অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়: বহরমপুর
কাজের আকালের ছাপ স্পষ্ট, রাজ্যে স্থায়ী কাজের অভাবে বদলে যাচ্ছে যুবজীবনের চিরাচরিত চিত্র। সামান্য উপার্জনের জন্য কেউ সকালে এক কাজে তো বিকালে আরেক কাজে অসংগঠিত শ্রমিকের কাজ করছেন, আবার কেউ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছেন পরিবারের হাল টানতে। রবিবার বহরমপুরে রবীন্দ্রভবনে ডিওয়াইএফআই’র ২০ তম রাজ্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বিভিন্ন জেলার যুব প্রতিনিধিরা এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির উল্লেখ করে বলেছেন, উপার্জনের জন্য যারা নিজেদের বসত এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন, অবসরের সময়টুকুও খুইয়েছেন, আন্দোলনের জন্য তাঁদের সংগঠিত করা খুবই কঠিন, অথচ এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সেটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে যুবদের ডিওয়াইএফআই’র পতাকাতলে টেনে আনা।
ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্মেলনে পেশ করা খসড়া প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় রাজ্যের বিভিন্ন জেলার যুব প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। দার্জিলিঙ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা কিংবা পুরুলিয়া থেকে কোচবিহার, সব জেলারই প্রতিনিধিদের উদ্বেগ, এলাকার যুবদের নিয়ে সংগঠনের নতুন ইউনিট গড়ার পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যেই হয়তো সেই কর্মীকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবারের হাল টানতে হয়তো তাঁরা হয়ে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে গিয়েছেন। আবার কেউ হয়তো শপিং মল, ডেলিভারি কর্মী কিংবা নির্মাণ শিল্পের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্রে বারো চোদ্দ ঘণ্টার কাজে যুক্ত হয়ে গিয়েছেন।
যুব প্রতিনিধিদের গলায় শোনা গেল যুব সংগঠনকে প্রসারিত করা নিয়ে এরকমই নানা সমস্যার কথা। রাজ্যের কাজের অভাব প্রকট হওয়ায় পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। এর জেরে সংগঠনের পরিধি বাড়াতে সমস্যা হচ্ছে। বেশিরভাগের গন্তব্য দক্ষিণ ভারত, বিশেষত কেরালা। এমনকি কলকাতা থেকে শিক্ষিত যুবরাও অনেকেই বাইরের রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কর্মহীনতা পশ্চিমবঙ্গের যুবক-যুবতীদের নাজেহাল করে ছাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সংগঠনের আন্দোলনকে জোরদার করার কাজ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক যুব প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কৃষি নির্ভর দক্ষিণ ২৪পরগনায় ফল চাষ করেও ফলের দাম পাচ্ছেন না। এক পাল্লা (৫কেজি) বারুইপুরের পেয়ারার দাম ৫০ টাকা। কী দাম পাবেন বাগানীরা? মাছ ধরাতেও এখন লাভ হচ্ছে না। বিভিন্ন জেলার অন্যান্য প্রতিনিধিরাও বলেছেন, কৃষি লাভজনক না থাকায় গ্রামের পর গ্রাম ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তার ওপরে শাসক দলের সন্ত্রাস ও জোর করে জমি দখল চলছে। বিএলআরও অফিসে নথীহীন জমি খুঁজে তাতে সরকারি মোহর বসিয়ে লুট করা হচ্ছে বাস্তু জমি। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধেও এখন লড়াই করতে হচ্ছে জেলার যুবদের। স্থায়ী কাজের দাবির পাশাপাশি এখন অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং আক্রমণের বিরুদ্ধে, ইনসাফের দাবিতেও লড়তে হচ্ছে। যুব সংগঠনের শেষ দেখার লড়াইকে (ফাইট টু ফিনিস) আরও শাণিত করার আহ্বান জানিয়ে হুগলীর যুব প্রতিনিধি বলেছেন, আনিস খানের হত্যা কিংবা আর জি করের ঘটনায় এখনও ন্যায়বিচার আসেনি। তাই লড়াইটা পুরোদমে জারি রাখা জরুরি।
সাধারণ গরিব মানুষের পরিবহণ সুবিধার জন্য রেল নিয়ে আন্দোলনের কথাও উঠেছে ডিওয়াইএফআই’র সম্মেলনে। যুব প্রতিনিধিরা বলেছেন, ২০২৪ সালে ট্রেন যাত্রীদের জন্য লাগাতার লড়াই করে কাটোয়া-আমোদপুর শাখায় ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো গেছে। কিন্তু সেই লড়াইয়ের জন্য পুলিশ এখনও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্মেলনের মঞ্চ থেকে এই ধরনের লড়াই করে দাবি আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ায় গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, রক্ত দিয়ে যুবরা যদি বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে পারে, তাহলে কাটোয়ার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কেন গড়া যাবে না! একশো দিনের কাজ কেন আদায় করা যাবে না!
যুব সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সকালে ভ্রাতৃপ্রতিম যুব সংগঠনগুলির নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি বিশেষ অধিবেশন করা হয়। সেখান থেকে বামপন্থী যুব শক্তিকে আরও ঐক্যবদ্ধ করার ডাক ওঠে। সভায় উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখেন আরওয়াইএফআই’র আদিত্য জোতদার, যুব লিগের সমন্বয় বিশ্বাস, এআইওয়াইএফ’র রাজেন্দ্র রাম, পিওয়াইএফআই’র অভিজিৎ চক্রবর্তী। তাঁরা বলেন, পেশাগত পরিবর্তন হচ্ছে, আন্দোলনের ধারারও পরিবর্তন দরকার। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই জরুরি। কারণ তাদের লুটের জন্যই বেকারি ও আধা বেকারি বাড়ছে। এই বিশেষ অধিবেশনে ডিওয়াইএফআই’র তরফে অংশ নেন রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জি। তিনি বলেন, সংগঠনের শক্তি যাই থাকুক না কেন, প্রতিটি বাম যুব সংগঠনকে একযোগে লড়তে হবে। যৌথ আন্দোলনের এই ধারা টিকিয়ে রাখতে হবে।
ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দীনেশ মজুমদারের কন্যা রমা বিশ্বাস এবং যুবশক্তি পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক সোমশুভ্র গুপ্তের স্ত্রী নিবেদিতা গুপ্ত। সংগঠনের তরফে তাঁদের সংবর্ধিত করা হয়, সংবর্ধনা দেওয়া হয় ডিওয়াইএফআই’র প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি বাদল দত্ত ও বস্তি ইউনিয়নের নেতা আবদুল রউফ’কেও।
সংগঠনের ৫৩তম প্রতিষ্ঠা দিবসে ৩ নভেম্বর কোচবিহার থেকে ২২ ডিসেম্বর কলকাতার যাদবপুর পর্যন্ত চলতে থাকা ইনসাফ যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে এদিন যুবশক্তির তরফে ‘ইনসাফ যাত্রার ডায়েরি’ নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়েছে। বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন সংগঠনের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। অধিবেশন মঞ্চে এদিন গান পরিবেশন করেন মুর্শিদাবাদ জেলার প্রথম শহীদ সন্তোষ ভট্টাচার্যের নাতনি শ্রুতি ভট্টাচার্য। ডিওয়াইএফআই’র বিংশতিতম রাজ্য সম্মেলনে বিভিন্ন জেলা থেকে ৪৫০জন প্রতিনিধি ও দর্শক যোগ দিয়েছেন। সম্মেলন চলবে সোমবার পর্যন্ত।
DYFI Conference
শেষ দেখার লড়াইকে আরও শাণিত করতেই চলছে আলোচনা

×
Comments :0