্কা বাড়ে এবং এরশাদের সেনাশাসনের নয় বছরে হিন্দুদের সংখ্যা কমে ১৯৯১ সালে দাঁড়ায় ১০.৫ শতাংশে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ওক্য পরিষদের নেতা কাজল দেব নাথ জানান, ‘‘লাউ সেই কদু আসলে আমাদের কোন পরিবর্তন হবে না। আজকে কোন অধিকার বলে সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি বিনষ্ঠ করা হলো? এই প্রশ্ন রাখলাম শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসের কাছে।’’
Dhaka
ময়মনসিংহে সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ি ভাঙায় ক্ষোভ দু’পারেই

×
Comments :0