প্রতীম দে
জাতীয় শিক্ষানীতি তামিলনাড়ুতে কড়া বিরোধিতার মুখে পড়েছে। রাজ্যের ডিএমকে সরকার কেন্দ্রের চাপানো তিন ভাষা নীতির তীব্র বিরোধী। মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন বলছেন, হিন্দি জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার কৌশলে এই নীতি নেওয়া হয়েছে।
জন্মলগ্ন থেকে ‘এক’-এ বিশ্বাসী আরএসএস,  রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ। ‘এক দেশ, এক নেতা, এক ভাষা, এক সংবিধান’ যে তাদের লক্ষ্য সেই কথা সংসদে দাঁড়িয়ে মুক্তকন্ঠে বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
এই ‘এক দেশ’ মানে হিন্দুরাষ্ট্র, ‘এক ভাষা’ মানে হিন্দি ভাষা, ‘এক সংবিধান’ মানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আর ‘এক নেতা’ মানে নরেন্দ্র মোদী।
এজি নুরানি তাঁর ‘আরএসএস ও বিজেপি, শ্রম বিভাজন’ বইতে লিখেছেন, ‘‘১৯২৫ সালের দশেরার দিন ড: কে. বি. হেডগেওয়ার একটা বিশেষ কারণে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন: কারণ, তাঁর মতে, ‘হিন্দু রাষ্ট্র’, 'গৌরবময় অতীতের' ধারণা জাতীয় জনজীবন থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে ১৯২০ সালে রাজনৈতিক দিগন্ত থেকে লোকমান্য তিলকের তিরোধানের পর থেকে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা জাতীয় স্বার্থ অবহেলিত হচ্ছে।’
আরএসএস প্রতিষ্ঠাতার ‘হিন্দু জাতির’ ধারণা ভারতে বসবাসকারী সমস্ত জনগণের একমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের ধারণার উপরে প্রতিষ্ঠিত। 
এখানে বহুত্ব এবং বৈচিত্র একেবারে বাদ।
আরএসএস’র রাজনৈতিক শাখা বিজেপি। কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করলেও সংবিধান বদল করা বা এক ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি, কারণ তখন গোটা দেশে কংগ্রেসের পাশাপাশি তাদের লড়াই করতে হচ্ছে বামপন্থীদের সঙ্গে। দিল্লি শাসন করলেও পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার মতো রাজ্যে ঢুকতে পারেনি বিজেপি, আরএসএস।
২০১৪ সালে আরএসএসের ইচ্ছায় প্রধানমন্ত্রী হলেন মোদী। গুজরাট গণহত্যার মুখকে সামনে রেখে দেশ ভক্তির নাম করে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াতে শুরু করলো আরএসএস। এই সময়কালে সংসদীয় রাজনীতিতে কিছুটা দুর্বল হয়েছে বামপন্থীরা। সেই সুযোগে সংসদকে ব্যবহার নিজেদের ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গঠনের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে শুরু করলো বিজেপি।
সাল ২০১৭। শুরুটা হয় জিএসটি দিয়ে- ‘এক দেশ এক কর’। তারপর ২০১৯, আগস্ট ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি। কাশ্মীরে জারি হলো রাষ্ট্রপতি শাসন। ২০২০ নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি। 
এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে নিজেদের ‘এক দেশ এক ভাষা’ নীতি কার্যকর করতে চাইলো বিজেপি তথা আরএসএস। করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংসদে কোন আলোচনা ছাড়াই লাগু করা হয়। 
জাতীয় শিক্ষানীতির ১৩ নম্বর পাতার ৪.১১ পয়েন্টে বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণি বা খুব বেশি হলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একজন পড়ুয়া নিজের মাতৃভাষা বা স্থানীয় ভাষায় নির্দেশনার মাধ্যমে পড়তে পারবেন। তারপর? 
না। মাতৃ ভাষা বা স্থানীয় ভাষায় নির্দেশনার মাধ্যমে পড়ার কোনও সুযোগ থাকবে না। অষ্টম শ্রেণির পর মাতৃ ভাষা শুধুমাত্র একটি ‘ভাষা’ হিসাবে সে পড়তে পারবে, তাও যদি তা সম্ভব হয় তবেই।
আপাতবিচারে মনে হবে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে সব ভাষাকে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।  আসল খেলা রয়েছে তিন ভাষা সূত্র (‘Three Language Formula’)’ তে লুকিয়ে। কী বলছে এই ফর্মুলা? 
বলা হয়েছে একজন পড়ুয়া তৃতীয় ভাষা হিসাবে ভারতের যে কোনও ভাষাকে বেছে নিতে পারে, এমনকি সে বিদেশি ভাষাও বাছতে পারে। মানে ধরা যাক, বাংলা, ইংরেজি যদি যথাক্রমে প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাষা হয় তবে তৃতীয় ভাষা হিসাবে সে তামিল নিতে পারে বা বিদেশি কিছু নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সে নিতে পারবে না।
কেন?
কারণ সব শ্রেণিতে সংস্কৃত বাধ্যতামূলকও করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতে যে ভাষায় প্রান্তিক, অন্ত্যেজীবী অংশের কোনও অধিকার দেয়নি বর্ণ বিভাজন। বিজেপি আরএসএস’র কাছে জনিশক্ষার প্রসারের থেকে অনেক জরুরি ‘দেবভাষার’ প্রসার। 
ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে এই জাল তৈরি করেছে বিজেপি। শিক্ষা নীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ষষ্ঠ এবং অষ্টম শ্রেণিতে ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ নামে একটি  প্রোজেক্ট করতে হবে পড়ুয়াদের। এই প্রজেক্টে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার সাথে সংস্কৃত এবং অন্যান্য ধ্রুপদি ভাষার সঙ্গে যোগসূত্রের  উল্লেখ করতে হবে। 
শিক্ষানীতির ৪.১৮ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে, সব শ্রেণির জন্য সংস্কৃত বাধ্যতামূলক। ‘Three Language Formula’ র মাধ্যমে সংস্কৃতকে বাধ্যতামূলক করা হবে। তাহলে তামিল পড়তে ইচ্ছা হলে কেউ পড়তে পারবে না। বিদেশি কোনও ভাষা শিখতে চাইলে কেউ পড়তে পারবে না। বাকি যেই ভাষাগুলি পড়ার কথা বলা হচ্ছে সেগুলি কুমিরছানা দেখানোর মতো।
                                        
                                    
                                
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
Comments :0